ছবি : সংগৃহীত

এক সময় রমজান আসলে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ত। এখন সপ্তাহে বাড়ছে। দাম কেন বাড়ছে তার কোনো প্রশ্নের উত্তর নেই। কোথাও কোনো জবাবদিহিতা আছে বলে মনে হয় না।

প্রথমে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ল, এরপর দফায় দফায় বাড়ল বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির দাম। এলপি গ্যাসের দামে লাগাম নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ী কোনো পক্ষই দাম বাড়ানোর নিয়ম মানতে রাজি নয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্রেতাদের অনেকেই পণ্য কেনার ধরন পাল্টেছেন। আগে যারা সবচেয়ে ভালো পণ্য খুঁজতেন, তারা এখন কম দামের সাধারণ মানের পণ্য কিনছেন।

আরও পড়ুন >>> দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি : সাধ্যের মধ্যে কোনটা? 

কম মূল্যে পণ্য নিতে অনেকে আবার বোতলজাত ও প্যাকেট রেখে খোলা পণ্যে ঝুঁকছেন। আসলে সবার হাতেই টান পড়েছে। রমজান মাসে ভালো ব্যবসা হওয়ার কথা থাকলেও বিক্রি কিন্তু তেমন বাড়েনি।

দাম বেড়ে যাওয়ায় আনুপাতিক হারে লাভের পরিমাণও কমেছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের। পাশাপাশি দিনমজুর, রিকশাচালক, পরিবহন শ্রমিক থেকে শুরু করে প্রান্তিক, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের অবস্থা একেবারেই ভালো নেই। সংসারের খরচের চাপে চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছেন অধিকাংশ মানুষ।

কেউ কেউ খাবারের তালিকায় লাগাম টানার চেষ্টা করছেন, কেউ বাড়তি আয়ের চেষ্টা করছেন। অনেকে নিরুপায় হয়ে প্রথমে নিম্ন আয়ের এলাকায় বসতী গড়ছেন, তাতেও না পারলে শহর ছাড়ছেন, অনেকে খরচের চাপ সামলাতে গিয়ে জড়াচ্ছেন নানা ধরনের ঋণের জালে।

প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের আয়ের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এমন কঠিন পরিস্থিতি মেনে নেওয়া ছাড়া বিকল্প রাস্তাও নেই সাধারণ মানুষের কাছে।

সম্প্রতি রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলনকক্ষের সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী ভোক্তা মূল্য সূচকের (সিপিআই) হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে জানান, ফেব্রুয়ারিতে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। মার্চে তা বেড়ে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ একজন ভোক্তা ২০২২ সালের মার্চে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পেত, ২০২৩ সালের মার্চে একই পণ্য কিনতে তার খরচ হয়েছে ১০৯ টাকা ৩৩ পয়সা।

চলতি বছরের শুরু থেকে পণ্যের দাম বাড়তির দিকে। জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৫৭ ভাগ। এই কারণে ছয় মাসের ব্যবধানে দেশের বাজারে চাল, ডাল, তেল, আটা, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, শাকসবজি, ওষুধ ও শিশু খাদ্যসহ জীবনযাপনের সঙ্গে জড়িত প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে।

আরও পড়ুন >>> দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি : সংসার আর চলে না 

কোনোটা ২০ থেকে ৩০ শতাংশ আবার কোনো কোনো পণ্যের দাম ৬০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের আয়ের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এমন কঠিন পরিস্থিতি মেনে নেওয়া ছাড়া বিকল্প রাস্তাও নেই সাধারণ মানুষের কাছে।

দেশে নিত্যপণ্যের দামের প্রভাব নিয়ে ২৯ মার্চ ২০২৩, একটি জরিপের ফল প্রকাশ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। তাতে দেখানো হয়, মূল্যস্ফীতির চাপে দেশের ৭৪ শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবার ধার করে চলছে।

দেশের গ্রাম ও শহরের নিম্ন আয়ের পরিবারের ওপর করা এই জরিপে যেসব পরিবার অংশ নিয়েছে, তাদের ৯০ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, অর্থনৈতিক চাপে তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। এর মধ্যে ৯৬ শতাংশ পরিবার মাংস খাওয়া কমিয়েছে, মাছ খাওয়া কমিয়েছে ৮৮ শতাংশ পরিবার, ৭৭ শতাংশ পরিবার ডিম ও ৮১ শতাংশ পরিবার ভোজ্যতেল খাওয়া কমিয়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, দেশে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও বাজার অব্যবস্থাপনা দায়ী করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান।

আরও পড়ুন >>> ঋণ করে যেন ঘি না খাই 

এদিকে রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান সংস্থা বিবিএসের তথ্য বলছে, মার্চে খাদ্যখাতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে। এই সময় মাছ, মাংস, সবজি, মসলাজাতীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। তবে বিবিএস দাবি করেছে, এই সময়ে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মধ্যে বাড়িভাড়া, আসবাব, গৃহস্থালি, চিকিৎসাসেবা, পরিবহন ও শিক্ষাতে মূল্যস্ফীতির হার বাড়েনি। উল্টো কমেছে। ফেব্রুয়ারিতে যা ছিল ৯ দশমিক ৮২ ভাগ, মার্চে তা কমে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ হয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের দাম বাড়ার কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।

নিত্যপণ্য মূল্য আর জীবন যুদ্ধের এই সমীকরণ নিয়ে নিজেরাই হতাশার কথা জানালেন ভোক্তা ও বাজার বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, সাধারণ মানুষের এই বাস্তবতা মেনে নেওয়া ছাড়া কী বিকল্প আছে? যাদের সামর্থ্য আছে, তারা ভোগ করবে। যাদের নেই, তারা দুর্ভোগে থাকবে। এছাড়া কোনো বিকল্প দেখছি না। বলে-কয়ে কোনো লাভ নেই। তবে সমস্যাগুলো যারা তুলে ধরছেন তারাই আবার সরকারের সমালোচনার মুখে পড়ছেন। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই মানুষের জীবনমানের অবনমন হচ্ছে।

মানুষের দুঃখ-কষ্ট সীমার বাইরে চলে গেছে। সরকার বিষয়গুলো আমলে নিয়ে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছেন, কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য।

আরও পড়ুন >>> আর কত চাপ সামলাবে? 

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি বলছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বড় কারণ হলেও আগে থেকেই আমাদের মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের দাম বাড়ার কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ওপর ক্রমাগত চাপ বাড়ছে।

খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি সমান তালে বেড়ে চলছে। বিশেষ করে চাল, গম, ভোজ্য তেল, চিনি কিংবা গরুর মাংসের মূল্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এমন প্রবণতা রয়েছে।

পুষ্টি নিরাপত্তার জায়গায় ভোক্তাকে অনেক কম্প্রোমাইজ করতে হচ্ছে। সব ধরনের খাদ্যের দাম এই সময়ের মধ্যে বেড়েছে। নিম্ন বা সীমিত আয়ের মানুষের আয় সেই অর্থে বেড়েছে বলে মনে হয় না। খাদ্য মূল্যস্ফীতি যদি দীর্ঘমেয়াদে অব্যাহত থাকে, দারিদ্র্যের ওপর সরাসরি অভিঘাত সৃষ্টি করে।

সরকার নিত্যপণ্য মূল্যের লাগাম টানার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সরকারকে মানুষের আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ না নিলে ক্ষয়ক্ষতি পোষানো সম্ভব হবে না। নিত্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সরকারের হাতে নেই বা সেই ইচ্ছাও নেই।

ব্যবসায়ীরা রমজান মাসে দাম না বাড়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তা দেখা মেলে না। কিন্তু জনগণের যে বৃহদাংশ কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন তার বিপরীতে এই সহায়তা পর্যাপ্ত নয়। তাই সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতা বাড়াতে আরও উদ্যোগী হতে হবে। শুধু নিম্ন আয়ের মানুষ নয়, বেসরকারি চাকরিজীবীসহ যাদের আয় বৃদ্ধির সুযোগ নেই তাদের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।

এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)