ছবি : সংগৃহীত

জাতীয় সংসদ গঠনকল্পে সাধারণ নির্বাচনের জন্য ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা বাংলাদেশে এখন অতীত। অথচ বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া সেই ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূত’ ধরে ঝুলে পড়েছে ইউরোপিয়ান ছয়জন রাজনীতিক। যাদের পূর্ব পুরুষেরা নির্মমভাবে কূট-কৌশলের মাধ্যমে ১৯০ বছর (১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭) বাংলা তথা সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছে। ইউরোপীয় এই রাজনীতিকেরা বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে ‘ভূমিকা’ পালনের ‘অদ্ভুত আবদার’ জানিয়ে ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেপ বরেলের নিকট একটি চিঠি দেওয়ার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।

এই খবরটি ইউরোপের ‘হারানো ঔপনিবেশিক মানসিকতার’ বহিঃপ্রকাশ ব্যতীত আর কিছুই নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কাছে ‘আবদার’ জানিয়ে সংস্থার যে ছয় এমপি চিঠি দিয়েছেন তারা হলেন—স্টেফানেক ইভান (স্লোভাকিয়া), মাইকেলা সোজড্রোভা (চেক প্রজাতন্ত্র), আন্দ্রে কোভাতচেভ (বুলগেরিয়া), কারেন মোলচিওর (ডেনমার্ক), জাভিয়ের নার্ট (স্পেন) এবং হেইডি হাউটালা (ফিনল্যান্ড)।

এই ছয় এমপি চিঠি দিয়েছেন কিন্তু এর বিষয়বস্তু অনুযায়ী ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে কি না সেই বিষয়টি প্রকাশিত খবর থেকে স্পষ্ট হচ্ছে না। তবে খুব সম্ভবত পত্র লেখকগণ বাংলাদেশের বৈধ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতে খুব কম অথবা একদমই আগ্রহী নয়। তারা অর্থাৎ এই ‘চিঠি’ তৈরির উদ্যোক্তারা বস্তুতপক্ষে ইউরোপের ‘প্রভুত্ব’ প্রদর্শনের সুযোগ হিসেবেই এই চিঠিটি তৈরি করেছেন।

আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন 

বলা হয়ে থাকে ভাগ্যান্বেষণে ধন দৌলত ও ঐশ্বর্যে ভরপুর বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতি ইউরোপীয়দের নজর ছিল স্মরণাতীত কাল থেকেই। ভাস্কো-ডা-গামা ছিলেন প্রথম ইউরোপীয় যিনি পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে কালিকটের নিকটবর্তী কাপ্পাড সমুদ্র সৈকতে ১৪৯৮ সালের ২০ মে অবতরণ করেছিলেন।

এরপর থেকে কালিকট ও এর নিকটবর্তী সব এলাকায় ভাস্কো-ডা-গামা সহিংস আক্রমণ চালিয়েছিল। প্রথম ইউরোপীয়কে অনুসরণ করে পরবর্তীকালে ডাচ, ফরাসি ও ব্রিটিশ ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশ শোষণ করেছে।

শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক শক্তির একবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় উত্তরাধিকারীদের ছয় প্রতিনিধি কর্তৃক প্রণীত এবং প্রেরিত চিঠি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ওপরেও সরাসরি আঘাত নয় কি? একই সাথে এটিও প্রশ্ন যে, নির্বাচিত সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, জেল হত্যা, প্রথম সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যদের হত্যাসহ এদেশের রক্তঝরা রাজনীতির শোকাবহ ইতিহাস এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে ইউরোপীয় এই রাজনীতিকেরা কতটুকু জানেন?

বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অপ্রতিহত গতিতে বাংলাদেশের এগিয়ে চলাকে এদেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ তাদের নিজেদেরই সফলতা হিসেবে দেখছে। এই সম্পর্কে ইউরোপীয় ছয়জন রাজনীতিক কি কিছু জানেন? না, তারা কিছুই জানেন না। তাহলে তারা এই চিঠি কেন দিলেন?

এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে তারা নিজেদের বাংলাদেশের ‘প্রভু’ মনে করেন। তারা ভাবেন তাদের কথায় গোটা বিশ্ব সেইভাবে চলবে। কেউ যদি তাদের মনোভাবের বিপরীতে থাকে তাহলে তা মারাত্মক অন্যায়! বাংলাদেশের মানুষের সুখ, দুঃখ আনন্দ বেদনায় তাদের কিছুই যায় আসে না। সেই কারণে বাংলাদেশকেও বলতে হবে আমাদের বিষয়ে আমরাই সিদ্ধান্ত নেব। ইউরোপীয়দের এখানে নাক গলানো উচিত নয়।

আরও পড়ুন >>> ইভিএম ভীতি, ইভিএম রাজনীতি

অবৈধভাবে ক্ষমতার লাভে আগ্রহী বাংলাদেশের একটি চিহ্নিত মহল নিশ্চয়ই এইসব প্রভুদের শরণাপন্ন হয়েছিলেন তবেই তো  প্রভুদের পক্ষ থেকে চিঠি তৈরি হয়েছে। কারণ এইসব ইউরোপীয় নেতারা বাংলাদেশে থাকেন না। কিন্তু তাদের পূর্ব পুরুষেরা এক সময় ভাগ্যান্বেষণে বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশে এসে তারপরে এখানেরই শাসকে পরিণত হয়েছিলেন।

তখন বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হয়েছিল! অতএব শাসন ক্ষমতা দখলের ছলা কলা তাদের সবই জানা! যে প্রক্রিয়ায় ইউরোপীয়রা ব্যবসা করতে এসে এদেশের শাসক হয়ে গিয়েছিলেন(?) তা কি গণতান্ত্রিক নির্বাচন ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর তথ্যাভিজ্ঞ মহল সবাই জানেন। ছলে বলে কলে কৌশলে ইউরোপীয় বণিকেরা দু’শ বছর বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছিল।

সাধারণত ব্রিটেনে তথা ইউরোপে এমন একটি গল্প প্রচলিত আছে যে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা ভয়ংকর হলেও তা ব্রিটেনের নিজের জন্য কোনো বড় অর্থনৈতিক সুবিধা বয়ে আনেনি। বরঞ্চ বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশেরই ইউরোপীয়দের কারণে উপকার হয়েছে। সুতরাং যে সাম্রাজ্য বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশে টিকিয়ে রাখা হয়েছিল তা ছিল ব্রিটেন বা ইউরোপীয়দের বা শ্বেতাঙ্গদের কল্যাণকামী কর্মকাণ্ডের অংশ।

কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ উৎস পট্টনায়ক (Utsa Patnaik)-এর নতুন গবেষণা ‘ডিসপজেশন, ডিপ্রাইভেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ ভারতীয় উপমহাদেশে ইউরোপ তথা ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক লুটপাটের সূক্ষ্ম হিসাব তুলে ধরেছেন।

কর বা ট্যাক্স এবং বাণিজ্য সম্পর্কিত প্রায় দুই শতাব্দীর বিশদ তথ্যের ভিত্তিতে, পট্টনায়ক হিসাব করে দেখিয়েছেন যে ১৭৬৫ থেকে ১৯৩৮ সময়কালে ব্রিটেন ভারত থেকে প্রায় ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার লুটে নিয়েছে। এটি একটি বিস্ময়কর উদ্ঘাটন। ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার বর্তমানে যুক্তরাজ্যের মোট বার্ষিক দেশজ উৎপাদনের চেয়ে ১৭ গুণ বেশি।

আরও পড়ুন >>> তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ? 

বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ইউরোপের দেশে এই বিশাল অঙ্কের অর্থ বাণিজ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে চলে গিয়েছে। জগদ্বিখ্যাত ঢাকাই মসলিনের কথা সুপ্রাচীন কাল থেকেই সুবিদিত।

ঔপনিবেশিক সময়ের আগে, ব্রিটেন বাংলা তথা ভারতীয় উৎপাদকদের কাছ থেকে টেক্সটাইল এবং চালের মতো পণ্য ক্রয় করত এবং তাদের জন্য স্বাভাবিক উপায়ে অর্থ প্রদান করত বেশিরভাগই রূপা দিয়ে যেমন তারা অন্য যেকোনো দেশের সাথে করেছিল। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উপমহাদেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার এবং ভারতীয় বাণিজ্যের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পরপরই ১৭৬৫ সালে সবকিছু পরিবর্তিত হয়ে যায়।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে কর সংগ্রহ শুরু করে এবং তারপর চতুরতার সাথে সেই রাজস্বের একটি অংশ (প্রায় এক তৃতীয়াংশ) ব্রিটেনে ব্যবহারের জন্য ভারতীয় পণ্য ক্রয়ের নিমিত্তে তহবিল ব্যবহার করে। আবার, ভারতীয় পণ্যের জন্য তাদের নিজস্ব পকেট থেকে অর্থ প্রদানের পরিবর্তে, ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা ভারতীয়দের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ ব্যবহার করে কৃষক এবং তাঁতিদের কাছ থেকে বিনামূল্যে ‘ক্রয়’ করতে থাকে। এটি মহা কেলেঙ্কারি এবং দুর্দান্ত মাত্রার চুরি।

তবুও এদেশের বেশিরভাগ মানুষ কী ঘটছে সেই সম্পর্কে অবগত ছিল না। যেমন এদেশের মানুষ এখনো জানে না ইউরোপীয় ছয়জন পার্লামেন্টারিয়ান বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। এটি আসলে এদেশেরই কিছু লোকের মদদে ইউরোপীয়দের প্রভুত্ব বজায়ের চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।

এবারে বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংযোজন এবং বাতিলের সম্পর্কে কিছু বলা সমীচীন।  তৎকালীন সরকারি দল বিএনপির নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে ভুয়া একদলীয় ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পাস হয়েছিল।

কুখ্যাত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ ছিল স্বল্পতম আয়ুসম্পন্ন। মাত্র ১২ দিন ছিল এর আয়ু। সেই সময় জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিক্ষোভ ও তুমুল গণআন্দোলনের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত ছিল শাসক দল বিএনপি। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ১৯ মার্চ তারিখ এবং এই সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল ৩০ মার্চ ১৯৯৬ তারিখ।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যখন বিএনপি প্রহসনের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে পাস করেছিল তখন সংসদ ছিল ‘বিরোধী দল শূন্য’। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে বিএনপির সদস্য ছিল ২৭৮ জন, জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দল ফ্রিডম পার্টির সদস্য ছিল ০১ জন, স্বতন্ত্র ছিল ১৯জন এবং আসন শূন্য ছিল ১১টি।

আরও পড়ুন >>> জোশের লাগাম টানতে হবে 

আবার নবম জাতীয় সংসদে পাসকৃত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়েছিল। স্মরণ করা যেতে পারে নবম জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা ছিল ২৩০।

এই সংসদে বিএনপির সদস্য সংখ্যা ছিল ৩০, জাতীয় পার্টির ২৭, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের ছিল ৩ জন, ওয়ার্কার্স পার্টির ২ জন, লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ১ জন নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। শুধু তাই নয় জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের আগে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে একে ‘আলট্রা ভাইরাস টু কন্সটিটিউশন’ অর্থাৎ সংবিধানের চেতনার পরিপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশের সংবিধানে সংযুক্ত এবং তা বাতিলের এই ইতিহাস ইউরোপীয় ইউনিয়নকে চিঠি দেওয়া ইউরোপের ছয় জন পার্লামেন্টারিয়ান নিশ্চয়ই জানেন। জেনেশুনে এভাবে প্ররোচনা দেওয়ার একটাই মানে থাকতে পারে আর তাহলো বাংলাদেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে অপমানের মাধ্যমে দেশের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত হানা।

স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও বাংলাদেশকে এখন এরূপ ঔপনিবেশিক আক্রমণের শিকারে পরিণত হতে হচ্ছে। তাই এই দেশের দেশপ্রেমিক জনগণ বিক্ষুব্ধ। সচেতন ও দেশপ্রেমিকরা তাই বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশীয় কুচক্রী মহলের ইন্ধনে বিদেশিদের এইসব উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। 

অধ্যাপক অরুণ কুমার গোস্বামী ।। পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ঢাকা; সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, এবং সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়