ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ : বঙ্গোপসাগরে নয়, ঝড় তুলছে কফির কাপে
মোখা (Mokha) বা মোচা (Mocha), ইয়েমেনের লোহিত সাগর উপকূলের একটি বন্দর শহর। উনিশ শতকে এডেন এবং আল হুদায়দাহ এটি গ্রহণ না করা পর্যন্ত, মোখা ছিল ইয়েমেনের রাজধানী সানার প্রধান বন্দর। দীর্ঘদিন ধরে কফি ব্যবসার জন্য পরিচিত ছিল এই বন্দর। তাই শহরের নাম দেওয়া হয়েছে মোচা কফি। স্থানভেদে একে ‘মোচা’ বা ‘মোখা’ বলা হয়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ আরও শক্তি সঞ্চয় করে বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে। এটি চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ওপর দিয়ে স্থলভাগে আঘাত হানতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় মানুষ গোটা পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় আনতে সক্ষম হলেও মানবজাতির বৈজ্ঞানিক সক্ষমতা স্থবির হয়ে যায় প্রকৃতির রূঢ় আচরণের কাছে।
আরও পড়ুন >>> ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং : প্রস্তুতি ও মোকাবিলা জরুরি
আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কল্যাণে মানুষ হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া থেকে থেকে সাগর মহাসাগরের সীমাহীন জলরাশির তলদেশ দমিয়ে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ শেষে যখন মঙ্গল গ্রহে বসবাসের চিন্তায় দিশেহারা ঠিক তখনো নিজ পৃথিবীর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে রক্ষা ও উদ্ধারের সঠিক পদ্ধতি তৈরিতে পুরোপুরি সফল নয় বিজ্ঞানীরা। পৃথিবী তার নিজ কক্ষপথে নিজের খেয়ালেই চলছে।
ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্র উপকূলের দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়প্রবণ দেশ। বাংলাদেশের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রাণহানিও নেহাত কম নয়। প্রাণহানি ছাড়াও ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এলাকার মানুষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়।
বাংলাদেশ ও সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এলাকাটির আকৃতি ফানেলের আকৃতি হওয়ার কারণে বঙ্গোপসাগর থেকে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সমুদ্র তীরবর্তী জেলা; কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও ভোলাতে সবচেয়ে বেশি।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় মানুষ গোটা পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় আনতে সক্ষম হলেও মানবজাতির বৈজ্ঞানিক সক্ষমতা স্থবির হয়ে যায় প্রকৃতির রূঢ় আচরণের কাছে।
দক্ষিণ আটলান্টিক ও দক্ষিণ পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগর ছাড়া বাকি সব গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সমুদ্র অঞ্চলে প্রায়ই ভয়ানক বায়ুমণ্ডলীয় দুর্যোগের সৃষ্টি হয়। এগুলোর মধ্যে কিছু কিছু ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। ঘূর্ণিঝড়ঘটিত জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে চন্দ্র সূর্যের আকর্ষণ যোগ হলে জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতা আরও বেড়ে গিয়ে ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণ আন্দামান সাগর এলাকায় অবস্থানরত লঘুচাপটি ঘনীভূত হয়ে সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়েছে। এটি আরও ঘনীভূত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড়টি অতি শক্তিশালী হয়ে রবিবার (১৪ মে ২০২৩) বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং মিয়ানমারের কিয়াপপু এলাকায় আঘাত হানবে।
আরও পড়ুন >>> আধিপত্য নয়, বন্ধুত্ব করি প্রকৃতির সঙ্গে
বাংলাদেশের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও আবহাওয়া অধিদপ্তরের আর্থিক জোগান ও সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। তাই আগে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হলেও, কয়েক দশক ধরে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ কমে এসেছে। তবে মাঝে মাঝেই অপ্রতিরোধ্য প্রকৃতির কাছে হার মেনে যায় মানুষ।
ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ কীভাবে হয়, সেই ধারণা অনেকেরই নেই। ২০০০ সালের আগে এই অঞ্চলে যত ঘূর্ণিঝড় হয়েছে তার কিন্তু কোনো নাম নেই। কারণ ২০০০ সালের আগে এখানে ঘূর্ণিঝড়ের কোনো নাম দেওয়া হতো না। কিন্তু এরপর থেকে ঝড়ের নামকরণ শুরু হয়। ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়ার রীতি চালু করে ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (World Meteorological Organization-WMO) ও ইউনাইটেড নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য পেসিফিক (United Nations Economic and Social Commission for Asia and the Pacific-ESCAP)-এর সদস্য দেশগুলো।
ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের অধীনে জাতিসংঘের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমুদ্র তীরবর্তী ১৩টি দেশের আবহাওয়াবিদদের সংস্থা এস্কেপ ঘূর্ণিঝড়ের নাম দিয়ে থাকে। নাম ঠিক করার সময় বেশকিছু বিষয় মাথায় রাখতে হয় যেমন কোনো সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে আঘাত করে এমন কোনো নাম গৃহীত হবে না।
একবার ব্যবহার করা নাম আর ব্যবহার করা যাবে না। প্রতিটি দেশ আলাদাভাবে নাম প্রস্তাব করার সুযোগ পায়। এই ১৩টি দেশের কাছে আগাম পূর্বাভাস ও সতর্কবার্তা পাঠানো হয়। নামের সিরিয়াল অনুযায়ী এবার বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হলে তার নাম হওয়ার কথা ছিল 'মোখা’। আর তাই এই বছর ঝড়ের নাম হয়েছে 'মোখা’।
আরব সাগরের তীরবর্তী দেশ ইয়েমেনের দেওয়া নাম হলো 'মোখা’। ইয়েমেনের মোখা কফি বিখ্যাত এবং শহরের একটি পুরোনো বন্দর হলো মোখা। যে বন্দর দিয়ে কফির ব্যবসা সারা বিশ্বে সম্প্রসারিত হয়েছে।
আরও পড়ুন >>> জলবায়ু পরিবর্তন : তলিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশের ১৩ শতাংশ ভূমি
জানা যায়, ৫০০ বছর আগে এই অঞ্চলই ছিল আধুনিক বিশ্বের কফির প্রচলনকারী প্রথম স্থান। এই কফির নাম অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়ের নাম 'মোখা’। বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরে পরবর্তী যে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হবে তার নাম হবে ‘বিপর্যয়’। আর এটির নামকরণ করেছে বাংলাদেশ।
আরব সাগরের তীরবর্তী দেশ ইয়েমেনের দেওয়া নাম হলো 'মোখা’। ইয়েমেনের মোখা কফি বিখ্যাত এবং শহরের একটি পুরোনো বন্দর হলো মোখা। যে বন্দর দিয়ে কফির ব্যবসা সারা বিশ্বে সম্প্রসারিত হয়েছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ অনেকটাই সফলতা অর্জন করেছে বলে আমরা বিগত সময়গুলোয় দেখেছি। ‘মোখা’ মোকাবিলায় কক্সবাজারের ইনানীতে অবস্থিত নৌবাহিনী জেটি ও তৎসংলগ্ন এলাকায় ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী উপকূলীয় জেলে ও স্থানীয়দের দ্রুততম সময়ে উদ্ধার, প্রয়োজনীয় ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
পাশাপাশি সমুদ্র ও উপকূলীয় এলাকায় নিয়োজিত নৌবাহিনী যুদ্ধজাহাজসমূহে প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সহায়তা সচল রাখার জন্য মহড়াও করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি-সিপিপি (Cyclone Preparedness Programm-CPP)-কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রস্তুতি নিতে এবং সতর্কবার্তা প্রচার করতে। তারা ইতিমধ্যে প্রচারণা শুরু করেছে। জেলা পর্যায়ের আশ্রয় কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে।
আরও পড়ুন >>> বিশ্ব পরিবেশ দিবস : আমাদের ব্যর্থতা ও করণীয়
বাংলাদেশে আঘাত হানা বড় ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে বেশিরভাগই হয়েছিল মে মাসে। এই সময়ের ঘূর্ণিঝড়ের তীব্র গতিবেগ থাকতে পারে। তাই এই বিষয়ে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে এবং ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকতে হবে।
আমরা বিশ্বাস করি ‘মোখা’ বড় ধরনের আঘাত হানবে না। তবে ঝুঁকিতে থাকা এলাকার জনসাধারণের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলার জন্য সব রকম প্রস্তুতি থাকা বাঞ্ছনীয়।
ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ, গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
professorkabirul@gmail.com