নারীর চ্যালেঞ্জ, নারীর অগ্রযাত্রা
অগ্রযাত্রা শব্দটার মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা লুকিয়ে থাকে যেটা মূলত কয়েকটা কালকে সংযুক্ত করে এগিয়ে চলে। কালের ব্যাপ্তি হতে পারে দশক, হতে পারে অর্ধ শতাব্দী অথবা শতাব্দী পরিমাণ।
ধাপে ধাপে কালের সেই যাত্রা সমাজকে কখনো অগ্রবর্তী করেছে কখনো আবার পশ্চাৎমুখী। কারণ যাপনের প্রতিটা পদক্ষেপেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আছে, আছে আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতা, আছে অবদমন করার নেতিবাচক মানসিকতা।
বিজ্ঞাপন
হাওয়া কোনদিকে বইবে সবক্ষেত্রেই সেটা নিয়ন্ত্রণ করে সক্ষম কোনো একটা চরিত্র; হতে পারে সেটা পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র। একশ বছরের বাঙালি নারীর জীবনাচরণ বিশ্লেষণ করলে একটা প্যারাডাইম শিফটিং টের পাই। যেটা একদিনে ঘটেনি। এর পেছনে আছে অত্যাচারের ইতিহাস, বঞ্চনার ইতিহাস।
আরও পড়ুন >>> উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা
খুব বেশিদূর যেতে হবে না আমাদের দুই প্রজন্ম আগের নারী অর্থাৎ নানি কিংবা দাদির যদি কথা বলি, তারা পরিবারের সদস্য হিসেবে কতটুকু সম্মান পেয়েছে তা সেই সময়ের সমাজব্যবস্থা সম্বন্ধে যাদের ধারণা আছে তারাই ভালোভাবে জানেন।
পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তো আরও অনেক পরের হিসাব! তাদের আগের প্রজন্মের কথাতো ভয়েই ভাবতে পারি না! কোনো বংশীয় নারী ঘরের বাইরে যান না, কাজ করে উপার্জন করে না এসবই তাদের পারিবারিক শিক্ষা এবং সংসারের অন্যতম গুণ হিসেবে শেখানো হতো।
বর্তমান প্রজন্মের আমরা অনেক অনেক ভাগ্যবান বলবো কারণ আমাদের সামনে এখন অবারিত পৃথিবী। যেখানে টাকা মুখ্য মূলধন না, মূলধন হলো আইডিয়া। পুরো পৃথিবী চলছে আইডিয়া, ইনোভেশন আর ইমপ্লিমেন্টেশনের ওপরে...
আমি বিশ্বাস করি প্রত্যেক প্রজন্মে এক দুইজন করে আলোকবর্তিকা সমাজকে আলো দিতে আসেন। সেইসূত্রে অসূর্যম্পশ্যা বাঙালি নারীদের আলো দিতে এসেছিলেন বেগম রোকেয়া, এসেছিলেন সুফিয়া কামাল। তুলনামূলকভাবে নানি দাদির পরের প্রজন্ম বেশ খানিকটা আলো পেয়েছেন।
তারা ঘরের বাইরে গিয়েছেন। লেখাপড়া শিখে পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করার মানসিক শক্তি অর্জন করতে পেরেছেন। যদিও কোনো পরিসংখ্যান নেই যে সংখ্যাটা আসলে কত! আমি প্রায়শই এই পরিসংখ্যানের অভাববোধ করি।
আরও পড়ুন >>> মেয়েতো কালো
তবে বর্তমান প্রজন্মের আমরা অনেক অনেক ভাগ্যবান বলবো কারণ আমাদের সামনে এখন অবারিত পৃথিবী। যেখানে টাকা মুখ্য মূলধন না, মূলধন হলো আইডিয়া। পুরো পৃথিবী চলছে আইডিয়া, ইনোভেশন আর ইমপ্লিমেন্টেশনের ওপরে।
ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার এই সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কাজে লাগিয়ে নারীরা ব্যবসামুখর হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস-এর হোলসেল অ্যান্ড রিটেইল ট্রেড সার্ভে-২০২০ সালের জরিপ বলছে, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ছিল ২ লাখেরও বেশি যা ২০০২-০৩ অর্থ বছরে ছিল মাত্র ২১ হাজার (বিবিসি বাংলা, ৩০ নভেম্বর ২০২১)। তবে বিষয়টা যত সহজ মনে হচ্ছে আসলে ততটা না।
যেকোনো পেশার জন্য প্রয়োজন হয় সেই বিষয়ের ওপরে সামগ্রিক জ্ঞান। নারীর চ্যালেঞ্জের জায়গা আসলে এখানেই। অমুকে করছে, তমুকে করছে সুতরাং তিনিও পারবেন বলে খুশিতে দুই চারদিনের জন্য ব্যবসা করতে আসলেন। এসে যে কয়দিন টিকে ছিলেন নিজের অজ্ঞতার জন্য শুধু মার্কেটটাই নষ্ট করলেন। বুঝলেনও না কী করলেন!
পণ্যের প্রাইসিং করারও যে একটা নিয়ম আছে বেশিরভাগ উদ্যোক্তা/ব্যবসায়ী সেটা জানেন না। বাজার থেকে কোনো পণ্য কিনে এনে মূল দামের চেয়ে ১০০ টাকা বেশিতে বিক্রি করলেই ভাবেন যাক অনেক লাভ করেছি! কোনো বিজনেস মডেল নেই। প্রতিদিনকার বুক কিপিং নেই। ক্যাশ ফ্লো, ব্যালান্স শিট, বিজনেস ফোরকাস্ট এসবের কোনোকিছু সম্বন্ধেই তাদের ধারণা নেই। আর ধারণা না থাকার কারণে ব্যাংক থেকে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা ঋণ থেকে তারা প্রতিবছর বঞ্চিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন >>> নারী মরে গেলেও কেন কুৎসা থামে না?
আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমি যখন স্কুলে যাই তখন গ্রাম ও মফস্বল ছিল সবরকম আধুনিক সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চল। বিদ্যুৎ ছিল না। ভাবছি এখনকার স্কুলগামী প্রজন্ম যদি জানে যে ইন্টারনেট ছিল না নিশ্চয়ই নাক শিটকে জিজ্ঞেস করবে আপনার ছোটবেলায় ইন্টারনেট ছিল না! ওমা কেন ছিল না? নেটে গেইম না খেলে কেমনে সময় কাটিয়েছেন?
চলন বিলের খরা মৌসুমে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে পায়ে হেঁটে যেতে হতো কিংবা অবলম্বন ছিল গরু মহিষের গাড়ি আর বর্ষাকালে অবধারিতভাবে নৌকা। আমার হাতেখড়ি হয়েছে হারিকেনের আলোয় সেটা হয়তো আমার সন্তানদের কাছেও অবিশ্বাস্য লাগবে শুনতে। অথচ তেমন গ্রামে বসবাস করেও আমি সেই ছোটবেলাতেই দেখেছি লিকুইড ফাউন্ডেশন, ব্লাশনসহ সাজুগুজুর আরও অসংখ্য আধুনিক উপাদান! সবই ফুপুদের কল্যাণে।
তাদের দেখেছি স্লিভলেস জামা পরতে, নিজের হাতে নান্দনিক সব ডিজাইনার পোশাক বানিয়ে পরতে, সেইসাথে আরও অনেক অনেক কিছু, যেসব গ্রামাঞ্চলের প্রত্যেকের কাছে ছিল রাজ্যের বিস্ময়। তাদের জীবনাচরণ আমার ভেতরে আজন্ম রুচিবোধ তৈরি করে দিয়েছে। অথচ কালের বিবর্তনে তাদেরই একজনের মুখে শুনতে হয়েছে—গান শেখো কেন? গান শেখা পাপ। ঐ যে সেই এক যাপনের রাজনীতি! তিনি তার পূর্বের সমস্ত জীবনাচরণ ভুলে আপাদমস্তক প্রভাবিত হয়েছেন কিংবা শিকার হয়েছেন বিশ্বাস নামক অন্ধ এক আধিপত্যের রাজনীতির।
আরও পড়ুন >>> নারী নির্যাতন কেন বন্ধ হচ্ছে না?
আগে পিছে বেশ কয়েকটা প্রজন্ম দেখার সুযোগ হওয়ার কারণে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ফারাক তাই খুব সহজেই চোখে পড়ে। গ্রাম ও মফস্বলে বাড়ির কন্যাকে পড়ালেখা করানোর উদ্দেশ্য ছিল ভালো ঘর দেখে পাত্রস্থ করা। পাত্রপক্ষ কনেকে চাকরি করতে বাধা দিলেও তার পড়ালেখা জানা মূল্যায়ন করতো। সেই হিসেবে মেয়েদের পড়ালেখা ছিল প্রতিষ্ঠিত পাত্র পাওয়ার জন্য একটা ট্রামকার্ড।
নারীরা এখন নিজের উদ্যমের জায়গা, দক্ষতার জায়গা ব্যবসা খাতে রূপান্তর করে উপার্জন করছে। নারীর মত প্রকাশের ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীনতা সবকিছুর মূলমন্ত্র হলো অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা।
পরিবারের মতামতের বিরুদ্ধাচরণ করে নারীর পক্ষ থেকে বিয়ের বিপক্ষে খুব জোরালো নিষেধাজ্ঞা আসতো না কারণ সেই সময়ের সমাজ নারীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে সংসার আর সন্তান পালনই তার বড় ধর্ম। সুতরাং বিয়ের পর তাদের কেউ কেউ ঘর-সংসার সামলানোর পাশাপাশি সূচিকর্ম, কুশিকাটার কাজ, সেলাই যা করে তারা আনন্দ পায় সেসব করেই জীবন পাড় করে দিয়েছে।
অবসরে অনেকেই প্রতিবেশীর ফরমায়েশি কাজ করে দিতো তবে সেটা কোনো অর্থের বিনিময়ে না কারণ; বিনিময় মূল্য সেই সময় অসম্মানের ভাবা হতো। জানেন তো এটাও সমাজের একটা সূক্ষ্ম রাজনীতি! নারীর হাতে টাকা না আসার রাজনীতি।
আরও পড়ুন >>> সিরিয়ালের নারী বনাম কর্মক্ষেত্রের নারী
টাকা আসা মানেই নারীর ক্ষমতার্জন। ঠিক এখন এই ডিজিটাল যুগে এসে আমার ভেতরে প্রচণ্ড দুঃখবোধ কাজ করে তাদের দক্ষতার জায়গা উপার্জন খাতে রূপান্তরের সুযোগ ঘটানো যায়নি বলে। তাদের শিল্পীসত্তা ‘ওসব তো মেয়েদেরই কাজ’ বলে মূল্যায়ন করা হয়নি ভেবে। এই জায়গায় এখন বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে।
নারীরা এখন নিজের উদ্যমের জায়গা, দক্ষতার জায়গা ব্যবসা খাতে রূপান্তর করে উপার্জন করছে। নারীর মত প্রকাশের ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীনতা সবকিছুর মূলমন্ত্র হলো অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা।
বেগম রোকেয়া ১৯০৫ সালে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামক একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। একশ বছর আগে তিনি তার গল্পে বাঙালি নারীর ক্ষমতায়নের রূপরেখা দাঁড় করিয়েছিলেন। আগেই বলেছি যাপনের প্রতিটা পদক্ষেপই রাজনৈতিক! বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ ছিল সমাজে নারীর অবরুদ্ধ অবস্থান পরিবর্তনের জন্য একটা রাজনৈতিক পদক্ষেপ।
আরও পড়ুন >>> বাল্যবিবাহ উপসর্গ মাত্র, মূল ব্যাধি পিতৃতন্ত্র
নারীর অগ্রযাত্রা ও পশ্চাদমুখীতার অনেকখানি দায় তো নারীর নিজেরও। আলোর দিকে চেয়ে থেকে কেউ যদি শুধু অন্ধকার হাতড়ে বেড়ায় সেটা ব্যক্তির একান্তই নিজস্ব রাজনৈতিক চেতনা। নিজের জীবনের পটচিত্র সবসময় নিজেকেই আঁকতে হয়। সেটা একেবারেই নিজের সাথে নিজের রাজনীতি।
যুগে যুগে চোখের সামনে আলো ধরে রাখা মানুষগুলো রাজনীতির অন্তরালে থেকে আপনার পটচিত্র আঁকতে অনুঘটকের কাজ করে যাতে আপনি সফল হন। সুতরাং নিজেকে ভালোবাসুন সেইসাথে ভালোবাসুন টেকনোলজি। বিশ্বাস করুন নতুন আগামী আপনার।
ওয়ারেছা খানম প্রীতি ।। প্রেসিডেন্ট, হার-ই ট্রেড