সংস্কৃতির দখিনা হাওয়া
ঘর থেকে দুই’পা শুধু নয়, দেহ মন বাইরে রেখে বেঁচে চলা মানুষ আমি। ঘর সুন্দর। ঘরের মানুষেরা সুন্দর বলেই। অন্দরের এই সুন্দরকে দেখার চোখ তৈরি করে দেয় বাহির। তাই উঠান পথ, আমার প্রিয়। পথে নামতে ছুতো খুঁজি। সাম্রাজ্য জুড়ে কত কিছুরই তো অভাব। শুধু নেই ছুতোর কমতি। তাই ছুতো একটা বগলবন্দি করে নেমে পড়ে পথে।
ঋতু ঘড়ি দেখে, একেকবার একেক পথ ধরি। শুধু কি পথ দেখি, মুগ্ধ হই খাল-নদীর জল, পাট নিংড়ানো, ধান মাড়াই, মহিষের চোখ, ফিঙের আহ্বান, পুরোনো কোনো পাকুড় বা মেঘ শিরিষ, ভেঙে যাওয়া ঘাট-হাটে? না, ওখানেই শেষ হয় না মুগ্ধতার দিগন্ত। মানুষ না দেখলে অপূর্ণ রয়ে যায় সুন্দরের স্বাদ। আমি মানুষ দেখি। মানুষের বদলে যাওয়া দেখি। তার যাপনের বদলে যাওয়ার ইতিহাসই তো জনপদ, রাষ্ট্র এবং পৃথিবীর ইতিহাস।
বিজ্ঞাপন
শহর, গঞ্জ, গ্রামে গিয়ে আমি ওখানকার ভোর, দুপুর, বিকেল, গোধূলি এবং রাত দেখি। এই পাঁচের উদযাপনে বোঝা যায় ওখানকার মানুষদের। আঁচ পাওয়া যায় তাদের বদলে যাওয়ার। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখি মা এবং সন্তানদের। তাকাই তরুণ-তরুণীদের চোখে। ঐ চোখে ছায়া পড়ে জনপদের স্থিরতা ও অস্থিরতার।
আরও পড়ুন >>> বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন
অলিগলি ঘুরে বাড়ির উঠান। জানালা-দরজা। বারান্দা। কাপড় শুকোতে দেওয়ার নকশা মিলিয়ে নেই। আগের দেখার চেয়ে বদলে গেল কতটা। একদমই ভুল হয় না চলাচলের বাহন, বাজার বিশেষ করে চায়ের স্টল এবং খাবারের দোকানের দিকে তাকাতে। ঐ জনপদের সংস্কৃতি কতটা বদলে গেল তার নির্দেশনা দেয় খাদ্যাভ্যাস। এবং অবশ্যই জনপদের মানুষের প্রার্থনার নিমগ্নতা।
পথ ভুল পূর্বাভাস দেয় না। দশক দুই আগে থেকেই দূরবর্তী সতর্ক সংকেত দিয়ে আসছিল-বদলে যাচ্ছে কী? পথ আমার মনোযোগ সংস্কৃতির দিকেই ঘনীভূত করার নির্দেশনা দিয়ে আসছিল। আমি পূর্বাভাস মেনে পর্যবেক্ষণ করে পথ চলেছি। কান বলছিল সুর বদলে যাচ্ছে গ্রাম, গঞ্জ, শহর।
খাবারে এসেছে পাশ্চাত্যের উপকরণ। পোশাকেও সংশয়। ধর্ম নাকি আধুনিকতা, কোন পথে যাবে? ধর্মকে ভোটে ব্যবহার, সমাজকে বিভক্ত করার হাতিয়ার বানাতে গিয়ে ধর্মের সহজ ও সুন্দর রূপ অন্ধ রূপ দেওয়া হয়েছে সব বিশ্বাসেই।
যেভাবে আজান, শঙ্খ, হারমোনিয়ামের কোরাস সুরে ভোর হতো, সেই ভোর এখন কুয়শাচ্ছন্ন। এজন্যই কুয়াশাচ্ছন্ন মানুষ নিজেই হারিয়ে বসে আছে তার গন্তব্যের সাকিন। তারা জানেন না কোন ঠিকানায় রওনা হয়েছেন। একই রঙ সকাল, দুপুর, বিকেল, গোধূলি এবং রাতের।
খাবারে এসেছে পাশ্চাত্যের উপকরণ। পোশাকেও সংশয়। ধর্ম নাকি আধুনিকতা, কোন পথে যাবে? ধর্মকে ভোটে ব্যবহার, সমাজকে বিভক্ত করার হাতিয়ার বানাতে গিয়ে ধর্মের সহজ ও সুন্দর রূপ অন্ধ রূপ দেওয়া হয়েছে সব বিশ্বাসেই।
কট্টর মূর্তি নিয়ে আর্বিভাব হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, ঘটছে প্রায়ই। তারই প্রভাবে সমাজে বিশ্বাসীরা প্রার্থনাকে একান্তে রাখার চেয়ে প্রদর্শনে নিয়ে যাচ্ছেন বেশি। এর বাহ্যিক রূপটি পরিধান ও অবয়বে দেখা দিয়েছে।
আরও পড়ুন >>> সত্যেন সেন : মেহনতি মানুষের মুক্তিসংগ্রামের তূর্যবাদক
সংস্কৃতি চর্চা-গান, নাচ, নাটক, আবৃত্তি, ছবি আঁকার মতো বিষয়গুলোর চর্চা ও অনুশীলন রাখা হতো ব্যক্তিগত ধর্মীয় চর্চার বাইরে। সেই অনুশীলন ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কেন্দ্র। যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে ঈর্ষা করেন, তারা সেই কেন্দ্রেই আঘাত হানতে থাকেন।
যাত্রা, নাটকে বাধা দেওয়ার পাশাপাশি পুতুল নাচ, কবিগানের আসর কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ সেই। আঘাতের দুঃসাহস এতটা সীমা পেরিয়ে যায়—ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ একাডেমি দুইবার পোড়ানো হয়। পূর্বাভাস ছিল আগেই—শামসুর রাহমান, হুমায়ুন আজাদকে নিষিদ্ধ করা। আল মাহমুদকে ‘জল্লা’য় ফেলে দেওয়া।
ধারাবাহিকতায় আমরা শুধু ভয়ই পেয়ে যাচ্ছি। তাই পাঠ্যপুস্তক থেকে সরিয়ে দিচ্ছি শ্রেষ্ঠ ও অনিবার্য পাঠ। এর দূষিত বায়ুই কিন্তু পথে ঘূর্ণি রূপ ধারণ করে আছে।
পথে প্রান্তরে ঘুরে দেখলাম সংস্কৃতি চর্চা এখন আর অনুশীলনে নেই। জীবন-যাপনের অংশী হিসেবে নেই। যতটুকু আছে তা বিভিন্ন দিবসে সরকার—বেসরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চে ঠাঁই পাওয়া, টিভি চ্যানেলের ক্যামেরার নজরে আসা, এর কোনোটিই না হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেকে নিজের সঁপে দেওয়া। এবং এই চর্চা শিল্পকলা একাডেমিকেন্দ্রিক।
এক সময়ের দাপুটে সংগঠনগুলোর কোনো কোনো জায়গায় আলো একেবারেই নিভে গেছে। কোথাও কোথাও কুপির সলতেতে এক রত্তি আলো লেগে আছে মাত্র। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে নাটক চর্চা নেই। অন্যান্য সৃজনশীল মাধ্যমগুলো নিয়েও অভিভাবকরা ভাবছেন না।
আরও পড়ুন >>> সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা : চেতনা জাগুক মনে
ছোট ছোট কিছু সংগঠন শিল্পকলা একাডেমির ভাড়া দিতে পারছে না বলে, অনুশীলনের জায়গা খুঁজে পায় না। তাই তাদের অনুশীলন হয়ে পড়েছে অনিয়মিত। আর্থিক টানাপোড়ন যেমন সংগঠনে, তেমনি ব্যক্তিজীবনেও। আর্থিক প্রণোদনা ছাড়া এই অনুশীলনে নিজেদের নিবেদিত রাখাটাও এখন মুশকিল।
ছোট ছোট কিছু সংগঠন শিল্পকলা একাডেমির ভাড়া দিতে পারছে না বলে, অনুশীলনের জায়গা খুঁজে পায় না। তাই তাদের অনুশীলন হয়ে পড়েছে অনিয়মিত। আর্থিক টানাপোড়ন যেমন সংগঠনে, তেমনি ব্যক্তিজীবনেও।
সবাই ছুটছে চাকরি বা রোজগারের বাজারে। কোথাও কিছু না হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু তুলে দিলেও যেখানে আয় হচ্ছে, সেখানে সংগঠনে কেন সময়ের অপচয়?
শহর ঘুরি আর দেখি কেমন বদলে গেছে শিল্পকলা একাডেমি। মুগ্ধ। কারণ, শিল্পকলা একাডেমি আধুনিকভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। সুযোগ-সুবিধা, বিশেষ করে প্রযুক্তিবান্ধব ভবন তৈরি হয়েছে। কিন্তু মন খারাপের কারণ হলো—শিল্পকলাকেন্দ্রিক যে তরুণ তরুণীদের আড্ডা দেখি, তারা সংস্কৃতি চর্চা থেকে দূরে।
ভবনের সৌন্দর্য অবলম্বন করে ছবি তুলতে ও ব্যক্তিগত হই-হুল্লোড় করতে আসছে। শিল্পকলার আয়োজনের কোনো অনুষ্ঠানে তারা উঁকিও দিচ্ছে না। রবীন্দ্র-নজরুল জন্ম-মৃত্যুর বাইরে রাজনৈতিক ও দাপ্তরিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্যই একাডেমির অডিটোরিয়ামের ব্যবহার বেশি।
আরও পড়ুন >>> তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?
অনুশীলন কক্ষ ভাড়া নেবে, ব্যবহার করবে এমন সংগঠনও কোনো কোনো শহরে দুর্লভ। তাহলে সংস্কৃতিখাতে জাতীয় বাজেটে যেটুকু বরাদ্দ জোটে তার হয়তো বেশিরভাগই ভবন তৈরি, কর্তা ও রাজনীতি ঘেঁষে প্রশিক্ষকদের বিদেশ ভ্রমণে খরচ হচ্ছে। কিন্তু খরচের জায়গাটা মনে হয় এখন হওয়া দরকার নিবেদিত সংগঠন ও কর্মীদের ওপর। তাদের ইচ্ছে ও লড়াইকে বাঁচিয়ে না রাখলে সংস্কৃতির অবনমন আরও ত্বরান্বিত হবে। ফলে শহরে শহরে ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, কিশোর গ্যাং, মাদকের মতো দূষণ বাড়তেই থাকবে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে সংস্কৃতিখাত বরাদ্দ পেয়েছিল ৬শ ৩৭ কোটি টাকা। আগের বছরের চেয়ে ৫৮ কোটি টাকা বেশি। এবারের নানা টানাপোড়ন ও হিসাব নিকাশের বছরে কমার শঙ্কা করি। কত বাড়লো বা কমলো, তারচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-প্রাপ্তিযোগের টাকা ইট পাথর রডে খরচ হলো নাকি খরচ হবে-যাত্রা, নাটক, লোক গান বাঁচিয়ে রাখতে এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন গুলোকে অক্সিজেন দিতে। পথে কার্বন ডাই অক্সাইড বাড়ছে, বাড়ছে তাপদাহ। তা থেকে প্রশান্তি দিতে পারে একমাত্র-সংস্কৃতির সুন্দর দখিনা হাওয়া।
তুষার আবদুল্লাহ ।। গণমাধ্যমকর্মী