যার জঠরে জন্ম শিশুর
সন্তানের অভিভাবক কে?
আমার প্রথম সন্তানের জন্ম—বিলেতের এক হাসপাতালে। বাচ্চা জন্মেছে, জন্মের সময় আমি পাশে দাঁড়ানো, সকলেই জানে যে প্রসূতি আমার স্ত্রী, কিন্তু ওরা শিশুর হাতে লাগানো ট্যাগে ওর মায়ের নাম লিখে রেখেছে, ‘অমুকের শিশু’ এইভাবে।
গ্রিক পেডিয়াট্রিশিয়ান দাঁড়ানো ছিল আমার পাশে, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার নাম নয় কেন? আমার চোখে চোখ রেখে ফিক করে হেসে ফেললেন। তিনি বললেন, ওকে আমরা টেনে বের করলাম যার জঠর থেকে শিশুটি যে তার সন্তান সেটাই তো সত্য। এরপর আর তর্ক চলে? কিন্তু পিতৃতন্ত্র স্বাভাবিক প্রাকৃতিক সত্যকেও যৌক্তিক প্রয়োগ করবে না।
বিজ্ঞাপন
গ্রিক পুরাণেও ওরা সন্তান ও মায়ের প্রাকৃতিক এবং অনিবার্য সম্পর্কের প্রয়োগ সামাজিক ক্ষেত্রে করতে দেয়নি। পিতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করেছে যে সব শিশুই তার পিতার সন্তান, মা কেবল পিতার মালিকানায় সন্তান জন্মদানের একটি যন্ত্র বা আধার মাত্র।
আরও পড়ুন >>> মেয়েতো কালো
আমরাও সন্তানের অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক সত্যকে আড়াল করে যে বিধান গ্রহণ করেছি সেটা হচ্ছে যে, সন্তানের স্বাভাবিক অভিভাবক হচ্ছে পিতা, মা নয়। মা সুরক্ষা করবে সেটা ঠিক আছে, যতদিন শিশু স্তন পান করবে ততদিন তাকে পালন করা মায়ের দায়িত্ব, সেটাও ঠিক আছে। কিন্তু অভিভাবক হবে পিতা।
পিতার যদি এর মধ্যে মৃত্যু হয় তাহলে? তাহলে অভিভাবক হবে শিশুর বাবার সম্পর্কের কেউ একজন। দাদু, জেঠা বা বাবার বড় ভাই বা এইরকম অন্য কোনো পুরুষ আত্মীয়—মা মোটেই নয়।
অভিভাবকত্বের প্রশ্নটি জরুরি কেন?
অভিভাবকই সিদ্ধান্ত নেবে সন্তান কীভাবে বড় হবে, কোন স্কুলে পড়বে, কোন সংস্কৃতি শিখবে, কোন নৈতিকতা তাকে শেখানো হবে ইত্যাদি। আরও আছে—শিশু যদি কোনো সম্পদের মালিক হয়ে থাকে সেই সম্পদের ব্যবস্থাপনা ইত্যাদিও করবে অভিভাবক। শিশুর সম্পর্কে সেই নারী কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।
হাইকোর্ট সংবিধানের ১০২ নং অনুচ্ছেদের অধীনে রায় দিয়েছেন যে, এইসব ক্ষেত্রে সন্তান তার অভিভাবক হিসেবে মায়ের নামই লিখবে। পিতার নাম লিখতে পারছে না বলে শিশু তার নাগরিক অধিকার থেকে কেন বঞ্চিত হবে?
তাহলে সেইসব শিশুর কী হবে যাদের পিতৃ পরিচয় সামাজিকভাবে বা আইনগতভাবে সুরক্ষিত নয়? একটু নাটকীয়ভাবে বললে, আজ যদি আরেকজন যিশু খ্রিস্টের জন্ম হয়, তাহলে তার আইনগত অভিভাবক কে হবেন? মাদার মেরি? এই প্রশ্নটাই সীমিত ক্ষেত্রের জন্য এসেছিল আদালতের সামনে একটা রিট পিটিশনে।
আরও পড়ুন >>> বাল্যবিবাহ উপসর্গ মাত্র, মূল ব্যাধি পিতৃতন্ত্র
যে শিশু তার পিতার নাম লিখতে পারছে না স্কুলের বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফর্মে, সেই শিশুর অভিভাবকের নাম হিসেবে কার নাম যাবে? ওর পিতা আছে। পিতা ছাড়া তো সন্তানের জন্ম হয়নি। কিন্তু পিতা মা ও সন্তানকে স্বীকার করেনি।
হাইকোর্ট সংবিধানের ১০২ নং অনুচ্ছেদের অধীনে রায় দিয়েছেন যে, এইসব ক্ষেত্রে সন্তান তার অভিভাবক হিসেবে মায়ের নামই লিখবে। পিতার নাম লিখতে পারছে না বলে শিশু তার নাগরিক অধিকার থেকে কেন বঞ্চিত হবে? মায়ের নাম লিখে সে ঠিকই পরীক্ষা দিতে পারবে, পাসপোর্ট করতে পারবে, চাকরি ইত্যাদি সবকিছু।
সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন হাইকোর্ট
এই রায় একটা অর্জন বটে এবং নিতান্ত ছোট অর্জন নয়। এমনিতেই বিবাহবহির্ভূত সন্তানদের আমাদের সমাজে তো নানাপ্রকার গ্লানি ও গঞ্জনা সহ্য করতে হয়। কল্পনা করুন সেই শিশুর কথা, ওর পিতা ও মাতার মধ্যে বিবাহ হয়নি, তাতে শিশুর জন্ম কীভাবে কলঙ্কিত হয়!
নারী পুরুষের মিলনে জন্ম নেওয়া সব শিশুই তো প্রকৃতির বৈধ সন্তান। তবুও সমাজ সব গঞ্জনা শিশুকেই দেবে। সব আঘাত শিশুকেই করবে। আর সেই সাথে রাষ্ট্রও তাকে সব নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে সেটা কি ঠিক? ন্যায়? না।
আরও পড়ুন >>> তুমি অকুণ্ঠিতা
আদালত এটা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে যে, এইসব ক্ষেত্রে যখন কোনো ফর্মে অভিভাবকের নাম লিখতে হয় তখন মায়ের নাম লিখলেই হবে। পিতার নাম উল্লেখ না করলেও হবে। এটা এত ছোট অর্জন নয়। কিন্তু বিদ্যমান পিতৃতান্ত্রিক অচলায়তনে এই রায়ের অভিঘাত কতটুকু হবে? এটা বিস্তারিত জানা যাবে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর।
মুসলিম আইনে অভিভাবকত্ব
আমাদের দেশে মুসলিম আইনে শিশুর অভিভাবকত্ব নিয়ে যেসব পিতৃতান্ত্রিক বিধান আছে এই রায়ে সেগুলো খুব বেশি যে পাল্টে গিয়েছে সেকথা বলা যাচ্ছে না। এমনকি অভিভাবকত্ব সংক্রান্ত মুসলিম আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে নারীর প্রতি যে অন্যায় হয়, সেই অন্যায়ের ক্ষেত্রে এই রায় আদৌ কোনো পরিবর্তন আনবে না।
মুসলিম আইনে সন্তানের অভিভাবক হচ্ছে পিতা। হানাফি মতে, নাবালক সন্তানের অভিভাবক হবে পিতা। পিতার মৃত্যু হলে অভিভাবক হবে পিতার পিতা বা ভাই। কিন্তু মা কখনোই অভিভাবক হতে পারবে না।
মা অভিভাবক হতে পারে কেবল সন্তানের পিতা যদি তাকে উইল করে অভিভাবক নিয়োগ করে যায় বা আর কাউকে পাওয়া না গেলে আদালত যদি মাকে অভিভাবক নিয়োগ করে না হয় মুসলিম আইনে মায়ের কোনো অধিকার নেই সন্তানের অভিভাবক হওয়ার।
আরও পড়ুন >>> মুক্তনীলের মুক্ত বিহঙ্গ
অভিভাবকত্বের গুরুত্ব কী? এটা তো হচ্ছে সন্তানের ভবিষ্যৎ ও বড় হওয়া বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হচ্ছে শিশুর যদি কোনো জমিজমা বা স্থাবর সম্পত্তি থাকে সেটার ব্যবস্থাপনা করা।
ধরুন, একজন ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান রেখে। এই শিশু সন্তানের দেখাশোনার দায়িত্ব হয়তো মা পাবে, কিন্তু এই শিশুকে বাংলা মিডিয়ামে পড়ানো হবে, নাকি ইংলিশ মিডিয়ামে নাকি বিদেশে পড়ানো হবে সেটা নির্ধারণ করার অধিকার থাকবে শিশুর দাদার বা কাকার! .
আগে তো কোনো সরকারি ফর্মে মায়ের নামের উল্লেখই থাকতো না, এখন তো অন্তত সেটা হয়েছে। আদালতের এই রায়ের পর সীমিত ক্ষেত্রে হলেও পিতার নাম উল্লেখ না করেও শিশু সরকারি সব ফর্ম পূরণ করতে পারবে।
শিশু তার পিতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হবে বটে, কিন্তু যদি তাকে বিদেশে পড়তে পাঠানোর জন্যে জমি বিক্রি করতে হয় শিশুর মা সেটা পারবে না—দাদা অথবা কাকা পারবে। এমনকি শিশুকে নিয়ে ওর মা যদি খাবারও জোটাতে না পারে, তাহলে শিশুর মা হয়তো ঘরের ফার্নিচার বিক্রি করতে পারবে, কিন্তু জমি বিক্রি করতে পারবে না। এইটা হচ্ছে মুসলিম আইন। এটা কি অন্যায় নয়? অন্যায়।
পরিবর্তন এইখানে প্রয়োজন। আইন পরিবর্তন করে যদি নির্ধারণ করে দেওয়া হয় যে প্রতিটি শিশুর অভিভাবক হবে সেই নারী, যার জঠর থেকে তার জন্ম হয়েছে তাহলে আর ফর্মে কার নাম লিখবেন বা আদালত কাকে নির্ধারণ করে দেবে এইসব নিয়ে তর্ক করতে হবে না।
এমনকি সন্তানের যে দৃশ্যমান পিতা, সেই পিতাই তার প্রকৃত পিতা কি না সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে না। এই প্রশ্নকে নেহায়েত অপ্রাসঙ্গিক মনে করবেন না, উত্তরাধিকার নিয়ে বিবাদে ভাই ভাইয়ের জন্ম নিয়ে প্রশ্ন করছে সেরকম ঘটনাও আমরা দেখেছি।
নারীর অর্জন
হাইকোর্টের এই রায় নেহায়েত ছোট অর্জন নয়। পিতৃতান্ত্রিক এই নারী বিদ্বেষী সমাজে এইটুকু অর্জনও অনেক। এইজন্যেও আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে নারীরা ও নারী অধিকার কর্মীরা এই রায় নিয়েই অনেক উল্লসিত। কিন্তু প্রকৃত অর্জন থেকে এখনো তো আমরা রয়ে গেছি অনেক দূরে।
আরও পড়ুন >>> ২০২২ সাল নারীর জন্যে কেমন ছিল?
আগে তো কোনো সরকারি ফর্মে মায়ের নামের উল্লেখই থাকতো না, এখন তো অন্তত সেটা হয়েছে। আদালতের এই রায়ের পর সীমিত ক্ষেত্রে হলেও পিতার নাম উল্লেখ না করেও শিশু সরকারি সব ফর্ম পূরণ করতে পারবে। তথাপি স্বাভাবিক নিয়মে নারী সেই সন্তানের অভিভাবক এখনো হবে না যে সন্তানকে সে জন্ম দিয়েছে। যেতে হবে সেইখানে।
আর এইগুলো তো একটার সাথে আরেকটা সম্পৃক্তও বটে। রাষ্ট্র যদি আজ নারীকে সন্তানের স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক অভিভাবক হিসেবে মেনে নেয়, তাহলে উত্তরাধিকার আইনেও নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে হবে। নারীর জন্য তাই সব বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট