ছবি : সংগৃহীত

বাস ভাড়া নিয়ে যাত্রী, মালিক-শ্রমিক, আর বিআরটিএ-এর মধ্যে যে ত্রিমুখী অবস্থান চিরাচরিত এবং এই বিষয় নিয়ে প্রায় প্রতি বছর দেশে আলোচনার ইস্যু সৃষ্টি হয় আর প্রায় প্রতিদিন যাত্রীর সাথে বাসের হেলপারের বচসা হয়।

পৃথিবীর শহরগুলো যেখানে গণপরিবহনের আধুনিকায়ন ও এর সাথে প্রযুক্তির সর্বশেষ ব্যবহার নিশ্চিত করছে সেখানে আমরা এখনো ভাড়া কত হবে বা সেই নির্ধারিত ভাড়া কীভাবে সংগ্রহ করব বা এই ভাড়ার সামগ্রিক বিষয় কীভাবে মনিটরিং হবে সেটা নিয়েই খাবি খাচ্ছি।

বাস ভাড়া কত হবে সেটা নির্ভর করে বেশকিছু বিষয়ের উপর তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—দূরত্ব, জ্বালানির দাম, বাসের অপারেটিং খরচ, সিট সংখ্যা, যাত্রীর সংখ্যা, স্টপেজের সংখ্যা ইত্যাদি। আমাদের দেশে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় বা যে বিষয়টি বাস ভাড়া বাড়বে না কমবে তা নির্ধারণ করে তা হলো, জ্বালানির দাম।

আরও পড়ুন >>> আলমডাঙ্গা মহাসড়কের একদিন 

জ্বালানি তেলের দাম পরিবর্তন হলে বাস ভাড়ার ব্যাপারটি সামনে চলে আসে। সর্বশেষ ২০২২ সালের ৫ আগস্ট ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বাস ভাড়া প্রতি কিমি ২.৫০ টাকা হারে নির্ধারিত করা হয় এবং একই মাসের শেষে ডিজেলের দাম কমাতে তা ২.৪৫ টাকা হারে পুনঃনির্ধারণ করা হয়।

এই নির্ধারণ বা পুনঃনির্ধারণের সময় জ্বালানি খরচের সাথে আর কোন কোন খরচ বিবেচনা করা হয় তা পরিষ্কার নয় আর সচরাচর একটি বা দুইটি মিটিং-এর মাধ্যমে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় তাই কোনো প্রকার গাণিতিক হিসাব নিকাশ বা মডেলিং-এর মাধ্যমে যে এই ভাড়া প্রস্তাব করা হয় না তা পরিষ্কার।

এখানে আরও একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, ভাড়ার হার যেহেতু ভগ্নাংশে থাকে তাই সর্বনিন্ম ভাড়ার নির্ধারিত দূরত্বের পর যেকোনো দূরত্বের ভাড়া এই হিসাবে ভগ্নাংশেই আসবে আর এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এর ফলে ভাড়া প্রদানের ক্ষেত্রে লজিক্যালি আপানকে পরবর্তী পূর্ণ সংখ্যায় ভাড়া প্রদান করতে হবে।

পৃথিবীর শহরগুলো যেখানে গণপরিবহনের আধুনিকায়ন ও এর সাথে প্রযুক্তির সর্বশেষ ব্যবহার নিশ্চিত করছে সেখানে আমরা এখনো ভাড়া কত হবে বা সেই নির্ধারিত ভাড়া কীভাবে সংগ্রহ করব বা এই ভাড়ার সামগ্রিক বিষয় কীভাবে মনিটরিং হবে সেটা নিয়েই খাবি খাচ্ছি।

যেমন, কেউ যদি এই হিসাবে ০৯ কিমি দূরত্ব ভ্রমণ করে তবে ২.৪৫ টাকা হিসাবে তার ভাড়া আসবে ২২ টাকা ০৫ পয়সা। এখন এই ০৫ পয়সা না যাত্রীর কাছে আছে, না বাসের হেল্পারের কাছে আছে। তখন সরকারি হিসাবে ভাড়া দিতে গেলে একজন যাত্রীকে ভাড়া দিতে হবে ২৩ টাকা বা তার বেশি। অর্থাৎ সিস্টেমের কারণে বেশি ভাড়া দিতে আমরা বাধ্য হচ্ছি।

আরও পড়ুন >>> চকরিয়ায় পাঁচ ভাইয়ের মৃত্যু : বিচার ও দায় স্বীকারের সংস্কৃতি 

বাস মালিক বা হেলপার বিআরটি-এর নির্ধারিত ভাড়ার চাইতে বেশি টাকা নিচ্ছে এই অভিযোগ অনেক পুরোনো। এই সমস্যার পেছনে একদিকে যেমন অনেক মালিকদের দায় রয়েছে তেমনি আমাদের সিস্টেম ও যাত্রীদেরও দায় আছে। অনেক মালিক আছেন যারা বিআরটি-এর নির্ধারিত ভাড়ার হারের চেয়ে বেশি ভাড়া অনেক আগে থেকেই নিয়ে আসছেন বরং বিআরটিএ-এর ভাড়া কার্যকর হলে স্টপেজ ভেদে ভাড়া বৃদ্ধির চাইতে কমে যাবে। এজন্য তারা বিআরটিএ-এর চার্ট অনুসরণ না করে পূর্বের ভাড়া বা জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে তার চাইতে আরও কিছু অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করে।

বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা–সমালোচনা রয়েছে কিন্তু এতকিছুর মাঝে যে আরও দুইটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে আমরা নজর দিচ্ছি না তা হলো, ভাড়া সংগ্রহের সিস্টেম আর যাত্রীদের আচরণগত দিক।

একজন বাস মালিক যখন পরিবহন ব্যবসায় আসবেন তখন তিনি নিয়মানুযায়ী লাভ করবেন এটাই স্বাভাবিক আর সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে তাকে কিছু সুবিধা প্রদান করে কিছু নিয়মনীতির মাধ্যমে এই পরিসেবা সাপোর্ট দেওয়া যাতে মালিক ও যাত্রী দুই পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণ হয়।

এক্ষেত্রে সরকার যে কাজগুলো করবে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, রুট নির্ধারণ, ভাড়ার হার নির্ধারণ, বাস স্টপেজ নির্ধারণ, বাস স্টপেজ নির্মাণ, রুটের দুই প্রান্তে বাস রাখা ও পরিচালনের পর্যাপ্ত জায়গা ও সুবিধা নিশ্চিত করা। আর যাত্রীর দায়িত্ব হচ্ছে নির্ধারিত বাস স্টপেজ থেকে বাসে উঠানামা করা।

বাস ভাড়া নিয়ে যত অনিয়ম হয় তার পেছনে বড় ভূমিকা রাখে বাস স্টপেজ বা যাত্রী উঠা বা নামার স্থান। ঢাকা শহরের প্রতিটি বাস রুটের জন্য সরকার নির্ধারিত বাস স্টপেজ রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাস স্টপেজগুলো হয় কোনো না কোনো রাস্তার সংযোগস্থলের খুব কাছে এবং কোনো রকম অবকাঠামোগত (যাত্রী বসার জায়গা, পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা, বাস দাঁড়ানোর পর্যাপ্ত জায়গা ইত্যাদি) সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই।

আরও পড়ুন >>> রেলক্রসিং কেন অরক্ষিত? 

সরকার যখন ভাড়া নির্ধারণ করে তখন বাস স্টপেজের সাথে দূরত্বের সামঞ্জস্য করে একটা হিসাব করে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাস চালকরা সরকার নির্ধারিত বাস স্টপেজ মেনে চলে না। বাসচলক বা মালিক নির্ধারিত বাস স্টপেজের বাইরেও মধ্যবর্তী কিছু স্টপেজ থেকে যাত্রী উঠানামা করায়।

এখন একজন যাত্রী যিনি মধ্যবর্তী কোনো স্থান থেকে বাসে উঠবেন তার ভাড়ার হিসাব স্বাভাবিক নিয়মে চাইলেও করা সম্ভব হচ্ছে না কারণ বাসের মধ্যে বসে দূরত্ব বা কিলোমিটার হিসাব করার সময় বা সক্ষমতা যাত্রী বা হেলপার কারোই থাকে না।

নির্ধারিত বাস ভাড়া প্রয়োগে এই সমস্যার পেছনে আমাদের যাত্রীদের ও ভূমিকা রয়েছে। যাত্রীরা অনেক সময় কোনো রাস্তার সংযোগস্থলে গাড়ি দাঁড়ালে বা ট্রাফিক জ্যামে বসে উঠতে চায় বা নামতে চায়। তখন সেই যাত্রীর জন্য ভাড়ার হার নির্ধারণ করা খুব জটিল। এই ধরনের জটিলতা দূর করা বেশ চ্যালেঞ্জের বিশেষ করে আমাদের মতো ঘনবসতি পূর্ণ শহরে যেখানে রাস্তা নির্মাণ ও ভূমি ব্যবস্থাপনা দুটোতেই আছে পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাব। তবে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে এই সমস্যার অনেকাংশে সমাধান করা সম্ভব।

প্রথমেই প্রয়োজন বাস স্টপেজগুলো সুনির্দিষ্ট করে বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা অর্থাৎ বাস স্টপেজগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত আছে কি না, সেখানে যাত্রীদের অপেক্ষা করার ও বাস থামার পর্যাপ্ত স্থান আছে কি না এবং সর্বোপরি নিরাপদ কি না ইত্যাদি নিরূপণ করা। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো বাস স্টপেজগুলো যেন কোনোভাবেই রাস্তার সংযোগস্থলে না হয়।

আরও পড়ুন >>> পরিকল্পিত মেট্রোরেল কেন জরুরি 

রাস্তার সংযোগস্থল থেকে বাস স্টপেজের দূরত্ব ন্যূনতম ৫০ ফিট হতে হবে। অনেক রুটের বাস স্টপেজ পুনঃনির্ধারণ করার প্রয়োজনও হতে পারে। এরপর কোনো অবস্থাতেই যাতে বাস এই সমস্ত স্টপেজের আগে বা পরে যাত্রী না উঠায় তা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য ট্রাফিক পুলিশের সহযোগিতা ও কঠোর মনিটরিং প্রয়োজন। একবার বাস স্টপেজের স্থান নির্ধারণ ও সেটার নিয়মিত ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে ভাড়ার হিসাব করার ক্ষেত্রে দূরত্বের মান নির্দিষ্ট করা যাবে এবং সেভাবে ভাড়ার পরিমাণ নির্দিষ্ট করতে হবে।

ভাড়া সংগ্রহের জন্য আমাদের আধুনিক টিকেটিং ব্যবস্থা প্রয়োজন। আমাদের দেশে সম্প্রতি পরীক্ষামূলকভাবে ই-টিকেটিং চালু হয়েছে কিন্তু সেটা নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই।

ভাড়া সংগ্রহের জন্য আমাদের আধুনিক টিকেটিং ব্যবস্থা প্রয়োজন। আমাদের দেশে সম্প্রতি পরীক্ষামূলকভাবে ই-টিকেটিং চালু হয়েছে কিন্তু সেটা নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। ই-টিকেটিং-এর বিপক্ষে মূল অভিযোগ হলো, এখানে টিকেটের গায়ে দূরত্বের হিসাব লেখা থাকে না তাই যাত্রী কতটুক দূরত্ব ভ্রমণ করার বিপরীতে কত ভাড়া দিল তা বুঝতে পারে না।

ই-টিকেটিং এর প্রচলন অবশ্যই ভালো উদ্যোগ কিন্তু এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যে, যাত্রী এক নির্ধারিত স্টপেজ থেকে অন্য নির্ধারিত স্টপেজের গমনের ক্ষেত্রে যেন টিকেটের গায়ে দুই স্টপেজের নাম ও দূরত্ব উল্লেখ করা থাকে। এর ফলে যাত্রী অতিরিক্ত ভাড়া প্রদান করেছেন কি না তা বুঝতে পারবে।

যাত্রীদের সহযোগিতা এই ভাড়া সংগ্রহের সিস্টেম টেকসই করতে ভূমিকা রাখবে। যাত্রীরা যেন নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়া গণপরিবহনে না উঠেন সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যদি কোনো কারণে কেউ নির্ধারিত স্টপেজের আগে বা পরে উঠেন বা নেমে পড়েন তার ভাড়ার হিসাবের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী বা পরবর্তী নির্ধারিত বাস স্টপেজের হিসাব অনুযায়ী করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন >>> মরণ ফাঁদের নির্মাণকাজ 

আমাদের মনে রাখতে হবে যে, একটি গণপরিবহনে একসাথে প্রায় ৫০/৬০ জন ভ্রমণ করেন এবং তারা যদি স্টপেজ বাদ দিয়ে নিজেদের পছন্দমতো স্থান থেকে উঠেন বা নামেন তাহলে ভাড়া হিসাবে জটিলতা সৃষ্টি হবে। তাই আমাদের পৃথিবীর ভালো গণপরিবহন আছে এমন দেশের মতো বাস স্টপেজ নির্ভর গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে হবে তাহলে ভাড়াসহ অন্যান্য জটিলতা দূর করা সম্ভব।

এক্ষেত্রে সরকার বা বিআরটিএ-কে কঠোর হতে হবে যাতে, দুইটি নির্ধারিত স্টপেজের গৃহীত ভাড়া সরকার নির্ধারিত হারে সংগ্রহ করা হয়। তবে দীর্ঘমেয়াদে গণপরিবন ব্যবস্থার টেকসই সমাধান আসবে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবস্থার মাধ্যমে—আমরা যেন সেই লক্ষ্য থেকে আমাদের নজর সরিয়ে না ফেলি।

কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ ।। সহকারী অধ্যাপক (অন-লিভ), এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট; সার্ভিলেন্স কো-অর্ডিনেটর, বিআইজিআরএস