মাদারীপুরের শিবচরে সড়ক দুর্ঘটনা
যেটা দিতে পারব না, সেটা কেড়ে নেওয়ারও অধিকার নেই
আফসানা মিমি। জানি না একসময়কার জনপ্রিয় অভিনেত্রী আফসানা মিমির সাথে মিলিয়ে বাবা-মা তার নামটি রেখেছিলেন কি না। বাবা সরকারি কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল মারা গিয়েছিলেন মিমির ছেলেবেলাতেই। স্বামীর মৃত্যুর পর কানিজ ফাতেমার পৃথিবী ছিল দুই মেয়ে- আফসানা মিমি আর রোকাইয়া ইসলাম রূপা। এই দুই মেয়েকে নিয়ে তার স্বপ্ন।
মায়ের যুদ্ধের সাথী ছিলেন দুই মেয়ে। আফসানা মিমি তার যুদ্ধের শেষ ল্যাপে ছিলেন, জয় যেন দৃষ্টিসীমায়। এসএসসি-এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া মিমি অনার্স-মাস্টার্সেও প্রথম শ্রেণি পেয়েছিলেন। গোপালগঞ্জের বাসা থেকে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিলেন সার্টিফিকেট তুলতে। ১৯ মার্চ ২০২৩ ভোরে সব স্বপ্ন মিশে যায় সড়কে।
বিজ্ঞাপন
মাদারীপুরের শিবচরে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে ইমাদ পরিবহনের বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে আফসানা মিমিসহ ২০ জন নিহত হয়েছেন (ঢাকা পোস্ট, ১৯ মার্চ ২০২৩)। কানিজ ফাতেমার এতদিনের সংগ্রাম শেষ ধাপে এসে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
আরও পড়ুন >>> শহর যেন মৃত্যুফাঁদ
শুধু আফসানা মিমি নন, সেই বাসের মারা যাওয়া বাকি ১৯জনও আসলে কারও না কারও স্বজন, কোনো না কোনো পরিবারের স্বপ্ন। প্রতিদিন এমন অসংখ্য স্বপ্ন সড়কে বিলীন হয়ে যায়। মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিন লম্বা হয়।
বাংলাদেশে কোনোকিছুরই ধারাবাহিকতা নেই, সড়ক দুর্ঘটনা ছাড়া। প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতায় সড়ক দুর্ঘটনার খবর থাকে। আমরাও দুর্ঘটনায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি। মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হলে প্রথম পাতায় আসে, না হয় ভেতরের পাতায়। তারপর আমরা ভুলে যাই। কিন্তু যারা মারা যান, তাদের স্বজনরা এই ব্যথা কখনোই ভুলতে পারেন না।
বাংলাদেশে কোনোকিছুরই ধারাবাহিকতা নেই, সড়ক দুর্ঘটনা ছাড়া। প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতায় সড়ক দুর্ঘটনার খবর থাকে। আমরাও দুর্ঘটনায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
যারা আহত হন তাদেরকেও সেই ক্ষত বয়ে বেরাতে হয় সারাজীবন। নিটোল-নিলয় গ্রুপের একটি স্লোগান আছে—‘একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না।’ এরচেয়ে সঠিক স্লোগান আর হতে পারে না। আসলেই দুর্ঘটনার কান্না কখনো থামে না।
আমরা সবাই লিখি বটে ‘সড়ক দুর্ঘটনা’। সড়কে দুর্ঘটনা হতেই পারে, সব দেশেই হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সব দুর্ঘটনা আমার কাছে দুর্ঘটনা মনে হয় না। নিশ্চিতভাবে তা অনেক বেশি খামখেয়ালির ফল। কখনো গাড়ির দোষে, কখনো চালকের খামখেয়ালিতে, কখনো রাস্তার দোষে দুর্ঘটনা ঘটে।
আরও পড়ুন >>> মরণ ফাঁদের নির্মাণকাজ
১৯ মার্চ ২০২৩ ভোরে ইমাদ পরিবহনের বাসটি খাদের পড়েছে দেশের একমাত্র এক্সপ্রেসওয়ে থেকে। পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-ভাঙ্গাকে যুক্ত করতে বানানো হয়েছে দেশের একমাত্র এক্সপ্রেসওয়ে। ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত যেতে যেতেই মন ভালো হয়ে যায়। এমন চমৎকার রাস্তাও বাংলাদেশে হতে পারে, কয়েক বছর আগেও কেউ ভাবেনি।
বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক শামসুল হক একটি পত্রিকায় লিখেছেন, ‘শুধু সড়ক নয়; গাড়ি-চালককেও ফিট হতে হবে।’ প্রথমে আসি বাসের ফিটনেসের কথায়। মাদারীপুরের শিবচরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়া ইমাদ পরিবহনের বাসটির সড়কে চলাচলের অনুমতিই ছিল না, ফিটনেসের মেয়াদও ছিল না।
১৭ নভেম্বর রাতে এই বাসটিই গোপালগঞ্জ সদর এলাকায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের পেছনে ধাক্কা দিলে তিনজন মারা যান, আহত হন ১৫ জন। তারপর থেকে বাসটির চলাচলের অনুমতি স্থগিত রাখা হয়েছিল।
আরও পড়ুন : এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ!
সর্বশেষ ১৮ জানুয়ারি বাসটির ফিটনেস সনদের মেয়াদও ফুরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাস মালিক ফিটনেস বা চলাচলের অনুমতি কোনোকিছুরই তোয়াক্কা করেননি। এক্সপ্রেসওয়েতে বাসটি দ্রুতগতিতে চলছিল। যাত্রীরা একাধিকার বলেও চালককে নিবৃত করতে পারেননি।
আহত এক যাত্রী জানিয়েছেন, বাসটির ব্রেক ভালোমতো কাজ করছিল না। এমন কথা চালক ও হেলপার নিজেদের মধ্যেই বলাবলি করছিল। তার মানে চলাচলের অনুমতি ছাড়া, ফিটনেস ছাড়া, ব্রেক ঠিকমতো কাজ না করার পরেও মালিক বাসটি রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছিলেন। মালিকের খামখেয়ালি আর লোভের বলি হলো ২০টি তাজা প্রাণ।
এবার আসি চালক প্রসঙ্গে। ইমাদ পরিবহনের চালকদের গাড়ি চালাতে হয় অনেকটা বিরামহীনভাবে। দুর্ঘটনাকবলিত বাসটির চালক ছিলেন জাহিদ হাসান। তিনি নিজেও দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন।
এবার তার রুটিনটা একটু দেখুন, ১৬ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার ঢাকার দোলাইরপাড়ের বাসা থেকে বের হন জাহিদ হাসান। ওই দিন রাতেই যাত্রীবাহী বাসটি নিয়ে যান পিরোজপুরে। ১৭ মার্চ ২০২৩, শুক্রবার সকালে পিরোজপুর থেকে যাত্রী নিয়ে ঢাকায় ছুটে আসেন। শুক্রবার বিকেলে আবার যাত্রী নিয়ে ছুটে যান পিরোজপুরে। রাতে পিরোজপুর পৌঁছে পরের দিন ১৮ মার্চ ২০২৩, শনিবার সকালে আবার যাত্রী নিয়ে ঢাকায় ছুটে আসেন।
আরও পড়ুন : আলমডাঙ্গা মহাসড়কের একদিন
ঢাকা থেকে শনিবার দুপুরে আবার ছুটে যান খুলনায়। রাতে বাসের মধ্যে তিন থেকে চার ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে ১৯ মার্চ ২০২৩, রোববার ভোর চারটায় খুলনার ফুলতলা থেকে বাসটি নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন। এভাবে তিনি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৩০ ঘণ্টার বেশি সময় বাস চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েন।
বাংলাদেশে পদে পদে অনিয়ম। বিআরটিএ তো পুরো অনিয়মের আখড়া। কিন্তু যেখানে মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন সেখানে অনিয়মের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি থাকতে হবে।
বাসটি তো আসলে রোববার নয়, শনিবারেই দুর্ঘটনায় পড়তে পারতো। গাড়ি চালানো শুধু দক্ষতার ওপর নির্ভর করে না। গাড়ি চালাতে চাই অখণ্ড মনোযোগও। চালক যত দক্ষই হোন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৩০ ঘণ্টা গাড়ি চালালে দুর্ঘটনা হবেই। কারণে জাহিদ হাসানও মানুষ, তিনি যন্ত্র নন।
এই দুর্ঘটনার জন্য অবশ্যই চালক দায়ী। কিন্তু তিনিও এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। তারও সংসার আছে, সন্তান আছে। শনিবার রাতে তিনি ফোনে তার ছেলেকে বলেছিলেন, তিনি খুব ক্লান্ত। রোববার ঢাকায় ফিরে বাসায় একদিন বিশ্রাম নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি চলে গেলেন চির বিশ্রামের দেশে।
জাহিদ হাসান কেমন চালক ছিলেন, এখন আর সেটি জানার উপায় নেই। ধরে নিচ্ছি, তিনি খুব ভালো চালক ছিলেন। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৩০ ঘণ্টা গাড়ি চালালে, সেখানে দক্ষতা বিচার্য নয়। তবে বাংলাদেশে অনেক অদক্ষ চালক স্টিয়ারিঙে বসে যান। কিছুদিন চালকের কাছে শিখে শিখে হেল্পাররাই চালক বনে যান। লাইসেন্স পেতেও সমস্যা হয় না। তাদের নেতা শাজাহান খান তো আগেই বলে রেখেছেন, গরু-ছাগল চিনলেই যেন লাইসেন্স দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন >>> চকরিয়ায় পাঁচ ভাইয়ের মৃত্যু : বিচার ও দায় স্বীকারের সংস্কৃতি
বাংলাদেশে পদে পদে অনিয়ম। বিআরটিএ তো পুরো অনিয়মের আখড়া। কিন্তু যেখানে মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন সেখানে অনিয়মের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি থাকতে হবে। চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। চালকদের গাড়ি চালানোর ফাঁকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিশ্চিত করতে হবে।
বিআরটিএ বলছে, ফিটনেস ছাড়া গাড়ি রাস্তায় চললে তাদের কিছু করার নেই, সেটা দেখার দায়িত্ব পুলিশের। দায়িত্ব যারই হোক, তাকে সেটা সঠিকভাবে পালন করতে হবে। ইমাদ পরিবহনের ফিটনেসবিহীন বাসটি যদি রাস্তায় নামতে না পারতো, তাহলে ২০টি প্রাণ হারাতে হতো না। মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই। যেটা আমরা দিতে পারব না, সেটা কেড়ে নেওয়ার অধিকার আমাদের কারওই নেই।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ