নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের আর্থিক চ্যালেঞ্জ
২০২৪ সালের শুরুতেই আমরা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আশা করতে পারি। তবে দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এমন একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে যখন আমাদের অর্থনীতিরও একটি কঠিন দুরবস্থার ভেতর দিয়ে অতিক্রান্ত হওয়ার আশু সম্ভাবনা রয়েছে।
দীর্ঘস্থায়ী কোভিড-১৯ বৈশ্বিক অতিমারির মহা বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ব্যাপকতার কারণে আমাদের চলতি ২০২২-২৩ অর্থ বছর শুরুই হয়েছে কতগুলো নেতিবাচক ও খারাপ অর্থনৈতিক সূচক নিয়ে।
বিজ্ঞাপন
নেতিবাচক এই সূচকগুলো এখনো বর্তমান এবং এগুলোর ভালো অবস্থায় ফিরে আসার তেমন কোনো উজ্জ্বল সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। বরং তা আরও গভীর ও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির আস্ফালন, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ হ্রাস, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট, ইত্যাদি আরও বেড়েছে। মোটের উপর, আমাদের অর্থনীতিতে একটি দৃশ্যমান অস্থিরতা বিদ্যমান।
আরও পড়ুন >>> বিদ্যুৎ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি : এভাবে আর কতদিন?
বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের মতো আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ২০২৩ এবং তৎপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে আর্থিক মন্দা ও খাদ্য সংকটের পূর্বাভাস দিয়েছে। আমাদের সরকার প্রধানও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করে সব ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রতার উপর জোর দিয়েছেন। এমন একটি আর্থিক অনিশ্চয়তার সময় আগামী সংসদ নির্বাচনে ভালো ফল করতে হলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত সরকারকে অচিরেই জনমনে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সমর্থিত সরকার চলতি মেয়াদে সফলতার সাথে মনে রাখার মতো অনেকগুলো দুর্যোগ ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করেছে। যেমন—দীর্ঘ করোনা মহামারিকালীন চিকিৎসা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা। স্বল্প সময়ে কোটি কোটি মানুষের জন্য করোনা ভাইরাস প্রতিরোধক টিকার সংস্থান।
মূল্যস্ফীতির আস্ফালন, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ হ্রাস, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট, ইত্যাদি আরও বেড়েছে। মোটের উপর, আমাদের অর্থনীতিতে একটি দৃশ্যমান অস্থিরতা বিদ্যমান।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের পদমর্যাদায় উন্নয়ন। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল, এক্সপ্রেস হাইওয়ে, এবং বিশেষ করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, অনেক সফলতা থাকলেও ভোটাধিকার প্রয়োগের সময় বেশিরভাগ ভোটার রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় সরকারের নেতিবাচক দিকগুলোই বেশি মনে রাখে। আর তাই, আমাদের সরকারকে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেতিবাচক সূচকে ইতিবাচক করার জন্য অতিসত্বর মনোনিবেশ করতে হবে।
আরও পড়ুন >>> আর কত চাপ সামলাবে?
আমাদের অর্থনীতির এখন সবচেয়ে আলোচিত ও স্পর্শকাতর জনদুশমন সূচক হচ্ছে মূল্যস্ফীতির উচ্চ হার। অনেক চেষ্টা করেও অর্থনীতির এই নীরব ঘাতককে সরকার কোনোভাবেই বসে আনাতে পারছে না। এর তীক্ষ্ণ থাবার আঘাতে জনজীবন ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। জীবনযাত্রা ব্যয় নির্বাহে হিমশিম খাচ্ছে জনগণ। দিশেহারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরেও মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮.৭১ শতাংশ। অথচ, চলতি বছরের বাজেটে প্রাক্কলিত মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫.৬ শতাংশ। আইএমএফ অনুমান করছে যে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতি হতে পারে ৯ দশমিক ১ শতাংশ। তাই, এই অবস্থায় একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অর্থনীতির জন্য খুব একটা সুখকর হবে না। কেননা, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার অবশ্যই একটি জনবান্ধব বাজেট তৈরির চেষ্টা করবে।
জনবান্ধব বাজেট মানেই উচ্চবিলাসী ও ঘাটতি বাজেট। আয়ের তুলনায় ব্যয় হবে অত্যধিক। তাছাড়া, নির্বাচনী বছরে সরকারের প্রশাসনিক নির্বাচনী ব্যয় ও নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের প্রচার, সভা, জনসংযোগ ইত্যাদির মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় বৃদ্ধির কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আরও একধাপ বাড়বে।
মোদ্দা কথায়, নির্বাচনী অর্থ বছরে নির্বাচনের কারণে অর্থনীতির মূল্য স্তরের উপর বাড়তি চাপ পড়বে যা সামাল দিয়ে ভোটের আগে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা বর্তমান আওয়ামী লীগ সমর্থিত সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
আরও পড়ুন >>> মধ্যবিত্তের নতুন আতঙ্ক বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি
আমাদের অর্থনীতির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতিবাচক সূচক হচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ। যদিও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই সূচক নিয়ে তেমন চিন্তিত নয়। তবে, আর্থিকভাবে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকেরা বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ হ্রাসের কারণে অর্থনীতিতে কী রকম অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হতে পারে তা নিয়ে বেশ সরব।
বৈদেশিক বাণিজ্যে অংশীদার বিদেশি রাষ্ট্র ও সাহায্য সংস্থাগুলোও দেশের বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের উপর নজর রাখে। আমদানি ব্যয় ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে একটি সরকারের সক্ষমতা এই মজুদের উপর নির্ভর করে।
নির্বাচনী বছরে সরকারের প্রশাসনিক নির্বাচনী ব্যয় ও নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের প্রচার, সভা, জনসংযোগ ইত্যাদির মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় বৃদ্ধির কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আরও একধাপ বাড়বে।
বাংলাদেশে ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আমাদের মোট বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের পরিমাণ ৩৪.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আইএমএফের নির্দেশনা অনুযায়ী সেখান থেকে বিভিন্ন তহবিলে বিনিয়োগ করা এবং ঋণ হিসেবে দেওয়া ৮ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে নেট মজুদের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬.৩ বিলিয়ন ডলার। গড়পড়তা হারে বাংলাদেশকে প্রতি মাসে ৬ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে হয়। এই হিসাব বিবেচনায় আমাদের ৩ থেকে ৪ মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধের বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ আছে।
তবে, সরকারি তরফ থেকে ৫ মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধের সক্ষমতার কথা বলা হলেও বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের এই পরিমাণ অনেকে স্বস্তির বলে মনে করছেন না। কেননা, মজুদের পরিমাণ প্রতিনিয়ত ওঠানামা করছে। কারণ, বাংলাদেশের অর্থনীতি আমদানি নির্ভর।
আরও পড়ুন >>> আইএমএফের ঋণ : স্বস্তির না শঙ্কার?
রপ্তানি থেকে আমদানির ব্যয় বেশি। অন্যদিকে, টাকার বিপরীতে ডলারের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে অস্বাভাবিক। বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ সংকটের কারণে অনেক জরুরি আমদানিও ব্যাহত হচ্ছে এবং চলতি লেনদেনের ঘাটতি এখন রেকর্ড পরিমাণ।
২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর মেয়াদে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ৭৭৩ মিলিয়ন ডলার বেড়ে ৭.৫৪ বিলিয়নে ডলারে দাঁড়িয়েছে।
আবার, করোনা মহামারি পরবর্তী বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় নতুন করে সেভাবে মজুদ হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রা যোগ হচ্ছে না। অধিকন্তু, ২০২৪ থেকে সরকারকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ধাক্কাও সামলাতে হবে। তাছাড়া, অবৈধ উপায়ে বৈদেশিক মুদ্রা পাচারত রয়েই গেছে।
সবদিক বিবেচনা করে ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবিলায় সরকার আইএমএফের কাছে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ সাহায্য চেয়েছিল। সরকারের আবেদনের প্রেক্ষিতে আইএমএফ কিছু শর্ত সাপেক্ষে এই ঋণ দিতে সম্মতও হয়েছে। ঋণ আগামী ৪ বছরে অর্থাৎ ডিসেম্বর ২০২৬ এর মধ্যে সাত কিস্তিতে বিতরণ করা হবে। আশা করা যাচ্ছে, ৪৪৭.৭৮ মিলিয়ন ডলারের প্রথম কিস্তি এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে পাওয়া যাবে। বাকি প্রতিটি কিস্তির পরিমাণ হবে ৬৫৯.১৮ মিলিয়ন ডলার।
৪৫০ কোটি ডলারের মধ্যে ৩২০ কোটি ডলার বাংলাদেশ বাজেট সহায়তা হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। বাকি ১৩০ কোটি ডলার খরচ করতে হবে জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায়। সুতরাং, নির্বাচনের আগে জনতুষ্টির প্রকল্পে আগামী বাজেটে অর্থ ব্যয়ের জন্য সরকারের হাতে বাড়তি অর্থ থাকবে বলে আশা করা যায়। তবে, শঙ্কার বিষয় হচ্ছে শর্ত পূরণ না করতে পারলে ঋণের কিস্তি আটকে যাবে।
আরও পড়ুন >>> মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা
কাজেই, আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণ করা হবে সরকারের আর একটা বড় চ্যালেঞ্জ। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে আইএমএফের অন্যতম শর্তই হচ্ছে সরকারের ভর্তুকি কমানো। সরকার ভর্তুকি কমালে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস, পানি ও সারের দাম বৃদ্ধি পাবে। তবে, আইএমএফের ঋণের চূড়ান্ত অনুমোদনের আগেই সরকার কিছু শর্ত পূরণ করা শুরু করে দিয়েছে। এরই মধ্যে সরকার বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে। ২০২২ সালের আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করেছে প্রায় দেড় গুণ। ২০২২ সালের জুনে বাড়িয়েছে গ্যাসের দাম। সরকার ভবিষ্যতে পানি ও সারের দামও হয়তো বাড়াবে।
তাছাড়া, রাজস্ব আয় বাড়ানোর কথাও রয়েছে ঋণের শর্তে। এজন্য আগামী অর্থবছরে হয়তো সরকারকে অনেক খাতে কর ছাড় হ্রাস বা বন্ধ করতে হবে এবং একই সাথে করের হার ও পরিধিও বাড়াতে হবে।
নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ার সাথে যদি করের হারও বাড়ে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনের আগে সরকারের জনসমর্থন কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে। তাই, নির্বাচনের আগে সরকার এই শর্তগুলো কীভাবে পূরণ করবে তা এখন দেখার ব্যাপার। খেলাপি ঋণ কমানো আইএমএফের ঋণের আরেকটি শর্ত। তবে, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত হয়ে খেলাপি ঋণ কমানো আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য সত্যিই একটা চ্যালেঞ্জ।
অতি সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন মুদ্রানীতি অনুযায়ী বাণিজ্যিক ব্যাংকের ভোক্তা ঋণের সর্বোচ্চ সুদে হার নির্ধারণ করেছে ১২ শতাংশে যা এতদিন ছিল ৯ শতাংশে। অন্যদিকে, আমানতের ক্ষেত্রে প্রদেয় ন্যূনতম সুদের হারও প্রত্যাহার করেছে। এটাও আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণেরই অংশ।
আরও পড়ুন >>> বৈশ্বিক খাদ্য সংকট : বাংলাদেশ কি প্রস্তুত?
ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি করে সরকার মূল্যস্ফীতিকে লাগাম টানতে চাচ্ছে। তবে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের অভিজ্ঞতা বলছে যে, সুদের হার বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির উপর তেমন একটি প্রভাব ফেলতে পারেনি। অধিকন্তু, সুদের হার বৃদ্ধি হওয়ার কারণে ঋণের উপর নির্ভরশীল ব্যবসা-বাণিজ্য বাঁধা প্রাপ্ত হবে। তাই, নির্বাচনের আগে এই সিদ্ধান্তটিও সঠিক কিনা সেটা আগামী সময়ই বলে দিবে।
তাছাড়া, নির্বাচনের প্রাক্কালে পুঁজিবাজারে উন্নয়ন বা তেজিভাব ফিরিয়ে আনা কতটুকু সম্ভব সেটাও একটা ভাবনার বিষয়। কেননা, আমাদের দেশে নির্বাচন মানেই অনিশ্চয়তা, অস্থিরতার আশঙ্কা।
নীলাঞ্জন কুমার সাহা ।। ডিন, ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস স্টাডিজ ও অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়