ছবি : সংগৃহীত

২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি বরেণ্য শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকার দেন। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শিক্ষায় আসলে সঠিক বিনিয়োগ হয়নি। যেখানে বিনিয়োগ না হলেও চলবে সরকার সেখানে বিনিয়োগ করে আসছে। সব দেশ প্রশাসকে ভরে গেছে। কোনো বিজ্ঞানী নেই। গবেষক নেই। দার্শনিক নেই। যেদিকে তাকাবেন, শুধুই প্রশাসন দেখতে পাবেন।

প্রশ্ন হলো কেন এমন হচ্ছে? স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা রাষ্ট্রের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রশাসকদের জয়জয়কার। এই রাষ্ট্রে বিজ্ঞানী, গবেষক ও দার্শনিকদের কোনো মূল্যায়ন হয় না। তারা থাকে অবহেলিত, ক্ষমতাহীন। ফলে নতুন প্রজন্মের কেউ বিজ্ঞানী, গবেষক হতে চায় না।

কী ছাত্র, কী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সবাই প্রশাসক হয়ে চায়। ভাবা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পর্যন্ত নিয়োগের পরদিন থেকে একাডেমিক কাজ কর্মের চেয়ে প্রশাসনিক পদ-পদবী পেতে দৌড় ঝাঁপ শুরু করে।

আরও পড়ুন >>> সৃজনশীল ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা কেন জরুরি?

প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন সহকারী প্রক্টর, প্রক্টর, হাউজ টিউটর, প্রভোস্ট, ডিন, শিক্ষক সমিতির নেতা, বিভিন্ন ইন্সটিটিউট বা রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক, উপাচার্য বা উপ-উপাচার্য বা কিংবা কোষাধ্যক্ষ হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনীতি শুরু করে দেন।

প্রতি বছরই নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হচ্ছে। এতে করে ৪০-৫০ বছরের শিক্ষকদেরও দেখি উপাচার্য বা উপ-উপাচার্য হয়ে যেতে। অথচ এই বয়সটাই হলো শিক্ষার্থীদের দেওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়।

এই সময়েই একজন শিক্ষক পিএইচডি শেষে মাত্র অধ্যাপক হয়েছেন। তখন শিক্ষক তার শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ও গবেষণার অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে পড়াতে পারেন এবং একই সাথে গবেষণা করাতে পারেন। কিন্তু সেইদিকে তারা হাঁটছেন না। তারা হাঁটছেন প্রশাসনিক পদ-পদবীর দিকে।

স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা রাষ্ট্রের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রশাসকদের জয়জয়কার। এই রাষ্ট্রে বিজ্ঞানী, গবেষক ও দার্শনিকদের কোনো মূল্যায়ন হয় না। তারা থাকে অবহেলিত, ক্ষমতাহীন।

আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন শেষে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পৌঁছে গিয়েছেন বলে ধরে নেন এবং এটা পূর্ণতা পায় অধ্যাপক হওয়ার মাধ্যমে। একবার অধ্যাপক হয়ে যেতে পারলে তার লক্ষ্য পরিবর্তিত হয়ে যায়।

তখন তিনি প্রশাসক হওয়ার মিশনে নামেন। আর সরকার এমন ব্যবস্থা করেছে যে, এইসব পদ পাওয়ার জন্য একটা সিঁড়ি বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সিঁড়ি হলো রাজনীতি। রাজনীতি করে কয়েক দফা শিক্ষক সমিতির নেতা হতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা রাষ্ট্রের বড় প্রশাসক পদ পাওয়া নিশ্চিত হয়ে যায়।

আরও পড়ুন >>> বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং ও বিজ্ঞান শিক্ষার মান 

এইসব দেখে আমরা সমাজের সামগ্রিক ব্যর্থতাকে দায়ী করি। আসলে কি তাই? আমরা শিক্ষা নিয়ে কোনো চিন্তা করি না। আমরা ব্যবসা নিয়ে চিন্তা করেই অস্থির। আমরা সব প্রণোদনা ব্যবসার জন্য রেখে দেই। সব সুযোগ-সুবিধা আমলারা পান, শিক্ষার উন্নয়ন ঘটবে কীভাবে! আমলাদের বেতন সবার চেয়ে বেশি। আমলা মাত্রই দামি গাড়ি, দামি বাড়ি। এর পাশাপাশি একজন অধ্যাপকের বেতন তুলনা করলে কিছুই না। তাহলে কেন অধ্যাপক পদ-পদবীর জন্য ছুটবেন না? কেন আমাদের তরুণরা আমলা না হয়ে বিজ্ঞানী হবেন?

কেন বিজ্ঞানী বা গবেষক কিংবা দার্শনিক হতে না চেয়ে সবাই প্রশাসক হতে চান? কারণ হলো ক্ষমতা। সবাই তার চারপাশে ঘুরঘুর করবে আর ‘স্যার’ ডাকবে। এতে আমলারা খুব মজা পান। এইসব পদ পেতে গবেষক হতে হয় না, ভালো শিক্ষক হতে হয় না বা ভালো একাডেমিশিয়ান হতে হয় না।

সমাজটাই এখন এমন হয়ে গেছে সবাই খারাপদেরই সম্মান করে, সমীহ করে। ফলে সর্বত্র এখন খারাপদেরই নেতৃত্বে দেখা যায়...

ভালো শিক্ষক বা ভালো গবেষক হয়েছেন তো মরেছেন। খারাপদের মধ্যে ভালো হতে চাওয়া মানে খারাপদের মুখোশ খুলে দেওয়ার ভয় থাকে। তাই খারাপদের সবচেয়ে বড় কাজ হলো ভালোদের দাবিয়ে রাখা, নিষ্পেষিত করা।

যেহেতু এখন খারাপদের জয়জয়কার তাই ভালোদের এখন খুব দুঃসময় যাচ্ছে। সমাজটাই এখন এমন হয়ে গেছে সবাই খারাপদেরই সম্মান করে, সমীহ করে। ফলে সর্বত্র এখন খারাপদেরই নেতৃত্বে দেখা যায়।

আরও পড়ুন >>> বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি কতটা যৌক্তিক? 

এই দেশ নিয়ে আমি আর তেমন আশা দেখি না। দেশ দিনদিন হেরে যাচ্ছে। অথচ দারুণ সম্ভাবনাময় একটা দেশ ছিল। আমি আমার ক্ষুদ্র শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি আমরা যদি আমাদের শিক্ষার্থীদের একটু ভালো পরিবেশ, ভালো শিক্ষকদের সান্নিধ্য দিতে পারতাম তাহলে মিরাকল ঘটে যেত।

আমরা আমাদের মেধাবীদের মেধাকে গণহত্যা করছি। কী সাংঘাতিক অপচয়! এই অপচয় ক্রমাগত বাড়ছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে যেভাবে শিক্ষা কাঠামো পরিবর্তন প্রয়োজন, যেভাবে শিক্ষা খাতে বিশাল বিনিয়োগ প্রয়োজন তা আর হবে না।

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়