আমাদের আদর্শিক মুক্তির বাস্তবতা
শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে উন্মুখ গোটা দেশ। করোনা মহামারি তাতে বাদ সেধেছে, কিন্তু বাধা হয়ে উঠতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর তো একশ, বাংলাদেশের কত? প্রশ্নটা কেমন যেন হয়ে গেল।
জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্মের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের প্রস্তুতিও তো পূর্ণমাত্রায় চলমান। কিন্তু যদি বলা হয় এই সতেরোতে বাংলাদেশেরও একশ, বোধকরি খুব একটা ভুল বলা হবে না।
বিজ্ঞাপন
চর্যাপদ থেকে শুরু করলেও বাঙালির যে হাজার বছরের ইতিহাস, সেখানে কোথাও বাঙালির কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের উল্লেখ যেমন নেই, নেই তেমনি বাঙালির কোনো স্বাধীন শাসকের অস্তিত্বও। বাঙালি জাতির ইতিহাসে তার প্রথম স্বাধীন ঠিকানা বাংলাদেশ, আর তার প্রথম স্বাধীন শাসক এদেশের ভূমিপুত্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আরও পড়ুন : সম্প্রীতি ফিরে আসার প্রত্যাশায়
আসলে বাংলাদেশ নামক আজকের এই জাতি রাষ্ট্রের ধারণাটিও বঙ্গবন্ধুরই। ‘হাতমে বিড়ি মু মে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ করাচি বা লাহোরের স্লোগান নয়, এই স্লোগানে সরগরম ছিল সাতচল্লিশে ঢাকার রাজপথ। সেই বাঙালি জাতিকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখানো থেকে শুরু করে সেই স্বপ্নটি বাস্তবায়নের স্বপ্নপুরুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তিনি সেইসব বিরল জাতির পিতাদের অন্যতম, যিনি তার জীবদ্দশায় তার জাতিকে একটি স্বাধীন পতাকা উপহার দিয়ে গিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এই বাংলাদেশের নাম, আমাদের জাতীয় সংগীত, জাতীয় চার মূলনীতি আর এমনকি আমাদের জাতীয় স্লোগানটি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুরই ঠিক করে দেওয়া।
বাঙালি জাতিকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখানো থেকে শুরু করে সেই স্বপ্নটি বাস্তবায়নের স্বপ্নপুরুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সেইসব বিরল জাতির পিতাদের অন্যতম, যিনি তার জীবদ্দশায় তার জাতিকে একটি স্বাধীন পতাকা উপহার দিয়ে গিয়েছেন।
তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে এই জাতিকে স্বাধীন করেছেন এবং এই প্রক্রিয়ায় তিনি যাদের বিরাগভাজন হয়েছেন তাদের রুদ্র রোষের চরম মূল্য চুকাতে গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিকে নিজের ও নিজের পরিবারের সদস্যদের রক্তে পবিত্রতর করেছেন। কাজেই বঙ্গবন্ধুর যেদিন শতক, বাংলাদেশের নয় কেন? বঙ্গবন্ধু তো বাংলাদেশেরই সমার্থক, বঙ্গবন্ধুই তো বাংলাদেশ।
আরও পড়ুন : রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!
আজকে যখন কখনো ভাস্কর্য, কখনো ৭ মার্চ, কখনো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্কে জাতিকে আবারো বিভ্রান্ত করায় তৎপর একদল চিহ্নিত পাক চাটুকার, তখন তাদের স্বল্পমেয়াদি উদ্দেশ্যটা খুবই পরিষ্কার। তারা বিতর্কিত করতে চায় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীকে।
আমরা ফুঁসে উঠব, সোচ্চার হব, কখনো রাজপথে মানববন্ধনে, কখনো বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস চর্চায়, আর ঠিক তখনই আবারো গর্তে ঢুকবে এসব ‘বাংলাস্তানিরা’। আমরা সন্তুষ্টির ঢেঁকুর তুলব, আবারো বিশ্বাস করব আমরা, আবারো ওদের পরাজিত করেছি আর ভুলে যাব ওদের যত অসভ্যতা।
ওরা ঠিকই ফিরে আসবে আবারো সুযোগ বুঝে ছোবল দিতে। আমাদের বুঝতে হবে ওদের দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্যগুলো। বারবার এই বিভ্রান্তির বাতায়ন সৃষ্টি করে ওরা আমাদের বিশ্বাসের আর বোঝার জায়গাগুলোকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দিচ্ছে।
আমরা নিজেদের অজান্তে ‘ভাস্কর্য বনাম প্রতিমা’, ‘শবে বরাত, না শবে বরাত না’ ইত্যাদি যত বিভ্রান্তির মারপ্যাঁচে জড়িয়ে নানা দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ছি। আর এই সুযোগে তারা ক্রমেই জায়গা করে নিচ্ছে আমাদের ভেতরে।
বাংলাদেশের নাম, আমাদের জাতীয় সংগীত, জাতীয় চার মূলনীতি আর এমনকি আমাদের জাতীয় স্লোগানটি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুরই ঠিক করে দেওয়া।
আমরা আমাদেরই প্রতিপক্ষ মনে করছি, আর কখনো কখনো ওদেরই মনে করছি আপন। এই আপন-পরের বিভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে আসার সময় এইটাই, বঙ্গবন্ধু যখন শতবর্ষে আর বাংলাদেশ পঞ্চাশে। আর এটি যদি না করা যায়, তবে তার যে পরিণতি সেটা তো আমাদের চোখের সামনেই দেখেছি এই সেদিন, যেদিন ক্যাপিটালে গণতন্ত্রের ব্যবচ্ছেদে ক্যাপিটালের অন্য প্রান্তে লিংকন মেমোরিয়ালে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল আমেরিকার স্থপতি আব্রাহাম লিংকনের।
আরও পড়ুন : তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?
অন্ধকারের শক্তিকে শেষবারের মতো ভাগাড়ে ঠেলে দিতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে বঙ্গবন্ধুর কাছেই। করতে হবে বঙ্গবন্ধুর অপূর্ণ স্বপ্নের বাস্তবায়ন। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের মূল নির্যাস ছিল স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির ক্ষমতায়ন।
বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে নির্বাচনে কে হারল, আর কে জিতল তা মুখ্য ছিল না, কারণ যেই জিতুক না কেন সে তো হবে একাত্তরে বিশ্বাসী, অসাম্প্রদায়িক চেতনার একজন মানুষ, যার আনুগত্য শুধুই বাংলাদেশের প্রতি।
যাদের হৃদয়ে ‘পেয়ারে পাকিস্তান’ তারা থাকুক এদেশে আপত্তি নেই, কিন্তু তারা থাকবে ক্ষমতা আর নীতি নির্ধারণের গণ্ডি থেকে শত মাইল দূরে। এটিই আমাদের আদর্শিক আর নৈতিক মুক্তির বাস্তবতা, আর এই বাস্তবতাটি বাস্তবায়নের মধ্যেই আমাদের দীর্ঘমেয়াদে মুক্তি।
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) ।। ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ