রেলের অনিয়ম, দুর্নীতি : সর্বাঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দিব কোথা
‘কালো বিড়াল’ যেন রেলেই থাকে। ভাবা হয়েছিল ২০১২ সালের সেই বিড়াল জব্দ হয়েছে আদৌ কি তাই? টিকিট কালোবাজারির কথা সবারই জানা। নতুন ভাবে জানছি রেলওয়ের এক প্রকল্পে পরামর্শকের পেছনে যাচ্ছে ২৫৪ কোটি ৭৫ লাখ ৯৩ হাজার টাকা (যুগান্তর, ০৩ এপ্রিল ২০২৩)।
সরকার রেলওয়ে খাত গুরুত্ব দিয়ে মন্ত্রণালয় দিয়েছে। নতুন অনেক প্রকল্প হয়েছে রেলের। রেলে বর্তমানে ৩৯টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। আর এসব প্রকল্পে বরাদ্দের পরিমাণ পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা। বাজেটে সরকার যে কয়েকটি খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয় তার মধ্যে রেলখাত অন্যতম শীর্ষে।
বিজ্ঞাপন
এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, রেলে এমন উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ স্বাধীনতার পরে আর হয়নি। সরকার রেলখাত গুরুত্ব দিচ্ছে বলেই প্রতিবছর বাজেটে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে। রেলে হাজার হাজার কোটি টাকার এমন বরাদ্দ দেশের সাধারণ জনগণের জন্যই দিচ্ছে সরকার। প্রশ্ন আসে, জনগণ কি তার সুফল পাচ্ছে? কিছু ক্ষেত্রে হয়তো পেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জনগণের ভোগান্তি আর বিরক্তি আগের মতোই।
আরও পড়ুন >>> ট্রেনের টিকিটে নতুন পদ্ধতি কি জনবান্ধব?
বিভিন্ন সময়ে রেলের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ২৯ মার্চ ২০২৩ দেশের প্রধান স্টেশন ঢাকার কমলাপুরের নানা চিত্র তুলে ধরে দৈনিক যুগান্তর। সরেজমিন প্রতিবেদনটির তথ্য বলছে, স্টেশন চত্বর ঢাকা পড়েছে ময়লা-আবর্জনায়। প্ল্যাটফর্মের নিচে রেললাইন জুড়ে মলমূত্র ও নোংরা পানি।
রেলে হাজার হাজার কোটি টাকার এমন বরাদ্দ দেশের সাধারণ জনগণের জন্যই দিচ্ছে সরকার। প্রশ্ন আসে, জনগণ কি তার সুফল পাচ্ছে?
স্টেশনে সুপেয় পানির যেমন তীব্র সংকট, তেমনি গণশৌচাগার নিয়ে দুর্ভোগের যেন শেষ নেই। কারণ ৭টি প্ল্যাটফর্মের কোথাও নেই শৌচাগার। স্টেশন মাস্টারের কক্ষ লাগোয়া ছোট্ট টয়লেটে একজন ঢুকলে লম্বা লাইন পড়ে যায়। কিছুটা দূরে আরেকটি পাবলিক টয়লেট থাকলেও তা এসি টিকিটের যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত।
গণমাধ্যম বলছে, রেলের প্রায় সাড়ে চারশো স্টেশন। এরমধ্যে মাত্র ৭টিতে প্ল্যাটফর্ম জুড়ে ট্রেন দাঁড়াতে পারে। বাকিগুলোয় ট্রেনের ৪ ভাগের ৩ ভাগই প্ল্যাটফর্মের বাইরে। ফলে রোদ-বৃষ্টি এবং রাতে অন্ধকারে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
আরও পড়ুন >>> রেলের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা : বন্ধ হবে কবে?
এক যুগে কমলাপুর স্টেশন চার দফায় সংস্কার করা হয়। কিন্তু এখনো সেখানে সব প্ল্যাটফর্ম ট্রেনের পাদানির সমউচ্চতায় করা হয়নি। ৫৩টি স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ট্রেনের উচ্চতায় করার জন্য কাজ চলছে, যা শুরুতেই করা উচিত ছিল।
প্রশ্ন হলো, রেলে হাজার হাজার কোটি টাকা উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ব্যয় হচ্ছে তাহলে শুধু কমলাপুর স্টেশনের এমন দশা কেন? ঢাকার বাইরে অনেক স্টেশন নোংরা আবর্জনায় ভরপুর। প্রান্তিক পর্যায়ে রেল স্টেশনগুলোয় টয়লেট এবং সুপেয় পানির ব্যবস্থাও নেই পর্যাপ্ত।
দেশে নামকরা কয়েকটি আন্তনগর ট্রেন ঝকঝকে দেখে সব ট্রেনের অবস্থা বিচার করা যাবে না। বিশেষ করে লোকাল ট্রেনগুলোর অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ। এসব ট্রেনে টয়লেটের অবস্থাও শোচনীয়। ট্রেনের বৈদ্যুতিক পাখা নষ্ট। ভেতরে বিদ্যুৎও ঠিকমতো কাজ না করায় কিছু বাতিও বন্ধ থাকে।
আসনের সিটও ছেঁড়া। আসনে বসেও শান্তি নেই। কারণ ছারপোকার কামড় খেতে হয় যাত্রীদের। শুধু তাই নয়; ট্রেনে উঠা-নামা থেকে শুরু করে ভেতরে নারী-শিশু-বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য পরিবেশও থাকে না অনুকূলে।
তৃতীয় লিঙ্গের একশ্রেণির উগ্র মানুষদের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে যায় ট্রেনের ভ্রমণ। যাত্রীরা টিকিট কেটে একটু আরামে গন্তব্যে যেতে চায় কিন্তু রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সেই নিশ্চয়তা যাত্রীদের দিতে পারে না।
আরও পড়ুন >>> রেলের টিকিট কালোবাজারি : টিকিট যার ভ্রমণ তার
সরকার রেলখাতে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে তার মধ্যে রেললাইন নির্মাণ এবং সংস্কার অন্যতম। বরাদ্দের উল্লেখযোগ্য অর্থও যাচ্ছে রেললাইন নির্মাণ এবং সংস্কারে। রেললাইন স্থাপনে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় কত তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এক বক্তব্যে বলেছেন, কিলোমিটার প্রতি ব্যয় উন্নত রাষ্ট্রের চেয়ে অনেক বেশি দেখানো হচ্ছে। তাই প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ঠিকাদার পর্যন্ত সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার কথা বলেছেন। তাদের সম্পদের পরিমাণ এবং উৎসও খোঁজা উচিত।
যেখানে উন্নয়ন থাকে সেখানে দুর্নীতিবাজদের চোখ পড়ে। উন্নয়ন আর দুর্নীতি যেন এখন সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে! দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছেই রেলে নানা প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে। কয়েকটি প্রকল্পে কেনাকাটাসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ প্রাথমিকভাবে যাচাই বাছাই করে দুদক এরই মধ্যে তদন্ত করছে।
যেখানে উন্নয়ন থাকে সেখানে দুর্নীতিবাজদের চোখ পড়ে। উন্নয়ন আর দুর্নীতি যেন এখন সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে! দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছেই রেলে নানা প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে।
প্রকল্পে দুর্নীতি ছাড়াও রেলে নিয়োগ দুর্নীতির বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। যার প্রমাণ পেয়ে দুদক সর্বশেষ পূর্বাঞ্চলে ৮৩৬ জন খালাসি নিয়োগের ঘটনায় দুদক মামলা করেছে। এতে পূর্ব রেলের সাবেক একজন মহাব্যবস্থাপকসহ ১২জনকে দুর্নীতি মামলায় আসামি করা হয়েছে।
বছর তিন আগে রেলে কোচ-ইঞ্জিন ক্রয়ে দুর্নীতিসহ ১০ উৎস চিহ্নিত করেছিল দুদক। এসব দুর্নীতি বন্ধে ১৫ দফা সুপারিশ দিয়েছিল সংস্থাটি কিন্তু কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি মন্ত্রণালয় কিংবা রেলওয়েকে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে কি না তার কোনো তাগাদা দিতে দুদককেও অবশ্য দেখা যায়নি।
আরও পড়ুন >>> রেল যেভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে
বাংলায় প্রবাদ আছে, ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দিব কোথা’। রেলে প্রায় সবখাতেই দুর্নীতির অভিযোগ। নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে উন্নয়ন প্রকল্প সর্বত্র ঘাপটি মেরে আছে রেলের কালো বিড়ালরা।
রাষ্ট্রের দুর্নীতি দমনকারী প্রতিষ্ঠান দুদকের উচিত, রেলের সব প্রকল্প নিয়মিত মনিটরিং করা। প্রয়োজনে রেলওয়ে এবং দুদকের সমন্বয়ে একটি টিম থাকতে পারে যে টিম প্রকল্পে বরাদ্দের অর্থ ঠিকমতো ব্যয় হচ্ছে কি না, কেনাকাটায় স্বচ্ছতা রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখবে।
রেলখাতে সরকার যতই বরাদ্দ দিক, দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় না আনতে পারলে এসব উন্নয়ন টেকসই হবে না। টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন কালো বিড়ালদের দমন।
আদিত্য আরাফাত ।। বিশেষ প্রতিনিধি, ডিবিসি নিউজ