মোদি বিরোধিতা ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত সরকার, ভারতীয় মিত্রবাহিনী, সর্বোপরি ভারতীয় জনগণ যে অবদান রেখেছে, তা বাংলাদেশ কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। ভারতে শরণার্থী আশ্রয় ও আহার দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ও অস্ত্র দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতীয় সৈন্যরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে বাংলাদেশের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। শুধুমাত্র যুদ্ধে সহযোগিতা করেই দায়িত্ব শেষ করেনি।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে নগদ অর্থ ও খাদ্য সহায়তা দিয়েও পাশে দাঁড়িয়েছিল। সেই বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অতিথি থাকবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। এখানে নরেন্দ্র মোদি তো কোনো ব্যক্তি নয়, তিনি ১৩০ কোটি ভারতবাসীর প্রতিনিধি। তার মাধ্যমেই গোটা ভারতবাসীকে সম্মান জানানো হবে। আরও একটি কারণে এ সফরটি গুরুত্বপূর্ণ। এ বছরটি বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কেরও সুবর্ণজয়ন্তী।
বিজ্ঞাপন
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করে কিছু চিহ্নিত মৌলবাদী, তথাকথিত বাম সংগঠন ও স্বঘোষিত সুশীল নামধারী বিএনপি জামায়াতের এজেন্টরা বিরোধিতা ও প্রতিহত করার আন্দোলনে নেমেছে। এদের পেছনে যে বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধন ও অর্থায়ন আছে, সেটা তো দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এই বিরোধিতাকারীরা কারা? তাদেরকে বাংলার জনগণ চেনে। তাদের মুরুব্বিরা বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকে বলেছিল ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ। তারা বাংলাদেশের অস্তিত্বকে কখনো স্বীকার করে না। তারা ২১ ফেব্রুয়ারি, ৭ মার্চ, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর মানে না, আবার তাদেরই অনেকে লোক দেখানো মানলেও হৃদয়ে ধারণ করে না। তারা বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করে। তারা ভাস্কর্য বিরোধিতার নামে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বঙ্গবন্ধুকে বুড়িগঙ্গায় ছুড়ে ফেলার হুমকি দেয়। তারা কথায় কথায় দেশরত্ন শেখ হাসিনা ও বর্তমান সরকারের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে। যারা ভারতের বিরোধিতা করে রাজনীতির মাঠ গরম করে ফায়দা লোটে, তারাই তো নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা করবে সেটাই তো স্বাভাবিক।
নরেন্দ্র মোদি তো কোনো ব্যক্তি নয়, তিনি ১৩০ কোটি ভারতবাসীর প্রতিনিধি। তার মাধ্যমেই গোটা ভারতবাসীকে সম্মান জানানো হবে। আরও একটি কারণে এ সফরটি গুরুত্বপূর্ণ। এ বছরটি বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কেরও সুবর্ণজয়ন্তী।
এত বরেণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে নরেন্দ্র মোদিকে কেন টার্গেট করা হলো? ধর্মের জুজু তুলে বলা হচ্ছে, মোদি ইসলামের শত্রু। তিনি যদি প্রকৃতই ইসলামের শত্রুই হতেন তাহলে কি মুসলিম প্রধান দেশগুলো তাকে কখনো সম্মানিত করতেন? এ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদিকে বাহরাইন থেকে ‘কিং হামাদ অর্ডার অব রেনেসাঁ’, সংযুক্ত আরব থেকে ‘অর্ডার অব জায়েদ’, ফিলিস্তান থেকে ‘গ্র্যান্ড কলার অব স্টেট অব প্যালেস্টাইন’, আফগানিস্তান থেকে ‘আমির আমানুল্লা খান পুরস্কার’, সৌদি আরবের ‘কিং আবদুল্লাজিজ সাশ পুরস্কার’ এবং মালদ্বীপের ‘রুল অব নিশান ইজ্জুদ্দিন পুরস্কার’ সহ মর্যাদাপূর্ণ সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। তাহলে এই বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্য ভিন্ন, সেটা দিবালোকের মতোই স্পষ্ট।
বিএনপি মহাসচিব সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বরাবরের মতোই নতুন তত্ত্ব হাজির করেছেন, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের জন্যই নাকি মোদির এই সফর। এটা যে কত বড় মিথ্যাচার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ গত বছরের এই অনুষ্ঠানেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে আসার কথা ছিল, কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে অনুষ্ঠান স্থগিত হওয়ায় সফরও স্থগিত হয়েছিল। তখন তো কোনো নির্বাচন ছিল না। গণমাধ্যমে তো সংবাদ এসেছে, মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য বিএনপি চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সাক্ষাতের সুযোগ না পাওয়ায় এখন এইসব উল্টাপাল্টা মন্তব্য করছে।
২০১৪ সালে ভারতে যখন নরেন্দ্র মোদি প্রথম ক্ষমতায় এসেছিল তখন উল্লাস করে কারা রাস্তায় মিষ্টি বিতরণ করেছিল, কারা অমিত শাহের নামে ভুয়া টেলিফোনের নাটক করেছিল, সে কথা কিন্তু জনগণ ভুলে যায়নি। যখন ভারত থেকে করোনার ভ্যাকসিন আনার সিদ্ধান্ত হলো তখন এই বিএনপি-জামায়াতের এজেন্টরা বলতে শুরু করল এই ভ্যাকসিনে সমস্যা আছে, কেউ নেবেন না। আরও কত ধরনের বাজে অপপ্রচার। আবার যখন ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হলো তখন সবার আগে লাইন ধরে ভ্যাকসিন নিয়ে নিলো। এসব ভণ্ডকে জনগণ বিশ্বাস করে না।
যারা ভারতের বিরোধিতা করে রাজনীতির মাঠ গরম করে ফায়দা লোটে, তারাই তো নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা করবে সেটাই তো স্বাভাবিক।
নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে এলে একটা চমক থাকে। ২০১৫ সালে যখন তিনি ঢাকা সফর করেন তখন ঘোষণা দিয়েছিলেন স্থল সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির এবং সেটি দ্রুত কার্যকরের ফলে ৬৮ বছরের ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো যুদ্ধ ছাড়া এমনভাবে কখনো সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি হয়নি। এবারের সফরের আগে ২০২০ সালের গান্ধী পুরস্কারের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করে পুরো বাংলাদেশের মানুষেরই মন জয় করে ফেললেন নরেন্দ্র মোদি।
গান্ধী পুরস্কারের জন্য বিচারকমণ্ডলীর প্রধান হলেন নরেন্দ্র মোদি নিজেই। তিনিই এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে বাংলাদেশের জাতির পিতার প্রতি ভারতের এই সম্মান প্রদর্শনের ঘোষণা দেন। এ ঘোষণা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উদযাপনকালে এ সম্মান নিঃসন্দেহে আরও আনন্দ বয়ে আনবে। এছাড়া বাংলাদেশকে ১০৯টি ভেন্টিলেশন সুবিধা সংবলিত অ্যাম্বুলেন্স উপহার দিচ্ছে ভারত। করোনাকালে এই ধরনের অ্যাম্বুলেন্স বাংলাদেশের জনগণের খুব উপকারে আসবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ২০১৫ সালে ঢাকা সফর, ২০১৭ ও ২০১৯ সালে দেশরত্ন শেখ হাসিনার দিল্লি সফর এবং ২০২০-২০২১ সালে দুই নেতার একাধিক ভার্চুয়াল বৈঠকে অনেক অমীমাংসিত বিষয় নিষ্পত্তি হয়েছে। পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মাইলফলক তৈরি হয়েছে। মোদি বিরোধিতার নামে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ফাটল ধরানোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে। ঠুনকো মিথ্যা ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করে যারা এই সম্পর্ককে বিনষ্ট করতে চায়, সেই চিহ্নিত ষড়যন্ত্রকারীদের অপচেষ্টা কখনো সফল হবে না।
তাপস হালদার ।। সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা