ওভারলোডিং কমাতে দরকার সমন্বিত পরিকল্পনা
প্রায়শই আমরা সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে তিনটা মৌলিক বিষয় তুলে আনি আর সেগুলো হলো—ওভারটেকিং, ওভারস্পিডিং এবং ওভারলোডিং। যাদের অনেক সময় ‘থ্রি ওভার’ বলেও উল্লেখ করা হয়। এই তিনটির যেকোনো একটি বা একাধিক কারণে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়ে থাকে।
তিনটি ফ্যাক্টরের মধ্যে ওভারলোডিং-এর সাথে অন্য দুইটা ফ্যাক্টরের একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। যেমন—ওভারটেকিং বা ওভারস্পিডিং বিপদজনক কিন্তু ওভারটেকিং করে যদি কেউ সময়মতো তার লেনে ফিরে আসে বা ওভারস্পিডিং করে যদি কোনো চালক দুর্ঘটনা না ঘটায় তাহলে ঐ দুই ফ্যাক্টরের আপাত কোনো প্রভাব সড়কে পড়ে না। কিন্তু ব্যতিক্রম হচ্ছে ওভারলোডিং।
বিজ্ঞাপন
ওভারলোডিং-এর ফলে যানবাহনের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কমে যায় যা সড়ক দুর্ঘটনায় সরাসরি প্রভাব ফেলে। কিন্তু তারচেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, একজন চালক বা মালিক ওভারলোডিং করে যাত্রা শুরু করে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটালেও রাস্তার অনেক ক্ষতি করে ফেলে।
আরও পড়ুন >>> আলমডাঙ্গা মহাসড়কের একদিন
একটি রাস্তা ডিজাইন করার সময় এর স্থায়িত্বকাল হিসাব করে তার ওপর কত ওজন (এক্সেল লোড) কতবার করে পড়বে তা ধরে এর প্রতিটা স্তরের পুরুত্ব নির্ণয় করা হয়। কিন্তু ওভারলোডিং করে একটি গাড়ি যখন সড়কে আসে তখন যে রাস্তার ওপর একটা অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করে যার জন্য রাস্তা আদতে প্রস্তুত নয়। তখন সড়কের ওপর চোখে দেখা যায় না এমন ডিস্ট্রেস বা ফাটল তৈরি হয়।
এভাবে যখন একের পর এক ওভারলোডিং করা যানবাহন একই সড়কের ওপর চলাচল করে তখন এই ফাটলগুলো আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হয় এবং ততদিনে ঐ ফাটল দিয়ে বৃষ্টির পানি নিচের স্তরে প্রবেশ করে তাদের দুর্বল করে দেয়। এভাবে আস্তে আস্তে রাস্তা দেবে যায় বা ভেঙে যায়। এর ফলে অনেক ভালো মানের রাস্তা তার স্থায়িত্বকাল শেষ হওয়ার আগেই নষ্ট হয়ে যায় আর তার সাথে নষ্ট হয় রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ।
ওভারলোডিং করে একটি গাড়ি দুর্ঘটনা না ঘটালেও রাস্তার অপূরণীয় ক্ষতি করে যাচ্ছে তার প্রতিটি যাত্রায়। তাই ওভারস্পিডিং বা ওভারটেকিং করে একজন চালক তার নিজের ও অন্য আরেকটি গাড়ির জন্য ঝুঁকি তৈরি করে মাত্র কিন্তু ওভারলোডিং-এর ফলে একজন চালক তার নিজের জন্য যেমন ঝুঁকি তৈরি করে তেমনি রাস্তার ক্ষতি করে যা এই পথে অতিক্রম করা সব যাত্রীর জন্য একটা নীরব ঝুঁকির সূচনা করে।
ওভারলোডিং করে একটি গাড়ি দুর্ঘটনা না ঘটালেও রাস্তার অপূরণীয় ক্ষতি করে যাচ্ছে তার প্রতিটি যাত্রায়। তাই ওভারস্পিডিং বা ওভারটেকিং করে একজন চালক তার নিজের ও অন্য আরেকটি গাড়ির জন্য ঝুঁকি তৈরি করে...
একটা সড়কের উপরিতল বা পেভমেন্ট (Pavement)-এ প্রায় ১৬ ধরনের ক্ষতি হয় এবং তার মধ্যে ৭ ধরনের ক্ষতির অন্যতম প্রধান কারণ হলো ওভারলোডিং। প্রথম যে ধরনের ক্ষতি প্রায়শই দেখা যায় তা হলো, ‘এলিগেটর ক্রাক’, এই ধরনের রাস্তার উপরিতলে হাল্কা ফাটল দেখা যায় যা দেখতে অনেকটা কুমিরের পিঠের মতো মনে হয়।
দ্বিতীয় যে ক্ষতি হয় তার নাম ‘কোরগেশন/শোভিং’, এই ধরনের ক্ষেত্রে রাস্তায় কিছু অংশের বিটুমিন এক দিকে দলা পাকিয়ে ওপরে উঠে থাকে।
তৃতীয় যে ক্ষতি হয় তার নাম ‘লম্বালম্বি (লঙ্গিতুদিনাল) ক্রাক’, এই ধরনের ক্ষেত্রে রাস্তার মাঝ বরারব লম্বা করে ফাটল দেখা যায়।
আরও পড়ুন >>> মরণ ফাঁদের নির্মাণকাজ
চতুর্থ যে ক্ষতি হয় তার নাম ‘পট-হোল’ বা ছোট গর্ত, এই ধরনের ক্ষেত্রে রাস্তার পাথর বা খোয়া উঠে ছোট ছোট গর্ত দেখা যায়।
পঞ্চম যে ক্ষতি হয় তার নাম ‘রাভেলিং’, এই ধরনের ক্ষেত্রে রাস্তার উপরিতলের বিটুমিন উঠে গিয়ে নিচের খোয়া উঠে যায়।
ষষ্ঠ যে ধরনের ক্ষতি হয় তার নাম ‘রাটিং’, এই ধরনের ক্ষেত্রে রাস্তার উপরিতলের যে অংশ দিয়ে গাড়ির চাকা যায়, সেই অংশ চাকা বরারর দেবে যায়।
সপ্তম যে ধরনের ক্ষতি হয় তার নাম ‘পাম্পিং’, এই ধরনের ক্ষেত্রে রাস্তার অতিরিক্ত চাপে রাস্তার নিচের লেয়ার থেকে পানি ওপরে চলে আসে এবং পেভমেন্ট আস্তে আস্তে দেবে যায়।
এছাড়া আরও বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি হয় রাস্তার যার অন্যতম প্রধান কারণ হলো ওভারলোডিং। এই ধরনের ক্ষতি হলে, রাস্তা টেকানো যায় না এবং অনেক অর্থের প্রয়োজন হয় রক্ষণাবেক্ষণে। রক্ষণাবেক্ষণ একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া এবং সাধারণত একটি রাস্তার সার্ভিস লাইফ যদি ১০ বছর হয় তাহলে ৫ম এবং ৭ম বা ৮ম বছরে গিয়ে মোট দুইবার রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন। যদি ঐ রাস্তার ওপরে ডিজাইন লোডের চাইতে বেশি ওজনের গাড়ি চলাচল করে তবে রাস্তা দ্রুত নষ্ট হয় এবং এই ১০ বছর টেকনোর জন্য অন্তত ৪ বার রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়।
এতে করে অর্থের যেমন অপচয় হয় অন্যদিকে মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে যায়। American Association of State Highway & Transportation Officials (AASHTO)-এর মতে সড়কের সার্ভিস লাইফের ওপর দিয়ে যত ওজনের এক্সেল লোড যায় তার চতুর্থ পাওয়ার-এর সমানুপাতিক। অর্থাৎ কোনো রাস্তার ডিজাইন লোডের চেয়ে মাত্র দ্বিগুণ ওজনের লোড সমান সংখ্যক যাতায়াত করলে রাস্তার ক্ষতি হবে প্রায় ১৬ গুণ। এই হিসাব থেকেই ওভারলোডিং-এর ক্ষতির ভয়াবহতার মাত্রা আমরা বুঝতে পারি।
আরও পড়ুন >>> এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ!
ওভারলোডিং রোধ করার জন্য সরকার ও সড়ক নির্মাণকারী সংস্থা যেমন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—ওজন স্কেল স্থাপন ও ওভারলোডিং-এর জন্য ফাইন নির্ধারণ। কিন্তু এই দুইটি পদক্ষেপ ওভারলোডিং পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
প্রথমত, সব সড়ক-মহাসড়কে ওজন স্কেল বসানো হয়নি এবং দ্বিতীয়ত ফাইন দিয়ে ওভারলোডিং করা ট্রাক রাস্তায় চলতে দিলে সরকার কিছু রাজস্ব হয়ত পাচ্ছে কিন্তু রাস্তার ক্ষতি যা হওয়ার তাই হচ্ছে এবং বছর শেষে রক্ষণাবেক্ষণের কিছু অর্থ সেখান থেকে পাওয়া গেলেও দুর্ঘটনার ঝুঁকি আগের মতোই থাকছে।
এছাড়া অনেক সুযোগ সন্ধানী চক্র ওজন স্কেল যেসব স্থানে আছে তার দুই পাশে ছোট ছোট ট্রাকে করে বাড়তি ওজন পারাপার করে দেয়। যার ফলে বাকি সড়কে ওভারলোডিং-এর চাপ অব্যাহত থাকে।
রক্ষণাবেক্ষণ একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া এবং সাধারণত একটি রাস্তার সার্ভিস লাইফ যদি ১০ বছর হয় তাহলে ৫ম এবং ৭ম বা ৮ম বছরে গিয়ে মোট দুইবার রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন।
ওভারলোডিং-এর ক্ষতি কমানোর জন্য বর্তমান পদক্ষেপের সাথে আরেকটি স্ট্রাটেজি গ্রহণ করা যেতে পারে, তা হলো মহাসড়কে দুই এক্সেল এর ট্রাককে বন্ধ করে মাল্টি এক্সেল ট্রাকের ব্যবহার করা। মাল্টি এক্সেলের ট্রাক চলাচলে উৎসাহিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
দুই এক্সেলের ট্রাকের চেয়ে মাল্টি এক্সেল ট্রাক ব্যবহার করলে, সমগ্র ওজন এক্সেল লোডের সমানুপাতে বিতরণ হয়। ফলে একসাথে অনেক ওজন রাস্তায় পড়ে না। তাই সব বা কিছু গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে দুই এক্সেলের ট্রাক বন্ধ করে মাল্টি এক্সেলের ট্রাক চলাচল করতে দিলে এবং একই সাথে ওজন স্কেল ব্যবহার করে ওভারলোডিং-এর ক্ষতি কমানো সম্ভব।
আরও পড়ুন >>> পরিকল্পিত মেট্রোরেল কেন জরুরি
এক্ষেত্রে, মালিক বা পণ্য পরিবহনকারী যেন, মাল্টি এক্সেলের ট্রাক ব্যবহার করতে উৎসাহিত হয় সেজন্য এসব ট্রাকের টোল, ফেরি ভাড়া কমানো যেতে পারে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত দেশ আস্তে আস্তে দুই এক্সেলের ট্রাকের ব্যবহার কমিয়ে দিচ্ছে এবং অনেক দেশে তিন এক্সেলের নিচে কোনো পণ্য বহনকারী যানবাহন নেই।
আমাদের দেশেও আমরা এই ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারি, এর ফলে, ওজন স্কেল থাকুক বা না থাকুক পুরো সড়কে অতিরিক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণ হবে, সড়কের স্থায়িত্ব বাড়বে এবং এর ফলে রাষ্ট্রের অনেক অর্থের যেমন সাশ্রয় হবে তেমনি দুর্ঘটনার ঝুঁকিও হ্রাস পাবে। তাই, ওভারলোডিং রোধে, ওজন স্কেল-ফাইন-নজরদারির পাশাপাশি মাল্টি এক্সেলের ব্যবহারে আমরা একটি সমন্বিত পদ্ধতির সূচনা করে টেকসই সমাধান পেতে পারি।
কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ ।। সহকারী অধ্যাপক (অন-লিভ), এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট; সার্ভিলেন্স কো-অর্ডিনেটর, বিআইজিআরএস