উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ ও শিক্ষকদের পদোন্নতি
বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাদ্দ বাড়ানো নিয়ে কথা হচ্ছে অনেকদিন, কিন্তু সেইদিকে সরকারের নজর নেই। নজর নেই দেখে সরকার কোনোরকম থোক বরাদ্দ দেয়। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আবার গবেষণায় বরাদ্দকৃত টাকাও খরচ করতে পারে না।
দেশের ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) জন্য ১২ হাজার ২৬২ কোটি ৭৮ লাখ টাকার বাজেট অনুমোদন করেছে ইউজিসি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ব্যয় বাবদ এই বাজেট অনুমোদন করা হয়। (প্রথম আলো, ২১ মে ২০২৩)। অথচ ১ লাখ কোটি টাকা দিলেও কম হতো। তারপরেও দেশের কোথাও কোনো শিক্ষক, গবেষক, বুদ্ধিজীবী, আমলা, সচেতন ব্যবসায়ী প্রতিবাদ করল না।
বিজ্ঞাপন
এই এক চিমটি লবণ, এক মুঠ গুড় ও আধা সের পানি দিয়ে স্যালাইন তৈরির ফর্মুলার মতো শিক্ষায় বরাদ্দ দিলে শিক্ষার ডায়রিয়া সরানো মার্কা শিক্ষাই হবে। একটি উন্নত শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করতে চাইলে পৃথিবীতে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেমন থাকে, যেভাবে খাওয়াদাওয়া করে, যেমন পরিবেশ পায় তেমন সুযোগ সুবিধা দেওয়ার বিকল্প নেই।
আরও পড়ুন >>> সৃজনশীল ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা কেন জরুরি?
চুরি-দুর্নীতি আর পাচারের জন্য টাকার কোনো অভাব নেই। বছর বছর বিভিন্ন প্রজেক্টের খরচ বাড়াতে কোনো কার্পণ্য নেই। দুনিয়ার কার্পণ্য এসে ভর করে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বললেই।
একটি দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার জন্য আবাসিক হলে একটা পড়ার টেবিল পায় না, একা একটা বিছানায় ঘুমানোর জন্য বিছানা পায় না, লাইব্রেরিতে পড়ার জন্য বসার জায়গা পায় না সেটা দেশের আপামর মানুষ মেনে নেয় কীভাবে?
চুরি-দুর্নীতি আর পাচারের জন্য টাকার কোনো অভাব নেই। বছর বছর বিভিন্ন প্রজেক্টের খরচ বাড়াতে কোনো কার্পণ্য নেই। দুনিয়ার কার্পণ্য এসে ভর করে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বললেই।
এই সমস্যা জিইয়ে রেখে সরকার কীভাবে স্যাটেলাইট পাঠায়, ভবন বানায়? তারপর তো এদের ক্ষমতার গুটি হিসেবে ব্যবহার আছেই। শুধুই কি ছাত্ররা, শিক্ষকরাও ন্যূনতম সম্মান পায় না, গবেষণার ভালো সুযোগ পায় না। শিক্ষকদেরও নোংরা রাজনীতিতে চুবিয়ে রাখে স্বয়ং সরকার আর প্রশাসন।
সরকার এইবার প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী পূর্ণ বিশাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কত টাকা বাজেট দিয়েছে জানেন? মাত্র ৮৫৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা এবং ২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের জন্য গবেষণা খাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়েছে ১৫ কোটি টাকা।
২০২২ সালে সরকার ইউজিসির মাধ্যমে দিয়েছিল মাত্র ৭৮১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এইবার ৭০ কোটি টাকা বেশি দিয়েছে। অথচ ডলারের দাম বেড়েছে, জিনিসপত্রের দাম দ্বিগুণের বেশি হয়েছে কিন্তু বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে সামান্য।
আরও পড়ুন >>> বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ কেন উন্নত হচ্ছে না?
একটা দেশের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বাজেট মাত্র ১৫ কোটি টাকা! বিশ্বের মানুষের কাছে এই কথা বললে সবাই হাসাহাসি করবে। বিশ্বের কোন দেশ কতটা প্রভাবশালী এর সাথে গবেষণার সম্পর্ক খুবই নিবিড়। যেই মুহূর্তে চীন আমেরিকা বেশি ভালো মানের গবেষণা করে প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাবে সেইদিন থেকে চীনই হবে বিশ্বের এক নম্বর প্রভাবশালী দেশ। আইআইটি খড়গপুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ ভাগের ১ ভাগ। ২০২২ সালে সেই প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দ ছিল ৮৩০ কোটি টাকা। শুধু এইটুকু বিবেচনায় নিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বরাদ্দ হওয়া উচিত ছিল ন্যূনতম ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
শুধু নতুন বিশ্ববিদ্যালয় না বানিয়ে বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বেশি করে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে এইগুলো কীভাবে মানসম্মত করা যায় আমাদের সেই দিকে নজর দেওয়া উচিত।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান বৃদ্ধি করতে চাইলে উচ্চমানের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। তার জন্য দরকার উচ্চমানের বেতন। ন্যূনতম ভারতের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপকদের বেতনের সম পরিমাণ স্কেল দিলেও কিছুটা হয়। যদিও আমাদের দেশের দ্রব্যমূল্য বিবেচনায় নিলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আরও বেশি বেতন দেওয়া উচিত।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি করে গবেষণা করতে সক্ষম শিক্ষকদের নিয়োগ জরুরি এবং তাদের প্রমোশন নীতিমালা বিশ্বমানের করা উচিত। সাথে বিদেশি পোস্ট-ডক নিয়োগ দিলে দেখবেন ক্যাম্পাসের চেহারা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এইসব করতে হলে বাজেট বরাদ্দ কয়েকগুণ বৃদ্ধি করতে হবে।
দুঃখের বিষয়, এইসব নিয়ে কোনো আলোচনা নেই, নেই কোনো সমালোচনাও। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অর্থে-বিত্তে, পদ পদবীতে এবং ক্ষমতায় সুখে আছে কারা? ভালো শিক্ষকরা? কে দ্রুত প্রমোশন পায়? কে বড় বড় প্রশাসনিক ও একাডেমিক পদ পায়? ভালো শিক্ষকরা? নাকি শিক্ষক হিসেবে যে যত খারাপ, ফাঁকিবাজ সে তত বেশি সুখে থাকে?
খারাপ শিক্ষকদের চেলার অভাব নেই। প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শক্তিশালী মাফিয়া চক্র আছে। আর এদের পেছনের শক্তি হলো বড় দুটি দল। এই দুটি দল মিলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত হতে দিচ্ছে না। অবস্থা এখন এমন যে, বেশি বেশি বিশ্ববিদ্যালয় মানে বেশি বেশি তোষামোদকারী, বিনা পারিশ্রমিকে বেশি বেশি দলান্ধ শ্রমিক।
আরও পড়ুন >>> বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং ও বিজ্ঞান শিক্ষার মান
কী শিক্ষক, কী ছাত্র এরা কেবল নিজের লাভটা বোঝে। তাদের রাজনীতির পেছনে কোনো আদর্শ নেই। তারা কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানে না। সাধারণ শিক্ষার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা তারা দেখে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেজ যারা নষ্ট করে তারাই বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান। বড় দুটি দলে তারাই বেশি মর্যাদাবান। তো এই দেশে ভালো মানুষ তৈরি হবে কোথায় এবং কেমন করে?
আইআইটি খড়গপুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ ভাগের ১ ভাগ। ২০২২ সালে সেই প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দ ছিল ৮৩০ কোটি টাকা। শুধু এইটুকু বিবেচনায় নিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বরাদ্দ হওয়া উচিত ছিল ন্যূনতম ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কিছু প্রজেক্ট হয়েছে। সেই প্রজেক্টের ফলাফলগুলো থেকে শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষকদের মূল্যায়নের একটা সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত এটি বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ দেখছি না। হয়তো কোনো দিন বাস্তবায়িত হবে না।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে বেনামি শিক্ষক মূল্যায়নের কথা বলে আসছি। আমি লক্ষ করেছি যারা খারাপ শিক্ষক, খারাপ গবেষক এবং একই সাথে ফাঁকিবাজ তারা নানা অজুহাত দাঁড় করায় যেন এটি করা না হয়। আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যেহেতু এই খারাপদের সংখ্যা বেশি এবং সিদ্ধান্ত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে, তাই কোনো ভালো প্রস্তাবই ধোপে টিকে না।
আরও পড়ুন >>> বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি কতটা যৌক্তিক?
খারাপ শিক্ষকদের কাজ হলো প্রমোশন নীতিমালা শিথিল করা। যার ফলে আজ থেকে ১০০ বছর আগে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতো শিক্ষকের অধ্যাপক পদে প্রমোশন পেতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তির সুপারিশ পত্র দিতে হয়েছে। তখন শিক্ষকদের কার্যকরী বেতনও বেশি ছিল আবার প্রমোশন পাওয়াও কঠিন ছিল।
প্রমোশনকে সহজ করার জন্য সবচেয়ে খারাপ যেই কাজটি করা হয়েছে সেটি হলো নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্নাল প্রকাশ করে প্রোমোশনের জন্য প্রয়োজনীয় আর্টিকেল প্রোডাকশনের ইন্ডাস্ট্রি বানানো। এর ফলে স্বল্প পরিশ্রমে কিছু একটা করে প্রোমোশনের জন্য ন্যূনতম যতগুলো লাগে ততগুলো প্রকাশ করে অধ্যাপক হয়ে যাচ্ছে।
পৃথিবীর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পাওয়া যাবে না, যেখানে তার শিক্ষকরা তাদের নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালে আর্টিকেল প্রকাশ করে প্রমোশন পাচ্ছে? এসব যদি বন্ধ না হয় তবে শিক্ষার মান উন্নত হবে না।
ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়