ছবি : সংগৃহীত

১০ বছর পর পুলিশি অনুমতি নিয়ে ১০ জুন ২০২৩, শনিবার ঢাকায় কর্মসূচি পালন করেছে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি অনুমতি নিয়ে রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল করেছিল সংগঠনটি।

যুদ্ধাপরাধের দায়ে গেল দশ বছরে সভা সমাবেশের কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি অভিযুক্ত এই সংগঠনের। কিন্তু এখন নির্বাচনের ছয় সাত মাস আগে কী এমন ঘটলো যার কারণে জামায়াতকে অনুমতি দিতে হলো? তা নিয়ে সরকারের তরফে কেউ কোনো মন্তব্য করেননি। তবে ওইদিন এক সমাবেশে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন—বিএনপি পরিকল্পিতভাবে জামায়াত শিবিরকে মাঠে নামিয়েছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের ওই মন্তব্যের পর মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরছে—তাহলে কি বিএনপির পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যই সরকার জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে?

আবার আওয়ামী লীগের কেউ কেউ ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করছেন—বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে জামায়াতের অধিকার আছে সভা সমাবেশ করার। আচ্ছা বেশ। মানলাম আপনাদের কথা। কিন্তু যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ করার দায়ে পৃথিবীর নানা সংগঠন এবং ব্যক্তি নিষিদ্ধ হয়েছে।

আরও পড়ুন >>> রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!

এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে তাদের এবং তাদের উত্তরসূরিদের নাগরিক অধিকারও সীমিত রাখা হয়েছে। সেই নজির কি পৃথিবীতে নেই? আপনারাই তো এসব কথা জোর গলায় বলেছেন এতদিন? তাহলে এখন কেন ভিন্ন সুর ধরছেন? আচ্ছা মহাশয়—একটা প্রশ্নের উত্তর দিন শুধু—গেল দশ বছর তাহলে কোন যুক্তিতে তাদের সভা সমাবেশ করতে দিলেন না?

১১ জুন ২০২৩, জামায়াত ইস্যুতে গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন সরকারের তিনজন মন্ত্রী। আইনমন্ত্রী বলেছেন—সমাবেশের অনুমতির বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার। সংগঠন হিসেবে জামায়াতের যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আইন সংশোধনের কাজ চলছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত হাতের কাছে যা তথ্য আছে, তাতে দেখা যাচ্ছে এই কথা আইনমন্ত্রী প্রথম বলেছিলেন ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। এরপর পদ্মা মেঘনায় জল গড়িয়েছে অনেক। কিন্তু এখনো মন্ত্রী সেই আশ্বাসই দিয়ে যাচ্ছেন।

মানবতাবিরোধী অপরাধ করার দায়ে পৃথিবীর নানা সংগঠন এবং ব্যক্তি নিষিদ্ধ হয়েছে। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে তাদের এবং তাদের উত্তরসূরিদের নাগরিক অধিকারও সীমিত রাখা হয়েছে। সেই নজির কি পৃথিবীতে নেই?

এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গণমাধ্যমে জানিয়েছেন—যেহেতু জামায়াতের নিবন্ধন নেই, সুতরাং তাদের ইনডোরে কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হয়েছে। এতে নতুন কিছু ঘটেনি।

তবে সবচেয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন কৃষিমন্ত্রী। তার মন্তব্য হলো—জামায়াতকে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজনীতিতে অনেক ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আরও অপেক্ষা করতে হবে, রাজনীতি কোন দিকে যায় তা বুঝতে।

২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের তৎকালীন দুই শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ গ্রেফতার হয়। এর দুই সপ্তাহ পর একই দিনে গ্রেফতার হয় দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামরুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লা। মূলত এরপর থেকেই যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতে মাঠে নামে জামায়াত এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির। রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে জ্বালাও পোড়াও শুরু করে তারা।

আরও পড়ুন >>> তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ? 

জামায়াত শিবিরের তাণ্ডব চলে দেশের নানা প্রান্তে। পুলিশকে বেধড়ক পেটানো, বোমা মেরে পুলিশের হাতের কবজি উড়িয়ে দেওয়া, রেললাইন উপড়ে ফেলা, নির্বিচারে রাস্তার পাশের গাছ কেটে ফেলাসহ নানা রকম নাশকতায় মাতে তারা। এমনকি পুলিশ ফাঁড়িতে আগুন দিয়ে পুলিশ সদস্যদের পুড়িয়ে মারে শিবির কর্মীরা।

এই প্রেক্ষাপটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর হলে প্রকাশ্য কর্মসূচি পালন এক রকম বন্ধই ছিল। তবে যখনই সুযোগ পেয়েছে, রাস্তায় নেমেছে একাত্তরের ঘাতক সংগঠন জামায়াতে ইসলামী। নির্বিচার ভাঙচুর চালিয়েছে যানবাহনে। আগুনে পুড়িয়েছে বহু মানুষের স্বপ্ন ও জীবিকা।

এদিকে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে একে একে রায় হয় বিভিন্ন মামলার। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁসির দণ্ড হয় শীর্ষ জামায়াত নেতাদের। আমৃত্যু কারাদণ্ড হয় কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের।

এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট। ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন।

গোলাম আযম এবং আলী আহসান মুজাহিদসহ কমপক্ষে তিনটি মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে জামায়াতে ইসলামকে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে মন্তব্য করেছে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট। ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে জামায়াতে ইসলামী। তবে প্রায় ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো আপিল নিষ্পত্তি হয়নি।

এদিকে ট্রাইব্যুনালের রায়ের প্রেক্ষিতে দল হিসেবে জামায়াতের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শেষ করেছে অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দল। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট অনুযায়ী সংগঠনের বিচার ও সাজার বিষয়টি সুস্পষ্ট না থাকার জামায়াতের বিচারকাজ শুরু করা যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন >>> সম্প্রীতি কোথায়? 

তবে শুধু নিবন্ধন বাতিল নয়, জামায়াতকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করার দাবি আছে বিভিন্ন মহলের। এই ক্ষেত্রে সরকারি তরফে বরাবরই আদালতের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, সরকার চাইলে নির্বাহী আদেশেও নিষিদ্ধ করতে পারে জামায়াতে ইসলামকে। নজির হিসেবে তারা বলছেন, জামাত-উল-মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামি (হুজি)-সহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনকে নির্বাহী আদেশেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এই বিষয়ে ১০ জুন ২০২৩ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামালের একটি মন্তব্য প্রচার করে বেসরকারি টেলিভিশন সময় সংবাদ। অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন—সরকার যখন জামায়াতকে সভা সমাবেশের অনুমতি দিচ্ছে তখন এটা বোঝা যায় যে নির্বাচন সামনে রেখে মৌলবাদীদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছে। যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে যায়। জামায়াতকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া মানে জাতিকে বিপদের দিকে নেওয়া। বাংলাদেশ যদি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে এগিয়ে যেতে চায়, তাহলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি প্রশ্রয় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ ছিল জামায়াতের রাজনীতি। তবে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে জামায়াতকে রাজনীতির সুযোগ করে দেন জিয়াউর রহমান। এই সুযোগে ১৯৭৮ সালে অসুস্থ মাকে দেখার কথা বলে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে গোলাম আযম। সেই থেকে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তস্নাত বাংলাদেশে শুরু হয় যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের রাজনীতি।

খান মুহাম্মদ রুমেল ।। অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর, সময় টিভি