ঋণ করে যেন ঘি না খাই
অবশেষে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ। ২০২২ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়ে আবেদন করে। পরে আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে সংশ্লিষ্ট সবার সাথে বৈঠক শেষে ঋণের ব্যাপারে ইতিবাচক বার্তা দিয়ে যায়।
এরপর সংস্থার ডিএমডির সফরের পরও বোঝা গিয়েছিল আইএমএফের ঋণ পাওয়া বাংলাদেশের জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র। সেই সময় যে ৩০ জানুয়ারি, সেটাও পূর্ব নির্ধারিতই ছিল।
বিজ্ঞাপন
৩০ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত আইএমএফের বোর্ড সভায় বাংলাদেশের ঋণ প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। ফেব্রুয়ারি মাসেই ঋণ ছাড় শুরু হবে। তারপর ধাপে ধাপে বাংলাদেশ ৪৭০ কোটি ডলার পাবে।
আরও পড়ুন >>> আর কত চাপ সামলাবে?
বাংলাদেশ এবারই প্রথম আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়েছে, ব্যাপারটি মোটেই তেমন নয়। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে ১০ বার বিভিন্ন অঙ্কে আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়েছিল বাংলাদেশ। এবার আলোচনা বেশি হচ্ছে, কারণ ১০ বছর পর আবার আইএমএফের দ্বারস্থ হতে হলো বাংলাদেশকে।
এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে মোমেন্টাম পেয়েছিল, তাতে মনে হচ্ছিল, আর কখনোই আইএমএফের কাছে যেতে হবে না। কিন্তু প্রথমে করোনা এসে সেই মোমেন্টাম আটকে দেয়। করোনার ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন তার মোমেন্টাম ফিরে পাচ্ছিল, তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এসে গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশকেও টালমাটাল করে দেয়।
শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানের মতো দেউলিয়া দশা না হলেও অর্থনীতি সামাল দিতে আইএমএফের কাছে ঋণ চায় বাংলাদেশ। তবে আইএমএফের ঋণ চাইলেই পাওয়া যায় না।
আইএমএফের ঋণ পেতে তাদের শর্ত যেমন মানতে হয়, তেমনি যোগ্যও হতে হয়। আইএমএফের ঋণের টাকার অঙ্কের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো ভাবমূর্তি...
আইএমএফের ঋণ পেতে তাদের শর্ত যেমন মানতে হয়, তেমনি যোগ্যও হতে হয়। আইএমএফের ঋণের টাকার অঙ্কের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো ভাবমূর্তি। আইএমএফ ঋণ অনুমোদন করেছে, মানে বাংলাদেশ সেই ঋণ পাওয়ার যোগ্য। এখন বিশ্বব্যাংকসহ অন্য উন্নয়ন সহযোগীরাও যাচাই ছাড়াই নির্দ্বিধায় বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন >>> মধ্যবিত্তের নতুন আতঙ্ক বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি
অর্থনীতির এই টালমাটাল সময়ে আইএমএফের ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা কম নয়। তবে ১০ বছর পর আইএমএফের কাছে যেতে না হলেই ভালো হতো। আমাদের অর্থনীতির যে সক্ষমতা, তাতে আইএমএফ ছাড়াই আমরা সঙ্কটের সেতু পার হতে পারতাম। সেই আলোচনায় পরে আসছি।
আইএমএফের ঋণ নিতে না হলে ভালো হতো, এটা যেমন ঠিক, আবার এই ঋণ শাপে বর হতে পারে। আগেই বলেছি, চাইলেই আইএমএফের ঋণ পাওয়া যায় না। ঋণ পেতে যোগ্য হতে হয়, শর্ত মানতে হয়।
শর্ত মেনে ঋণ নেওয়া, শুনতে কেমন আত্মসম্মানে লাগে। কিন্তু বাস্তবতা হলো ঋণ দেওয়ার আগে আইএমএফ যে শর্তগুলো দেয়, তা বেশিরভাগই বাংলাদেশের জন্য ভালো। আমরা যদি আগেই এই শর্তগুলো পূরণ করে রাখতাম, তাহলে আর এখন আইএমএফের কথা শুনতে হতো না। আমাদের অর্থনীতিও অনেক মজবুত থাকতো।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতের বড় বড় সংস্কারগুলো হয়েছে বিভিন্ন সময়ে আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণ করতে গিয়েই। এখন যে বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে শক্ত খুঁটি ভ্যাট, তাও কিন্তু আইএমএফের শর্তেই করা। এবারও আইএমএফ ঋণ দেওয়ার আগে বেশকিছু সংস্কারের শর্ত দিয়েছে।
অনেক ছাড় দিয়েও এখন ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা, মানে ২৩ শতাংশ। ২০২২ সালেই ৩৩ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে। আইএমএফ খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার শর্ত দিয়েছে।
আরও পড়ুন >>> আইএমএফের ঋণ : স্বস্তির না শঙ্কার?
আইএমএফ শর্ত দিয়েছে, এই ইগোটুকু বাদ দিলে এই শর্তে কারোই আপত্তি থাকার কথা নয়। ১০ শতাংশ কেন, সরকারের তো আগেই ঋণখেলাপীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিয়ে মাঠে নামা উচিত ছিল। আগেই যেমন বলেছিলাম, বাংলাদেশের অর্থনীতির যে সক্ষমতা, আইএমএফের ঋণ ছাড়াও আমাদের চলতো।
একবার ভাবুন, খেলাপি হওয়া ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করা গেলে কি আর ঋণ লাগতো? আইএমএফ ব্যাংক, আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিয়েছে। কর-জিডিপি হার বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। এই সুপারিশ আইএমএফের করতে হবে কেন?
প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে মাত্র এক ভাগ মানুষ ট্যাক্স দেয়, এটা তো লজ্জার কথা। আইএমএফ বলার অনেক আগেই রাজস্ব খাত ঢেলে সাজানো দরকার ছিল। তাহলে আর ঋণ লাগতো না।
একবার ভাবুন, খেলাপি হওয়া ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করা গেলে কি আর ঋণ লাগতো? আইএমএফ ব্যাংক, আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিয়েছে। কর-জিডিপি হার বাড়ানোর সুপারিশ করেছে।
যেদিন পত্রিকায় আইএমএফের ঋণের খবর, তার পাশেই আরেকটি খবর, দুর্নীতিগ্রস্থ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের একধাপ পতন ঘটেছে, ১৩ থেকে ১২তে নেমেছে। ভাবুন একবার, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি বন্ধ করা গেলে তো আইএমএফের ঋণ লাগতোই না।
আইএমএফের শর্ত মেনে এরই মধ্যে তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। আরও বাড়ানো হবে। আমরা যদি আগেই জ্বালানি খাতকে একটা শৃঙ্খলায় রাখতাম, সিস্টেম লসের নামে চুরি বন্ধ করতাম, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ না দিতাম; তাহলে আজ আইএমএফের কথা শুনতে হতো না; হয়তো ঋণই নিতে হতো না।
আরও পড়ুন >>> মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা
চারপাশে এমন হাজারটা অপচয় আর দুর্নীতির উদাহরণ। যেগুলো ঠেকাতে পারলে কারো সহায়তা বা ঋণ ছাড়াই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারতো। কারো শর্ত মানতে হতো না।
আমার ভালো তো আমিই বুঝবো, আইএমএফকে বলতে হবে কেন? এই সঙ্কটের সময় যেন আমরা দুর্নীতি, দুঃশাসন, অপচয়, অবহেলা, অদক্ষতা পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাই। তবে বলা যত সহজ, করা ততই কঠিন।
কিছু লোক নিশ্চয়ই ওত পেতে আছে, আইএমএফের টাকা এলেই সেখান থেকে কিছু মেরে দিয়ে কানাডার বেগমপাড়ায় আরেকটা বাড়ি কেনা যায় কি না। হা হা হা। এটা কিন্তু সোনালী বা বেসিক বা ফার্মার্স ব্যাংকের লোন নয় যে মেরে দিয়ে পগাড় পাড় হয়ে যাবেন।
আইএমএফ শর্ত দিয়ে ঋণ দেয়, সেই শর্ত মনিটর করে। শর্ত না মানলে ঋণের কিস্তি বন্ধ হয়ে যাবে। সাথে বন্ধ হয়ে যাবে অনেক সম্ভাবনার দুয়ারও। তাই আইএমএফের ঋণের প্রতিটি পাই-পয়সা যেন সঙ্কট উত্তরণের কাজে লাগে। ঋণ করে ঘি খাওয়ার দশা যেন না হয়।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ