গ্রন্থ সংস্কৃতি
বছর দুয়েক আগের কথা। ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটরস লিডারশিপ প্রোগ্রামের আওতায় আমেরিকায় গিয়েছিলাম। কর্মসূচির অংশ হিসেবে এক মার্কিন পরিবারের সাথে একটা দিন থাকতে হয়েছিল তাদের বুঝবার জন্য, তাদের জীবন ধারা দেখবার জন্য। বিকেলের দিকে বাড়ির বাইরে বের হয়ে ওয়াশিংটনের ডাউনটাউনের সেই আবাসিক এলাকাটি ঘুরতে গিয়ে একটা মাঝারি সাইজের বুকশেলফ পেলাম এক বাড়ির সামনে। বই আছে, ম্যাগাজিন আছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম এটা কমিউনিটি উদ্যোগ। যে কেউ এখান থেকে বই নিয়ে পড়তে পারেন, তার পড়া বই এখানে রাখতে পারেন যেন অন্যরা পড়তে পারেন।
ইউরোপ, আমেরিকায় বাসে, ট্রেনে, মেট্রোতে হাতে মোবাইল বা ল্যাপটপে চোখ রাখা মানুষ যেমন দেখা যায়, দেখা যায় অসংখ্য মানুষ চুপচাপ বই পড়ছেন। কিংবা ক্যাফে উইথ বুকস লেখা অসংখ্য কফি শপে বসে বই পড়ছেন মানুষ। পথে-ঘাটে, দোকানপাটে এমনি করেই সুযোগ আছে বই পড়ার। এটা তাদের গ্রন্থ সংস্কৃতি।
বিজ্ঞাপন
করোনার কারণে ফেব্রুয়ারিতে হতে না পারা অমর একুশে গ্রন্থমেলা আজ শুরু হচ্ছে। বাৎসরিক এই বই উৎসবে প্রচুর বই ছাপা হয়, বিক্রি হয়। কিন্তু হাজার হাজার বইয়ের মধ্যে কতটা পাঠযোগ্য, কতটা ভালো সম্পাদিত, কতটা মানসম্পন্ন এই বিতর্কের বাইরে বড় বিষয় - সত্যি কি আমাদের কোনো বই সংস্কৃতি আছে?
এখন কোনো মেলায় কোনো লেখকের বই ৩০০ কপি বিক্রি হলেই প্রকাশক খুশি। অবস্থাটা এমন হয়েছে বেশ কিছু কারণে। প্রথমে আসে টেলিভিশন। আকাশ সংস্কৃতি...
একজন জনপ্রিয় লেখক কিছুদিন আগে লিখেছেন, তাকে দেখে অনেকেই নানা কথা জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু তার কোন বইটি পড়েছেন, এটা জানতে চাইলে উত্তর আসে না। তার অর্থ কি এই দাঁড়ায় যে, পড়ার অভ্যাস কমছে? হয়তো নয়। কারণ ইন্টারনেটে অসংখ্য পড়ার উপকরণ আছে, বইও আছে এবং এখনকার প্রজন্ম সেটাই হয়তো পড়ছে, এভাবে হাতে বই নিয়ে হয়তো পড়ছে না। তবে সামগ্রিকভাবে সবারই ধারণা বই পড়ার একটা সংস্কৃতিই আসলে সেভাবে গড়ে উঠেনি এদেশে।
ইমদাদুল হক মিলন এক লেখায় লিখেছেন, ১৯৯৩ সালের বইমেলায় শুধুমাত্র এক মেলাতেই তার ‘ভালোবাসার সুখ দুঃখ’ বইটি ৮৭ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। এখন কোনো মেলায় কোনো লেখকের বই ৩০০ কপি বিক্রি হলেই প্রকাশক খুশি। অবস্থাটা এমন হয়েছে বেশ কিছু কারণে। প্রথমে আসে টেলিভিশন। আকাশ সংস্কৃতি। খুললেই অসংখ্য চ্যানেল। দেশ-বিদেশের নানা খবর, অনুষ্ঠান, খেলাধুলা গান এবং রিয়েলিটি শো’র কত কত আয়োজন। এরপর এলো মোবাইল ফোন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ছাপার অক্ষর থেকে মোবাইল স্ক্রিনে সময় পার করায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে মানুষ।
বই মেলা হয়। গ্রন্থিক যেন ঘরে। বিপুল পরিমাণ প্রকাশকও। কিন্তু বই সম্পাদক কোথায়? বলা হচ্ছে পাণ্ডুলিপি ও টাকা দিলেই বই ছাপা হয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই সব প্রকাশক এমন বাছ-বিচার না করে বই ছাপছেন না। কিন্তু বই আসছে হাজার হাজার। ছাপার আগে পড়তে হয়, লেখা জানতে হয়, শিখতে হয়। সে আর হয় না। তাই গ্রন্থ-সংস্কৃতিও আর গড়ে ওঠে না। বইয়ের সাথে শিক্ষা-অনুশীলন-পরিশীলনের এই সম্পর্ক নিয়ে গভীর কোনো ভাবনা দেখা যায় না।
বই লেখক অসংখ্য। কিন্তু বই প্রেমিক পাওয়া যায় কম। বই সাধকতো আরও নেই। এ কারণেই আশঙ্কা আছে যে, বইমেলার পরিধি যত বাড়ছে, বই পড়ার অভ্যাস ততই অন্তর্হিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সাহিত্য জগতের চরিত্রটা এমন যে, বড়লোকেরা কোনোকালেই তেমন একটা বই-টই কেনেন না। তাদের বাড়িতে বিদেশি বইয়ের সম্ভারই চোখে পড়ে। মেলার ভিড়ে হানা দিয়ে কেনার আগ্রহ হয় না ওদের। তবে ইদানীং কিছু বড়লোক লেখকও দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাধর আমলা ও রাজনৈতিক লেখকও আছেন যারা বই লিখছেন, পাঁচ তারকা হোটেল বা ক্লাবে প্রকাশনা উৎসবও হচ্ছে তাদের বইয়ের। সেটা বই পড়ার অভ্যাস বাড়াতে বা বই সংস্কৃতি গড়তে কোনো অবদান রাখছে না, সেটা আমরা জানি। গরিব নিম্নবিত্তের বই কেনার সঙ্গতি নেই। একমাত্র ভরসা মধ্যবিত্ত।
পাণ্ডুলিপি ও টাকা দিলেই বই ছাপা হয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই সব প্রকাশক এমন বাছ-বিচার না করে বই ছাপছেন না। কিন্তু বই আসছে হাজার হাজার। ছাপার আগে পড়তে হয়, লেখা জানতে হয়, শিখতে হয়। সে আর হয় না।
বইমেলার আনুষ্ঠানিক ভারী মঞ্চে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পার করে প্রতিদিনই পণ্ডিতজনেরা কঠিন কঠিন বিষয়ে আলোক বিতরণ করেন। কিন্তু গ্রন্থপাঠ বাড়ে না। কিন্তু হাল ছাড়লে কি চলে? অসময়ের মধ্যেই তো সুসময় নির্মাণে সচেষ্ট থাকতে হয়। এসব বক্তৃতা জরুরি, কিন্তু তার চেয়েও জরুরি বই মেলায় আসা, ঘোরাফেরা করার হুজুগ নিছক হুজুগই যেন না থাকে তার প্রয়াস চালানো।
লেখকরা রয়্যালটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। লেখালেখি করে জীবন চলে না। কিন্তু বইয়ের বাণিজ্যতো লোকসানই নয়। বেশ কিছু প্রকাশকের জৌলুসের জীবনও চোখে পড়ে। তাহলে লেখকদের এমন করুণ হাল কেন? এর অর্থ হলো – বইয়ের বাজার আছে, কিন্তু প্রকাশনার প্রাতিষ্ঠানিকতা নেই। লেখক কী লিখলেন, তথ্য ও যুক্তি কতদূর ঠিক থাকল সেটি দেখা যেমন জরুরি, তেমনি প্রয়োজন লেখকদের রয়্যালটির বিষয়টাতে খেয়াল রাখা।
বই প্রকাশ একটি উৎপাদনমুখী কাজ। বই উৎপাদন বলতে প্রচ্ছদ, বাঁধাই, কাগজ ও ছাপা বুঝি আমরা। কিন্তু পাণ্ডুলিপি থেকে বই হয়ে ওঠার পুরো প্রক্রিয়াটি আসলে বেশ যত্ন দাবি করে। তেমনি দাবি করে সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত উদ্যোগী উদ্যম যেন গ্রন্থ সংস্কৃতি গড়ে উঠে।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি