ছবি : সংগৃহীত

১৮৯০ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ডে যান সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। ওই বছরেরই অক্টোবর মাসে ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এসে শুরু হয় তার জীবনের নতুন অধ্যায়। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদেশে পূর্ব বাংলায় জমিদারি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন থেকেই সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, কুষ্টিয়ার শিলাইদহের পাশাপাশি জমিদারি দেখতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায়ই আসতেন নওগাঁর পতিসরে।

ভৌগলিক দিক থেকে পতিসরের অবস্থান বর্তমান নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলায়। ঈশ্বরদী-নাটোর-সান্তাহার-পার্বতীপুর রেল লাইনের ছোট্ট স্টেশন আহসানগঞ্জ। ব্রিটিশ শাসনামলে অবশ্য স্টেশনটির নাম ছিল আত্রাইঘাট নামে। এখনো লোকমুখে আত্রাই নামেই পরিচিত। আত্রাই নদীর পাড়ে বলেই সকলে এই নামেই চেনে।

অবশ্য পরবর্তীকালে এই অঞ্চলের একজন জমিদার আহসান উল্লাহ (১৮৭৬-১৯৩৯)-এর নামে স্টেশনের নামকরণ করা হয় আহসানগঞ্জ। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মিত হওয়ার পর কলকাতা থেকে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং এবং আসাম যাওয়ার রেলপথও ছিল এটা।

আরও পড়ুন >>> অস্থির সময়ে রবীন্দ্রনাথ কেন এত প্রাসঙ্গিক? 

এখান থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছারি বাড়ি পতিসরে যেতে হয়। দূরত্বও কম নয় রেল স্টেশন থেকে প্রায় বারো কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বদিকে নাগর নদীর তীরে এই কাছারি বাড়ির অবস্থান। আহসানগঞ্জ স্টেশন থেকে ঘণ্টা দেড়েকের মতো লাগে পতিসরে যেতে। কবিও কলকাতা থেকে ট্রেনে এসে এই স্টেশনেই নামতেন। এরপর তিনি তার বোটে করে নদীপথে চলে যেতেন পতিসরে।

২০২৩ সালেও নওগাঁর পতিসর এখনো সাদামাটা একটা গ্রামের মতো। অথচ কবিগুরু এখানে যাতায়াত শুরু করেছিলেন সেই ১৮৯১ সালের শুরুতেই। কবি অবশ্য প্রথমে এসেছিলেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থেকে। অজপাড়া গাঁ বলে কবি পতিসরকে দূরে ঠেলে দেননি।

এখানে এসেই স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে পত্রে লিখলেন, ‘আজ আমি কালীগ্রাম এসে পৌঁছালুম, তিনদিন লাগল। অনেক রকম জায়গার মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে। প্রথমে বড় নদী, তারপরে ছোট নদী, দুধারে গাছপালা, চমৎকার দেখতে...।’

পতিসরে যেতে এখনো রাস্তার দুই ধারের মাঠগুলোয় শুধু ধানের আবাদ করা হয়। চারিদিকে শুধু সবুজের সমারোহ। অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্য! এই কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই সময়ে চিঠিপত্রে এই নৈসর্গিক দৃশ্য ফুটে তুলতেন প্রিয়জনদের কাছে।

পতিসরের এই অঞ্চল এক সময়ে রাজশাহীর জমিদারদের জমিদারির অংশ ছিল। তখন এটা ছিল কালীগ্রাম পরগণা। অনেকগুলো গ্রাম একটা পরগণার অধীনে থাকতো। কালীগ্রাম পরগণার অধীনেও প্রায় ছয়শতের মতো গ্রাম ছিল।

পতিসর গ্রাম ছিল কালীগ্রাম পরগণার কাছারি বাড়ি। যাকে পতিসর কাছারি বাড়ি বলে সকলে চিনতো। এই এলাকার প্রজারা এখানেই বছরের খাজনা দিতে আসতো। তখন এখানে পুণ্যাহ অনুষ্ঠান হতো।

আরও পড়ুন >>> রবীন্দ্র ভাবনায় তারুণ্য 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে রাজশাহীর জমিদারদের খাজনা বকেয়া পড়ায় ব্রিটিশ সরকার কালীগ্রাম পরগণা নিলামে তোলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এই অংশ তার জমিদারিতে অন্তর্ভুক্ত করেন।

১৮৯১ সালে জমিদারির কর্তব্যে রবীন্দ্রনাথ পতিসরে আসা যাওয়া শুরু করলেন। প্রজাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এই প্রথম রবীন্দ্রনাথ তার সমগোত্রীয় লোকের বাইরের মানুষের নিকট সংস্পর্শে এলেন।

ভগ্নদশাগ্রস্ত সমাজ, গ্রামীণ জীবন প্রত্যক্ষ করলেন। যেমন ১৮৯৪ সালে যখন জমিদারির বিভিন্ন মহলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তখন দিঘাপতিয়া থেকে একখানি চিঠিতে এই অঞ্চলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কথা লিখলেন। ‘…প্রতি ঘরে ঘরে বাতে ধরেছে, পা ফুলছে সর্দি হচ্ছে, জ্বর হচ্ছে, পিলেওয়ালা ছেলেগুলো অবিশ্রাম ঘ্যানঘ্যান করে কাঁদছে, কিছুতেই তাদের বাঁচাতে পারছে না- একটা একটা করে মরে যাচ্ছে। এত অবহেলা, অস্বাস্থ্য অসৌন্দর্য দারিদ্র্য বর্বরতা মানুষের আবাস স্থলে কিছুতেই শোভা পায় না।’

১৮৯১ সালে উত্তরবঙ্গের জমিদারিতে এসে প্রজাদের দুর্দশা, গ্রাম বাংলার মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম তিনি দেখতে লাগলেন, বিচলিত হতে থাকলেন। প্রজাদের সঙ্গে সম্পর্কের এই দিকটা ধরা পড়ে তার অনেক লেখনীতে।

ধরা যাক, ইন্দিরাদেবীকে লেখা একটা চিঠির অংশ, যেখানে ধরা পড়েছে প্রজাবর্গের সম্পর্কে কবি-মনের এক অনবদ্য চিত্র। পতিসর থেকে লেখা এই চিঠিতে কবিগুরু  লিখছেন—‘এখানকার প্রজাদের উপর বাস্তবিক মনের স্নেহ উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। এদের কোনরকম কষ্ট দিতে আদতে ইচ্ছে করে না। (প্রজারা) যখন তুমি বলতে বলতে তুই বলে ওঠে, যখন আমাকে ধমকায়, তখন ভারি মিষ্টি লাগে।’

এই রকম আরেকটি চিঠি, যেখানে ইন্দিরাদেবীকে লিখছেন—‘আহা, এমন প্রজা আমি দেখিনি, এদের অকৃত্রিম ভালবাসা এবং এদের অসহ্য কষ্ট দেখলে আমার চোখে জল আসে। বাস্তবিক, এরা যেন আমার একটি দেশজোড়া বৃহৎ পরিবারের লোক।’

আরও পড়ুন >>> অস্ত্র ও ছলনার বিরুদ্ধে মানুষে আস্থা রবীন্দ্রনাথের

প্রজাদের দুর্দশা লাঘবের জন্য পরবর্তীতে শুধুমাত্র কৃষি কাজে ঋণ দেওয়ার জন্য ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেন ‘পতিসর কৃষি সমবায় ব্যাংক’। এই ব্যাংক স্বল্প সুদে গ্রামের গরিব চাষিদের মধ্যে ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে মহাজনদের কাছ থেকে প্রজাদের মুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। পতিসরেই  কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রজাদের উন্নতির জন্য এই প্রত্যন্ত এলাকায় ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষের ব্যবস্থা করেছিলেন।

পতিসর কাছারি বাড়ি বাংলাদেশের অন্য আট দশটা জমিদারবাড়ির মতো নয়। একটু বিদেশি স্টাইলের কেবিনের মতো কাছারিবাড়িটি চতুর্ভুজাকৃতি। সম্মুখেই সিংহ দরজা। এটা ভেদ করে মূল বাড়ির প্রাঙ্গণ।

মাঝে স্বল্প পরিসরের খোলা বারান্দা। সবগুলো দরজা জানালা সমান্তরাল। ফলে বাড়ির ভেতরে কোথাও কেউ থাকলে অন্য কক্ষ থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। প্রাঙ্গণকেন্দ্রিক বারান্দার তিনদিকেই ঘর। মাঝের বারান্দার সম্মুখভাগে বই হাতে দাঁড়ানো রবীন্দ্রনাথের একটি ভাস্কর্য। দেখে মনে হবে রবীন্দ্রনাথ মাথা উঁচু করে যেন দাঁড়িয়ে আছেন এবং প্রজাদের অভয়বাণী দিচ্ছেন।

কাছারি বাড়ির সংগ্রহশালা তেমনটা সমৃদ্ধ না হলেও বেশ গোছানো। এখানে রয়েছে কবির দেয়াল ঘড়ি, লোহার সিন্দুক, খাট, টি-টেবিল, টি-পট, আয়না, নাগর বোটের এ্যাংকর, ট্রাক্টরের ভগ্নাংশ, কবির বিভিন্ন বয়সের ছবি, ইজি চেয়ার, কবি প্রতিষ্ঠিত কৃষি ব্যাংকের ভল্ট বা লোহার সিন্দুক, কবির স্বহস্তে লেখা কয়েক পৃষ্ঠার চিঠিসহ নানান সামগ্রী।

দর্শনার্থীরা এখানে এসে কবির স্নানের বাথটাব দেখে বিস্মিত হয়! আজ থেকে একশ বছরের বেশি আগে কবি এখানে বাথটাবে স্নান করতেন।

পতিসরের সবখানেই লেগে আছে কবির ছোঁয়া। এই মাটিতে কবির পদযুগল বিচরণ করেছে। ধূলিকণায় লেগে আছে তার স্পর্শ। তবে পতিসরেই কবি নির্মাণ করেছিলেন কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউট। এটি একটি হাইস্কুল।

১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে রথীন্দ্রনাথের নামে হাইস্কুলটি প্রতিষ্ঠিত করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরষ্কারের প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে হাইস্কুলটি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর তার পুত্র রথীন্দ্রনাথ উত্তরাধিকার সূত্রে জমিদারির দায়িত্ব পান। তিনি ১৯৪৫ সালের দিকে দাম্পত্য সঙ্গী প্রতিমা দেবীসহ কালীগ্রামে আসেন। নিজের নামে নির্মিত ইনস্টিটিউশনের প্রতি তার টান ছিল। তিনি সেই সময়ে শিক্ষক-ছাত্রদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।

আরও পড়ুন >>> বিতর্কিত রবীন্দ্রনাথ? 

এখনো টালি দিয়ে ছাওয়া একটি মাটির ঘর সেখানে রয়েছে। মাটি এবং টালি দিয়েই স্কুলটি তৈরি হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত এই হাইস্কুল। স্কুলের শিক্ষকদের প্রথমদিকের সকলেই এসেছিলেন কলকাতা থেকে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন—বি এন রায়, ভবেশ চন্দ্র দত্ত চৌধুরী, হরিপদ কুন্ডু, গোপেশ চন্দ্র পঞ্চানন প্রমুখসহ আরও অনেকেই।

পতিসরে কাছারিবাড়ি সংলগ্ন পুকুর পাড়ে এই সব শিক্ষকদের থাকার জন্য অনেকগুলো ঘর তৈরি করা হয়েছিল। অযত্ন অবহেলায় সেগুলো এখনো কালের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর কলকাতা থেকে আর কোনো শিক্ষক এখানে আসেনি।

রবীন্দ্রনাথের দেওয়া আশীর্বাণী, চিঠি, প্রজাদের উদ্দেশ্যে দেওয়া তার শেষ বক্তৃতা, তার দেওয়া বিভিন্ন বই এই ইনস্টিটিউশনে সংগৃহীত করা আছে। এই প্রতিষ্ঠানে কালীগ্রামের শেষ জমিদার রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি, রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর চিঠিসহ রবীন্দ্রনাথের অনেক স্মৃতিস্মারক সংগ্রহ করা আছে।

পতিসর কাছারি বাড়ি থেকে একটু দূরেই ছোট্ট নদী নাগর নদের অবস্থান। এটি এক সময় করতোয়া নদীর অন্যতম শাখা নদী ছিল। রবীন্দ্রনাথের লেখায় এই ছোট্ট নদীর প্রাণ দেখতে পাওয়া যায়।

১৮৯১ সালে কবি নওগাঁর পতিসর থেকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। এই পত্রে করতোয়ার অন্যতম প্রধান শাখা নাগর নদের বর্ণনা রয়েছে। ‘ছোট নদীটি ঈষৎ বেঁকে এইখানে একটুখানি কোণের মতো, একটু কোলের মতো তৈরি করেছে—নৌকাওয়ালারা উত্তর দিক থেকে গুণ টেনে টেনে আসে, হঠাৎ একটা বাঁক ফিরেই এই জনহীন মাঠের ধারে অকারণে একটা মস্ত বোট বাঁধা দেখে আশ্চর্য হয়ে যায়।’

আরও পড়ুন >>> নতুন আলোয় জেগে উঠুক শিশুসাহিত্য

এই নদীর তীরেই কবি দেখেছেন লজ্জাশীলা ঘোমটা দেওয়া বধূ, কলসী কাঁখে তরুণী, বিবস্ত্র শিশু, তীর থেকে দূরে শস্য শূন্য মাঠ, রাখাল বালক এবং গরুর পাল। কবি এই নদী তীরেই দেখেছেন দুপুর বেলার নির্জনতা, নিস্তব্ধতা, উদাসীন আকাশ আর সরস প্রকৃতি। কবির লেখা মধ্যাহ্ন কবিতায় যার বিবরণ রয়েছে—

‘বেলা দ্বিপ্রহর।

ক্ষুদ্র শীর্ণ নদীখানি শৈবালে জর্জর

স্থির স্রোতোহীন। অর্ধমগ্ন তরী-'পরে

মাছরাঙা বসি, তীরে দুটি গোরু চরে

শষ্যহীন মাঠে। শান্তনেত্রে মুখ তুলে

মহিষ রয়েছে জলে ডুবি। নদীকূলে

জনহীন নৌকা বাঁধা। শূন্য ঘাটতলে

রৌদ্রতপ্ত দাঁড়কাক স্নান করে জলে

পাখা ঝটপটি। শ্যামশষ্পতটে তীরে

খঞ্জন দুলায়ে পুচ্ছ নৃত্য করি ফিরে।’

নাগর নদীকে উদ্দেশ্য করেই কবি একসময় লেখেন—

‘আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’

কবির দেখা সেই নদী নাগর এখন আর নেই। মৃত প্রায় নদীর উপরে এখন প্রকাণ্ড এক সেতু। সেতুটির নিচেই ছিল পতিসর কাছারিবাড়ির ঘাট। নদী পাড়ে ছিল রক্ষাকালী মন্দির এবং একটি তালগাছ। যেটিকে নিয়ে কবি লিখেছিলেন—'তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে।’

১৯৬২ সালের প্রবল ঝড়ে তালগাছটি ভেঙে পড়ে। এখন সেখানে অবশ্য নতুন করে লাগানো তালগাছ চোখে পড়ে। এই তালগাছের নিচেই প্রতিবছর বসতো জমিদারির পুণ্যাহ অনুষ্ঠান।

আরও পড়ুন >>> পঞ্চাশ বছরের সাহিত্যে ভাবনার পরিবর্তন

কবিগুরু শেষবারের মতো পতিসরের পুণ্যাহ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কলকাতা থেকে এসেছিলেন ১৯৩৭ সালে। পুণ্যাহ অনুষ্ঠান শেষে পতিসর কাছারিঘাট থেকে বিদায় নেন। বিদায় বেলায় সেদিন প্রজাদের উদ্দেশে কবি বলেছিলেন—'আমি অসুস্থ আর হয়তো তোমাদের কাছে আসতে পারবো না। তোমরা আমাকে অনেক দিয়েছো। আমি তোমাদের কিছুই দিতে পারি নাই। আমি প্রার্থনা করি তোমরা সুখী হও – শান্তিতে থাকো।’

শোকের ছায়া নেমেছিল সেইদিন পতিসরে। চারিদিকে উঠেছিল কান্নার রোল। বোটে চড়ে আত্রাই স্টেশনে এসে পৌঁছালে কবিগুরুকে বিদায় জানান আরেক খ্যাতনামা সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়। তিনি তখন রাজশাহীর ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।

নওগাঁর পতিসরে এলে প্রজাদরদী রবীন্দ্রনাথকে যেমন পাওয়া যায়। তেমনি এখানে তাঁর রচিত সাহিত্য মূল্যও কম নয়। ‘জমিদারি’ করতে এসে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতই নিজেকে আবিষ্কার করেছিলেন নতুন করে। পতিসরে বসেই তিনি ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাহিরে’ (অংশ বিশেষ) উপন্যাস, ছোট গল্প ‘প্রতিহিংসা’ ও ‘ঠাকুরদা’ লেখার রসদ পেয়েছিলেন।

‘পূর্ণিমা’, ‘সন্ধ্যা’, ‘চৈতালি-মধ্যাহ্ন’, ‘পল্লীগ্রামে’, ‘সামান্য লোক’, ‘দুর্লভ জন্ম’, ‘খেয়া’, ‘কর্ম’, ‘মেঘদূত’, ‘দিদি’, ‘পরিচয়’, ‘অনন্তপথে’-এর মতো অনেক কবিতা রচনা করেছিলেন। অনেক ভালো ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত যেগুলো হৃদয় স্পর্শ করে সেই রকম বেশ কয়েকটি সঙ্গীত কবিগুরু এখানেই লিখেছিলেন।

যেমন ‘বিধি ডাগর আঁখি’, ‘জলে ডোবা চিকন শ্যামল’, ‘বধূ মিছে রাগ করো না’, ‘তুমি নব রূপে এসো প্রাণে’, ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ মালা’, ‘তুমি আমার নিভৃত সাধনা’। কবিগুরু পতিসর থেকে ফেরার পথে লিখেছিলেন ‘আমি কান পেতে রই। ও আমার আপন হৃদয়গহন দ্বারে বারে বারে; কোন্ গোপনবাসীর কান্নাহাসির;গোপন কথা শুনিবারে বারে বারে।’

ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম ।। অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়