বুশরা আফরিন : এশিয়ার প্রথম চিফ হিট অফিসার ও তার চ্যালেঞ্জ
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন বুশরা আফরিনকে চিফ হিট অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। তিনি প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় শর্ত পূরণ করেই এই নিয়োগ পেয়েছেন। ৩ মে ২০২৩, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে চিফ হিট অফিসার হিসেবে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন তো বটেই, গোটা এশিয়ায় তিনিই প্রথম কোনো শহরের চিফ হিট অফিসার। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সাইন্স ও ক্লাইমেট রিজিলেন্সের আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট হলে একটি অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে এই নিয়োগের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর আগে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আরও ৭ জন নারীকে চিফ হিট অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে প্রতিষ্ঠানটি ২০২১ সাল থেকে কাজ করছে। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি এশিয়া তথা বাংলাদেশের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে কাজ করার লক্ষ্যে বুশরা আফরিনকে চিফ হিট অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়। এখন থেকে তিনি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে আনতে কাজ করবেন।
আরও পড়ুন
ঢাকার একটি স্কুলে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত লেখাপড়া করে কানাডায় উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছেন বুশরা। পরে কানাডায় কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিষয়ে। এছাড়া ঘানার ইন্সটিটিউট অব লোকাল গভর্নমেন্টেও তিনি পড়ালেখা করেছেন।
এই সময় তিনি ঘানার বলগাটাঙ্গায় নারী উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করেন। পরে বাংলাদেশের বৃহত্তম এনজিও শক্তি ফাউন্ডেশনের একজন ব্যবস্থাপনা নির্বাহী হিসেবে যোগ দেন। এছাড়া বাংলাদেশের প্রাণী অধিকার সংস্থা অভয়ারণ্যের পলিসি কনসালটেন্ট হিসেবে তিনি বিপথগামী প্রাণীদের মানবিক চিকিৎসা এবং কল্যাণ পরিচালনার জন্য একটি নীতি তৈরি করতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে কাজ করেছেন।
আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি এশিয়া তথা বাংলাদেশের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে কাজ করার লক্ষ্যে বুশরা আফরিনকে চিফ হিট অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়।
এখন চিফ হিট অফিসার পদে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে নগরে তিনি তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে আনতে পারবেন বলে আশা করছে ডিএনসিসি।
হিট অফিসারের কাজ
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ১৯৬৫ সালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। এরপর ২০২৩ সালে ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা অর্থাৎ ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। ভয়াবহ দাবদাহে অতীষ্ট হয়ে উঠেছিল নগরজীবন।
এই তাপমাত্রা কমাতে শহরব্যাপী নানা কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন। সেই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবেন এই চিফ হিট অফিসার। তিনি ঢাকা উত্তরের বাসিন্দাদের মধ্যে তাপ সচেতনতা বৃদ্ধি, সুরক্ষা প্রচেষ্টা বাড়াতে কাজ করবেন।
আরও পড়ুন
চিফ হিট অফিসার হিসেবে তিনি মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করবেন। কীভাবে গরমের মধ্যে শিশু, গর্ভবতী, বয়স্করা সুস্থ থাকতে পারেন তা সাধারণ মানুষদের জানাবেন।
ঢাকার তাপমাত্রা কমানোর উদ্যোগ নিয়ে যৌথভাবে কাজ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাড্রিয়েন আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টারের (আর্শট-রক) সঙ্গে চুক্তি করেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। ওই চুক্তির আওতায় দুই বছরে ঢাকায় ২ লাখ গাছ লাগানো হবে। তীব্র তাপপ্রবাহের ফলে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলা এবং শহরে ‘হিট আইল্যান্ড’-এর প্রভাব কমানোর জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া এবং সেগুলোর বাস্তবায়ন করবেন চিফ হিট অফিসার।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতাধীন ২৯টি খালের মধ্যে প্রায় এক বছরে খনন হয়েছে মাত্র ১টি। সেই খাল উদ্ধারেও তিনি ভূমিকা রাখবেন।
শহরের পার্ক ও বনভূমির পরিমাণ আরও বাড়াবেন। শহরে বসবাসরত মানুষদের তাপ নিয়ন্ত্রণের টেকসই পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দেবেন। এসির ব্যবহার কমিয়ে আনা, পরিবেশবান্ধব নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন করাও তার কাজ।
স্থাপত্য নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের সঙ্গে সমন্বয় করা, বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করা, গাছ লাগানোর স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি উপকারিতা নিয়ে কথা বলা, বিভিন্ন সংস্থাকে নিয়ে এই কাজ করার এবং সমন্বয় করার দায়িত্ব তার।
চিফ হিট অফিসারের আওতায় যেসব কাজ হবে, সেইসব কাজের অর্থ সহযোগিতা দেবে আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন। এছাড়া বুশরার বেতনসহ সব খরচ তারাই দেবে...
চিফ হিট অফিসারের আওতায় যেসব কাজ হবে, সেইসব কাজের অর্থ সহযোগিতা দেবে আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন। এছাড়া বুশরার বেতনসহ সব খরচ তারাই দেবে।
আরও পড়ুন
তীব্র তাপপ্রবাহ কেন হচ্ছে এবং এর ফলে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর বৈজ্ঞানিক এবং কারিগরি সমাধান খুঁজে বের করে তার বাস্তবায়ন করবেন বুশরা। এখানে উপযোগী পদ্ধতিগুলো প্রয়োগে তিনি পরিকল্পনা সাজাবেন।
হিট অফিসারের চ্যালেঞ্জ
নগরজীবনকে প্রকৃতিবান্ধব করা ও অভ্যস্ততা তৈরি করা,
কলকারখানায় নির্গত ধোঁয়া ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শৃঙ্খলার মধ্যে আনা,
শহরের তাপজনিত ওয়েদার আর্লি ওয়ার্নিং দেওয়া,
শহরে তাপ লঘুকরণ পয়েন্ট সেট করা,
জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা,
বৃক্ষ রোপণের জন্য উপযুক্ত বৃক্ষ নির্বাচন, সঠিক প্রক্রিয়ায় বৃক্ষ রোপণ এবং আন্তঃপরিচর্যায় টিকিয়ে রাখা,
পার্ক ও বনভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি ও রক্ষা করা,
উন্মুক্ত জলাধার রক্ষা এবং উদ্ধার করা (খাল, বিল, পুকুর, ডোবা ইত্যাদি)
নগর কৃষি বাস্তবায়ন করা,
ভূমিদস্যুদের হাত থেকে পার্ক, খেলার মাঠ, খাল উদ্ধার করে পুনরায় স্বরূপে ফিরিয়ে আনা।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিফ হিট অফিসার
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি, লস অ্যাঞ্জেলেস, চিলির সান্টিয়াগো, সিয়েরা লিওনের সান্টিয়াগো, গ্রিসের এথেন্স, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে চিফ হিট অফিসার রয়েছে।
উত্তর আমেরিকায় চিফ হিট অফিসার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন জেন গিলবার্ট, দক্ষিণ আমেরিকায় চিলির ক্রিস্টিনা হুইডোব্রো টর্নভাল, আফ্রিকায় সিয়েরা লিওনের ইউজেনিয়া কার্গবো, ইউরোপে এলিসাভেট বার্গিয়াননি এবং অস্ট্রেলিয়ায় ক্রিস্টা মিলনে ও টিফানি ক্রফোর্ড নিয়োগ পেয়েছেন।
এসব চিফ হিট অফিসাররা কুলিং পেভমেন্ট, কুল রুফ, ফ্রিটাউনে ভবনের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছেন। কিছু শহরে প্রচুর গাছ লাগানো হচ্ছে। সর্বোপরি পরিবেশের উন্নয়নে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বুশরা আফরিন এই ধরনের কাজ করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। বুশরা সফলভাবে কাজ করতে পারলে ঢাকার তাপমাত্রা সহনশীল পর্যায়ে আসবে।
সমীরণ বিশ্বাস ।। কৃষিবিদ
srb_ccdbseed@yahoo.com