ছবি : সংগৃহীত

তুরস্কের ভয়াবহ ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর প্রতিবেশী সিরিয়ায় মারা গেছে সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ। ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে ভূমিকম্প হয়। তুরস্ক ছাড়াও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকাও ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গেছে।

হাজার হাজার ভবন ধসে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে মৃতদেহ ও আহতদের উদ্ধার করা হয়েছে। স্বজনদের খোঁজে হাসপাতাল ও ধসে পড়া ভবনের সামনে ভিড় করছেন সাধারণ মানুষ। যখন ভূমিকম্প হয় তখন অধিকাংশ মানুষ ঘুমিয়ে ছিলেন।

তুরস্কের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ উদ্ধার করা হয়েছে। অসংখ্য মানুষ হাসপাতালে। গৃহহীন লক্ষাধিক মানুষ। তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতাই (Fuat Oktay) বলেছেন, ‘সরকারের মূল লক্ষ্য আগামী এক বছরের মধ্যে এই গৃহহীনদের জন্য স্থায়ী আবাসন প্রদান করা।’ যাতে ক্ষতিগ্রস্তরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভূমিকম্পের আঘাত ভুলে যেতে পারে।

আরও পড়ুন >>> তুরস্কে ভূমিকম্প : যে ক্ষতি অসহনীয় 

জাতিসংঘের জরুরি ত্রাণ সমন্বয়কারী মার্টিন গ্রিফিথস বলেছেন, দুই দেশে মোট মৃতের সংখ্যা বর্তমান সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি হবে। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত তুরস্ক ও সিরিয়ায় জরুরি ত্রাণের জন্য প্রায় ৮৯০ মিলিয়ন রুপি (৮.৫ মিলিয়ন ডলার) প্রাথমিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তুরস্ক ও সিরিয়ায় দ্রুত সাহায্য পাঠিয়েছে।

এছাড়া রাশিয়া, চীন, বাংলাদেশ, ভারত, ইউক্রেন, জার্মানি, গ্রিস, ইসরাইল, ইরান, জাপান, নরওয়ে, স্পেনের মতো দেশও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও তুরস্কের প্রতি তাদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কাতার তুরস্কে ১০ হাজার মোবাইল বাড়ি পাঠাচ্ছে। কাতার একটি ফিল্ড হাসপাতালের সরঞ্জাম এবং মানবিক সহায়তাও পাঠাচ্ছে।

এদিকে, বাংলাদেশে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মোস্তফা ওসমান তুরান বাংলাদেশের কাছে সাহায্য চেয়েছেন কারণ দেশটি জোড়া ভূমিকম্প এবং বহু আফটারশক দ্বারা আঘাত করা বিশাল চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে লড়াই করছে। তিনি বলেন, তারা নগদ সহায়তা পেতে আগ্রহী নন তবে শীতবস্ত্র, ওষুধ ও অন্যান্য উপকরণ বাংলাদেশ থেকে পছন্দ করা হচ্ছে।

দূতাবাসে এক সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রদূত ভূমিকম্পের পর তাৎক্ষণিকভাবে এগিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আরও জীবন বাঁচাতে আগামী এক বা দুই দিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস এবং অন্যান্যদের সমন্বয়ে ৪৬ জন বিশেষজ্ঞের বাংলাদেশি অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দলের কথা উল্লেখ করে তুর্কি কূটনীতিক বলেন, দলটি গাজিয়ান্তেপে কাজ করবে যেখানে এখনো ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়ে আছে।

আরও পড়ুন >>> তুরস্কে ভূমিকম্প : যে শিক্ষা নিতে পারে বাংলাদেশ 

৯ ফেব্রুয়ারি ‘তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য শোক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার জন্য বাংলাদেশকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এই সংহতির কাজটি কখনই ভুলব না।’

তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, তুরস্ক ও সিরিয়ায় এমন বিপদের দিনে বাংলাদেশ সরকার ও এদেশের জনগণ তাদের পাশে আছে।

শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন। এর আগে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদও পৃথক বাণীতে শোক প্রকাশ করেন।

সিরিয়ার ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ওষুধ, সোয়েটার, শুকনো কেক, বিস্কুট, কম্বল, তাঁবুসহ ১১ টন পণ্য পাঠিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া মানুষদের উদ্ধারে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন উদ্ধারকারীরা। সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের সমন্বয়ে বাংলাদেশের একটি উদ্ধারকারী দলও তুরস্কে কাজ করছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে তারা ইতিমধ্যে এক কিশোরীকে জীবিত ও বেশ কয়েকটি মৃতদেহ উদ্ধার করেছে।

বাংলাদেশের অনেকের মনে দারিদ্র্য, বঞ্চনা এবং দুর্নীতির চিত্র দীর্ঘকাল ধরে রয়েছে যে এই নেতিবাচক চিত্রটি প্রকৃতপক্ষে ভূমিকম্প ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পাশাপাশি অন্যান্য দেশে উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের মানবিক কর্মকাণ্ড উপেক্ষা করে, প্রায়শই যখন অন্যান্য আরও সমৃদ্ধ এবং সম্পদ-সজ্জিত দেশগুলো তা করেনি। সময়ের মানবিক প্রয়োজনে উঠে এসেছে।

আরও পড়ুন >>> তুরস্কে ভূমিকম্প : বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত? 

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মানবিক সহায়তার নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করার চলমান প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ভূমিকম্প বিধ্বস্ত তুরস্ক ও সিরিয়ায় শুকনো খাবার, কম্বল, তাঁবু এবং ওষুধের মতো জরুরি ত্রাণ সরবরাহ করা প্রশংসনীয়।

বাংলাদেশের সময়োপযোগী মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি খাদ্য, আশ্রয় এবং সামাজিক পরিষেবার তীব্র ঘাটতি এড়াতে, সিরিয়া ও তুরস্কের মৌলিক আর্থ-সামাজিক সহায়তা নিশ্চিত করতে এবং দেশ পুনর্গঠনে কার্যকরভাবে অবদান রাখতে পারে।

এটি আঞ্চলিক ভ্রাতৃত্ব, মানবিকতা, দক্ষিণ এশিয়া, মুসলিম বিশ্বের সমন্বিত উন্নয়ন এবং কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক প্রান্তিককরণ নির্বিশেষে সকলের প্রতি সহযোগিতার নীতির প্রতি বাংলাদেশ সরকারের অঙ্গীকারের প্রমাণ।

বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশীদের সাথে গভীর আত্মীকরণের দিকে নজর দিচ্ছে, শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী তার ভাবমূর্তি গড়ে তুলে বাংলাদেশকে ইতিবাচকভাবে ব্র্যান্ডিং করছে। দেশের ক্রমাগত মানবিক সহায়তার কার্যক্রম এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংকট, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের দখলদারিত্ব এবং বিশ্বব্যাপী সংকটে জনগণকে সহায়তা করার সক্রিয় প্রচেষ্টা দেশকে মানবিকতার প্রতীকে পরিণত করেছে।

অনেক ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ একটি চমৎকার মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। একটি দাতা দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, দেশের অনুদানের ফলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উন্নত হবে বলে আশা করা হচ্ছে, বিশ্বকে মানবিক সহায়তা প্রদানে বাংলাদেশের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে।

সুফিয়ান সিদ্দিকী ।। গবেষক