ট্রেনের টিকিটে নতুন পদ্ধতি কি জনবান্ধব?
লোম বাছতে কম্বল উজাড় অবস্থা যেন বাংলাদেশ রেলওয়ের। টিকিট কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে টেকসই ব্যবস্থা নিতে গিয়ে এখন ট্রেনের বিপুল সংখ্যক যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে ফেলে দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ।
জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত যে রেলওয়ের ভুল—তা বলছি না। তবে সব আন্তনগর ট্রেন ভ্রমণের ক্ষেত্রেই এটা প্রয়োগের সময় কি এখন? বাস্তবায়নের আগে রেল কর্তৃপক্ষের ভাবা দরকার ছিল।
বিজ্ঞাপন
১ মার্চ থেকে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ আন্তনগর ট্রেনে ভ্রমণ করতে জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করে। এই ব্যবস্থায় বিদেশি নাগরিকদের ট্রেনে ভ্রমণে পাসপোর্ট দেখিয়ে টিকিট নিতে হবে। পদ্ধতি চালুর দিন কয়েক পার হয়েছে। কিন্তু ভোগান্তি বেড়েছে চরম।
আরও পড়ুন >>> মেট্রোরেল অর্থনীতির নতুন জাগরণ
বাংলাদেশ রেলওয়ে হয়তো মনে করেছে দেশের সব মানুষ ইউরোপ আমেরিকার উন্নত দেশের বাসিন্দা হয়ে গেছে; না হলে নতুন পদ্ধতিতে টিকিট কাটতে ১২ বছরের বেশি বয়সী দেশের জনসংখ্যার কেন নিবন্ধন করতে হবে?
নতুন নিয়মে শুধু অনলাইন নয়, কাউন্টার থেকেও ট্রেনের টিকিট কিনতে নিবন্ধন করতে হবে। খুলতে হবে অ্যাকাউন্ট। কাউন্টার, অনলাইন ও অ্যাপের মাধ্যমে তা করতে হবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে হয়তো মনে করেছে দেশের সব মানুষ ইউরোপ আমেরিকার উন্নত দেশের বাসিন্দা হয়ে গেছে; না হলে নতুন পদ্ধতিতে টিকিট কাটতে ১২ বছরের বেশি বয়সী দেশের জনসংখ্যার কেন নিবন্ধন করতে হবে?
ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে যেসব যাত্রী তাদেরও নিবন্ধন করতে হবে মোবাইল ফোনে। এসএমএসের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। আগে থেকে যাদের রেলের ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করা আছে তাদের সাইন-ইন করে জন্মনিবন্ধন সদন আপলোড করতে হবে। আর যাদের আগে থেকে নিবন্ধন নেই, একেবারেই নতুন, তাদের প্রথমে ওয়েবসাইট ভিজিট করে সাইনআপ করে জাতীয় পরিচয়পত্র আপলোডের মাধ্যমে নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হবে।
আরও পড়ুন >>> রেলের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা : বন্ধ হবে কবে?
এসব নিয়মকানুন দেখে মনে হচ্ছে, প্রযুক্তিবান্ধব ছাড়া ট্রেনে ভ্রমণ করা যাবে না। বাংলাদেশ রেলওয়ের ভাবা উচিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনগ্রসর একজন মানুষ কীভাবে এসব বুঝবে? যে পদ্ধতিগুলোর কথা বলা হয়েছে তাতে অগ্রসর মানুষও বিরক্ত হচ্ছে। নতুন পদ্ধতিতে দেশের একটা বড় জনগোষ্ঠীই টিকিট কাটার সুযোগ পাচ্ছে না।
রেলের নতুন পদ্ধতি মূলত কালোবাজারি বন্ধের জন্য। গণমাধ্যমের খবর বলছে, কালোবাজারি কিছুটা বন্ধ হয়েছে। তবে ট্রেনের ভেতরে টিকিট চেকারদের অবস্থা এখন রমরমা। কারণ জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া যারা ট্রেনে উঠে যাচ্ছে তারা টিটিই’র হাতের মুঠোয় ‘মাইনে’ ধরিয়ে দিলে মাফ পেয়ে যাচ্ছে। এসব অভিযোগ ঢালাও নয়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিতের জন্য রেলওয়ে তদন্ত করতে পারে।
ট্রেনের টার্গেট পিপল অর্থাৎ সরকারি এই গণপরিবহনের যাত্রী কারা? দেশের সাধারণ মানুষ। যাদের উল্লেখযোগ্য অংশ প্রান্তিক পর্যায়ের। রেল কর্তৃপক্ষের অবশ্যই মাথায় রাখা উচিত ছিল যে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনেকেই এখনো ট্রেনের অনেক ডিজিটালাইজড পদ্ধতির বিষয়ে অভ্যস্ত হয়নি।
আরও পড়ুন >>> রেলের টিকিট কালোবাজারি : টিকিট যার ভ্রমণ তার
রেলের নতুন পদ্ধতি দেশের মানুষকে আরও অগ্রসর করে চালু করতে পারতো। না হয়, রেল কর্তৃপক্ষ সময় নিয়ে ধাপে ধাপে চালু করতে পারতো। যেমন সব আন্তনগরে নতুন পদ্ধতি চালু না করে দু-একটি আন্তনগর ট্রেন দিয়ে চালু করতে পারতো। অথবা, আন্তনগর ট্রেনের ক্যাবিন কক্ষ কিংবা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষগুলোর টিকিট এনআইডির মাধ্যমে করতে পারতো। কারণ, এসব কক্ষে কিছুটা সামর্থ্যবান যাত্রীরা ভ্রমণ করে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের ভাবা উচিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনগ্রসর একজন মানুষ কীভাবে এসব বুঝবে? যে পদ্ধতিগুলোর কথা বলা হয়েছে তাতে অগ্রসর মানুষও বিরক্ত হচ্ছে।
লোকাল ট্রেনের মতো, রেলওয়ের অনেক আন্তনগর ট্রেন আছে, যেগুলোয় নিম্ন আয়ের মানুষ চলাচল করে। কম উন্নত এসব ট্রেনে ভাড়া কম থাকায় প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষগুলো এসব ট্রেনে চলাচল করে। এসব মানুষ পড়েছে এখন চরম বেকায়দায়। সরকার রেলকে জনবান্ধব করতে বলেছে। হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত কতটা জনবান্ধব হলো? এসব প্রশ্ন থেকে যায়।
বাংলাদেশ রেলওয়ে, মন্ত্রণালয় পাওয়ার পর অনেক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। রেলকে জনবান্ধব করার জন্যই এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এটা সত্য যে, নতুন নতুন রেললাইন হচ্ছে। বগি বেড়েছে। ঝকঝকে হয়েছে কয়েকটি ট্রেন কিন্তু লোকসান কমেনি রেলের।
আরও পড়ুন >>> রেল যেভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে
প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য অর্থ বরাদ্দ হয় রেলের উন্নয়নের জন্য। বছরের পর বছর সরকার রেলখাতে টাকা ঢাললেও রেলওয়ে লোকসানের পাল্লা কমাতে পারছে না। রেলওয়ের প্রকাশনা এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ থেকে জানা যায়, দশ বছরে প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনেছে রেলওয়ে।
রেল মন্ত্রণালয়কে সহজভাবে ভাবতে হবে। বছরের পর বছর ধরে সরকার রেলখাতে বরাদ্দ বাড়ালেও মানুষ কতটা সেবা পাচ্ছে রেলওয়ের কাছে? প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা রেল খাতে বরাদ্দের কথা মানুষ শোনে কিন্তু জনগণের সেবা নিশ্চিত কতটা নিশ্চিত করা গেছে?
আমরা বিভিন্ন সময় রেলখাতে অনেক উন্নয়নের গল্প শুনি। আগের রেলমন্ত্রীরাসহ বর্তমান মন্ত্রীও রেলখাতে অনেক উন্নয়নের গল্প শোনায়। উন্নয়ন রেলখাতে হয়নি তা বলছি না তবে মানুষ যেদিন সহজে টিকিট পাবে, ভোগান্তি ছাড়া ট্রেনে ভ্রমণ করতে পারবে সেদিন রেলের উন্নয়নের গল্পগুলো সার্থক হবে। সেবা প্রাপ্তি কঠিন করে উন্নয়নের গল্প টেকসই হবে না জনগণের কাছে।
আদিত্য আরাফাত ।। বিশেষ প্রতিনিধি, ডিবিসি নিউজ