তবুও মানুষ বই ভালোবাসুক
কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। লেখা ছিল—‘হাসান আজিজুল হক কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন—বইমেলা দুই ভাগে ভাগ করে দিক। ২৩ দিন সেলিব্রেটি লেখক আর সব সেক্টরের সেলিব্রেটিদের জন্য থাকুক। থাকুক মন্ত্রী, এমপি, ধনী ব্যবসায়ী, তাদের স্ত্রী-সন্তানদের জন্য। থাকুক মৌসুমী লেখক-কবিদের জন্য।
আর মাত্র ৫টি দিন থাকুক লেখালেখি যাদের জীবনের ব্রত, এমন লেখক-কবিদের জন্য। এই পাঁচদিন হয়তো দর্শকের বদলে মাছি থাকবে মেলার মাঠে। তবে ভালো বইগুলো অন্তত আবর্জনার চাপে ঢাকা পড়ে থাকবে না।’
বিজ্ঞাপন
অমর একুশে বইমেলার কেটে গেছে অর্ধেকের বেশি সময়। প্রথম দিকে কিছুটা ফাঁকা ফাঁকা থাকলেও এখন পুরোদমে জমে উঠেছে মেলা। প্রায় প্রতিদিন এখন মেলার মাঠ মুখর থাকছে পাঠক দর্শনার্থীর আগমনে।
আরও পড়ুন >>> বাংলালিপি : উৎস ও বিবর্তন
মেলায় প্রতিদিন প্রকাশ হচ্ছে অনেক বই। কিছুক্ষণ পরপর বাংলা একাডেমির ঘোষণা মঞ্চ থেকে জানানো হচ্ছে নব প্রকাশিত বইয়ের তথ্য। প্রতি বছরই ঘুরে ফিরে একটা প্রশ্ন আসে—এত এত বইয়ের মধ্যে ভালো বই কয়টা?
প্রশ্ন আরও আছে—বইমেলায় পাঠকের চেয়ে লেখক কি বেশি? প্রশ্নগুলো যে একেবারে অবান্তর তা কিন্তু নয়। মেলা এলেই প্রতিবছর দেখা যায়—সমাজের নানা স্তরে বিভিন্নভাবে এগিয়ে থাকা, প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাদের স্বজনদের বই প্রকাশের হিড়িক লাগে।
ইদানীং বইয়ের প্রচারের দায়িত্ব পুরোটা চেপেছে লেখকের কাঁধে। প্রকাশক এখানে দায়হীন। শুধু কিছু তারকা লেখকের বই নিয়ে প্রকাশকের মাতামাতি থাকে। আর কাউকে নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই...
ঘটা করে প্রকাশনা উৎসব হয় এসব বইয়ের। তারচেয়েও ঘটা করে চলে সেলফি উৎসব। লেখক নিজেই দুই তিনশ কপি বই কিনে নেন। প্রকাশকের লগ্নি উঠে যায় তাতে। আর সেইসব অতি প্রভাবশালী এবং অল্প প্রভাবশালীরা নিজের নামের সঙ্গে লেখক তকমা লাগিয়ে স্টলের মধ্যে হাসি হাসি মুখ করে বসে থাকেন।
পরিচিত মানুষজন ধরে এনে হাসিমুখে অটোগ্রাফ বিলান। আর এদিকে অখ্যাত যে তরুণ নিজের মেধার সবটুকু খাটিয়ে একটা ভালো বই লিখেছেন—তিনি থেকে যান প্রচারের আলোর বাইরে।
প্রচার প্রসঙ্গ যেহেতু এলো তা নিয়ে আরও কয়টা কথা বলা যেতে পারে। ইদানীং বইয়ের প্রচারের দায়িত্ব পুরোটা চেপেছে লেখকের কাঁধে। প্রকাশক এখানে দায়হীন। শুধু কিছু তারকা লেখকের বই নিয়ে প্রকাশকের মাতামাতি থাকে। আর কাউকে নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই।
আরও পড়ুন >>> রাষ্ট্রভাষা: বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
বলছিলাম প্রভাবশালী ব্যক্তিদের লেখক হয়ে ওঠার বাসনার কথা। এছাড়া আরেক শ্রেণির লেখক আছে। যাদের বলা চলে স্তাবক লেখক। নিজে কি লিখলেন না লিখলেন তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। আগ্রহও নেই। ওইসব প্রভাবশালী মৌসুমি লেখকের সুনামেই কাটে তাদের দিন।
আরেক শ্রেণির লেখক আছে- যারা কোনোমতে একটি বই প্রকাশ করতে পারলে, হন্যে হয়ে টিভি ক্যামেরার পেছনে ঘোরেন। তাদের ভাবনা হচ্ছে কোনোমতে একটা টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিতে পারলেই জীবনে মোক্ষলাভ যাবে।
অনেকেই বলেন, নতুন লেখক উঠে আসছে না। এখানেও কিছু কথা আছে। বইমেলায় এবার অংশ নিয়েছে চারশোর বেশি প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে কোন প্রকাশনী থেকে কী বই বের হয়েছে, পাদ প্রদীপের আলোয় না থাকা একজন লেখক কী লিখেছেন—তা জানা বা খুঁজে বের করা একজন সাধারণ পাঠকের পক্ষে কতটা সম্ভব?
ওইদিন মেলার মাঠের আড্ডায় একজন বলছিলেন—বইয়ের প্রচার তেমন না থাকায় মানুষজন আসে না। কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরেন। কিন্তু অখ্যাত লেখকের ভালো বই খুঁজে বের করতে না পেরে শেষে পরিচিত লেখকদের বই কিনে বাড়ি ফিরে যান।
কোন প্রকাশনী থেকে কী বই বের হয়েছে, পাদ প্রদীপের আলোয় না থাকা একজন লেখক কী লিখেছেন—তা জানা বা খুঁজে বের করা একজন সাধারণ পাঠকের পক্ষে কতটা সম্ভব?
আর দীর্ঘশ্বাস ফেলেন—নতুন লেখক উঠে আসছে না। কথাটা কতটুকু সত্যি জানি না। তবে বিষয়টি একেবারে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার মতো না।
একটা কথা বলি। বাংলা একাডেমি প্রতি বছর মেলা আয়োজন করে বটে। তবে মেলাকে এখনো পাঠক বান্ধব করতে পারেনি। প্রতি বছর স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয় লটারির মাধ্যমে। এটা নিয়ে আমার আপত্তি আছে।
যেসব প্রকাশক ভালো বই প্রকাশ করেন কিংবা যাদের বই বেশি চলে তাদের অবশ্যই ভালো জায়গায় স্থান দেওয়া উচিত। লটারি নামক ভাগ্য নির্ধারণী খেলায় তাদের ঠেলে দেওয়া কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য না। এছাড়া এত বেশিসংখ্যক প্রতিষ্ঠান নিয়ে মেলা করা উচিত কি না তাও ভেবে দেখার কথা বলছি।
আরও পড়ুন >>> একুশের উচ্চারণ দূর হ দুঃশাসন
গেল কয়েক বছর ধরেই একটা কথা খুব উঠছে মেলার মাঠে। মেলায় কোনো চায়ের দোকান নেই। আছে নির্দিষ্ট একটি কফির দোকান। তাদের কয়েকটি আউটলেটে বিস্বাদ কফি বিক্রি হয়। মেলায় আসা লেখক পাঠক সব মানুষই বাধ্য হচ্ছেন এই কফি খেতে। কয়েক বছর ধরেই এই অবস্থা! কেন?
বাংলা একাডেমি কোন স্বার্থে এই কাজ করে যাচ্ছে? মেলায় খাবার দোকান নিয়েও আছে অনেক কথা। খাবারের দোকানগুলোর জন্য বিশাল এলাকা বরাদ্দ করেছে বাংলা একাডেমি। তারা গলাকাটা দামে বিক্রি করছে খাবার। একটি পিঠার দাম নাকি তারা রাখছে ৫০ টাকা। অথচ মেলা চত্বরের ঠিক পাশেই টিএসসি এলাকায় একই পিঠা বিক্রি হচ্ছে দশ টাকায়! খাবারের চড়া দাম থেকে এক দর্শনার্থীর প্রশ্ন, এটা কি বাণিজ্য মেলা?
অনেকেই বলছেন, এবার নাকি বইয়ের বেচাবিক্রি কম। জানি না কোন পরিসংখ্যান থেকে বলছেন। তবে আমার প্রত্যাশা—মানুষ বই ভালোবাসুক।
খান মুহাম্মদ রুমেল ।। অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর, সময় টিভি