বিদ্যুৎ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি : এভাবে আর কতদিন?
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির চাপ যেতে না যেতেই শিল্প ও কলকারখানা খাতে ব্যবহৃত বাণিজ্যিক গ্যাসের মূল্য আর এক দফা বাড়ানো হলো সরকারের নির্বাহী আদেশে। বেশ অনেকদিন ধরেই ব্যবসায়ীরা গ্যাস সংকটের একটি অজুহাত দাঁড় করিয়েছিলেন।
গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না বলে সয়াবিন তেল ও চিনিসহ অনেক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির নতুন একটি উপসর্গ সামনে এসেছিল। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি স্বাভাবিক আছে বলে দাবি করা হয়েছিল।
বিজ্ঞাপন
আর্থিক খাতে চাপ সামলাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে একের পর এক দাম বাড়াচ্ছে সরকার। ২০২২ সালের জুনে গ্যাসের দাম গড়ে ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। ৭ মাস পর এবার গ্যাসের দাম বাড়ল ৮২ শতাংশ। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ, শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে প্রাকৃতিক গ্যাসের ৮২.১০ শতাংশ দাম বেড়েছে।
আরও পড়ুন >>> আর কত চাপ সামলাবে?
আশঙ্কার কথা হলো এর ফলে সবধরনের নিত্যপণ্যের দাম একযোগে বেড়ে যাবে। দাম বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ীরা আরও একটি নতুন অজুহাত পেল। আর এই ক্ষেত্রে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ জীবনযাত্রার খরচের পাল্লা ভারি করার আরেক দফা খরচের জাঁতাকলে পড়তে যাচ্ছে।
২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইন অনুযায়ী গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো শুরু করেন। যেখানে বিতরণ কোম্পানিগুলো দাম বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করেন এবং ভোক্তারা এর বিপক্ষে তাদের যুক্তিগুলো তুলে ধরেন এবং বিইআরসি উভয় পক্ষের যুক্তিতর্কগুলো যাচাই-বাছাই করে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেন।
জ্বালানি খাতের সংশ্লিষ্টরা বারবার অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর গুরুত্বারোপ করলেও বাপেক্স বা জ্বালানি মন্ত্রণালয় গ্যাস আমদানিতেই বেশি মনোযোগী।
সরকার ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিইআরসি আইন সংশোধন করে এই ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে নেন। তারপর থেকেই নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসলো। যদিও সরকার আইন সংশোধনের সময় আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে নিয়মিত দাম সমন্বয় করতে চায় বলে যুক্তি প্রদর্শন করেছিল।
আরও পড়ুন >>> মধ্যবিত্তের নতুন আতঙ্ক বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি
এখন গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে বিদ্যুতের দাম বাড়বে। আর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে সব ধরনের ভোক্তার ওপর। “দাম সমন্বয়” বিষয়কে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে ভর্তুকি কমিয়ে ভোক্তার ওপর বাড়তি দামের বোঝা চাপানো সঠিক নয়।
জ্বালানি খাতের সংশ্লিষ্টরা বারবার অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর গুরুত্বারোপ করলেও বাপেক্স বা জ্বালানি মন্ত্রণালয় গ্যাস আমদানিতেই বেশি মনোযোগী। তাই সরকারের নীতি সংশোধন না করে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য।
দেশে দিনে এখন গ্যাসের মোট চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এলএনজিসহ গড়ে সরবরাহ করা হয় ২৬৬ কোটি ঘনফুট। এর আগেও আমদানি করে সরবরাহ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে দুই দফা (২০১৯ ও ২০২২ সালে) গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল।
পরবর্তীতে গ্যাস আমদানি বাড়েনি; বরং ২০২২ সালের জুলাই থেকে সরকার খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ রেখেছে। ফলে আমদানি করা গ্যাসের সরবরাহ দিনে ৮৫ কোটি ঘনফুট থেকে ৪০ কোটি ঘনফুটে নেমেছে। তাই এবারও দাম বাড়ানো হলে চাহিদা অনুসারে গ্যাস মিলবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
আরও পড়ুন >>> আইএমএফের ঋণ : স্বস্তির না শঙ্কার?
গ্যাস সংকটের সময় ব্যবসায়ীরা বেশি দাম দিয়ে হলেও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের দাবি করেছিলেন। সরকার তাদের সেই দাবি পূরণ করতে চাইছেন। যার জন্য সরবরাহ স্বাভাবিক করতে এলএনজি (তরল প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। আর এজন্য বাড়তি টাকা দরকার।
গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে সুতা ও কাপড় উৎপাদনে খরচ দ্বিগুণ হবে। এত বেশি উৎপাদন ব্যয়ে কোনো শিল্প টিকতে পারে না। কারণ, বস্ত্র ও পোশাক খাত আন্তর্জাতিক ব্যবসা। বিশ্ববাজারের দরের সঙ্গে তাল মেলাতে হয়।
আইএমএফের ঋণ পেতে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দিয়েছে। আবার সরকারের ভর্তুকি দেওয়ার মতো স্বাভাবিক আর্থিক সংগতিও নেই। তাই সব মিলিয়ে গ্যাস খাতের খরচ তুলতেই দাম বাড়ানো হয়েছে। তবে দাম বাড়ানোই একমাত্র সমাধান নয়। বিকল্প উপায়গুলো কাজে লাগানো যেত কি না তা ভাবা হয়নি বলে অনেকেই অভিমত প্রকাশ করেছেন।
গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে সুতা ও কাপড় উৎপাদনে খরচ দ্বিগুণ হবে। এত বেশি উৎপাদন ব্যয়ে কোনো শিল্প টিকতে পারে না। কারণ, বস্ত্র ও পোশাক খাত আন্তর্জাতিক ব্যবসা। বিশ্ববাজারের দরের সঙ্গে তাল মেলাতে হয়।
আরও পড়ুন >>> মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা
চাইলেই রড-সিমেন্টের মতো দর বাড়িয়ে দেওয়া যায় না। গ্যাসই হচ্ছে বস্ত্র খাতের প্রধান কাঁচামাল। এখন গ্যাসের অস্বাভাবিক বর্ধিত দরে শিল্প মার খাবে। বস্ত্রের সংকটে তৈরি পোশাক খাতও সংকটে পড়বে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এর তথ্যমতে পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরও লোকসান বাড়ছে।
সরকার ২০২৩ সালে বিদ্যুৎ খাতে ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রেখেছে। তবে জ্বালানির দাম বাড়ায় ঘাটতি দাঁড়াতে পারে ৪৪ হাজার কোটি টাকা। নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ায় ঘাটতি আরও বাড়বে।
এটা সবাই স্বীকার করবেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের উৎপাদন এবং হোটেল রেস্তোরাঁয় এমনকি পোল্ট্রি ও কৃষিভিত্তিক শিল্প খাতেও খরচ বেড়ে যাবে। ব্যবসায়ীরা এই বাড়তি খরচগুলো ভোক্তার পকেট থেকে তুলবে।
মানুষের জীবন জীবিকা নির্বাহের ব্যয় ও নিত্যপণ্যের খরচ আরও বাড়বে। যা ফলে মূল্যস্ফীতি আরেক দফা উসকে দেবে। সাধারণ মানুষের জীবনযাপন কষ্টকর হয়ে পড়বে। গ্যাসের দাম এক লাফে এতটা বাড়ানোর কারণে স্বাভাবিক কারণেই গ্রাহক হিসেবে ভোক্তার ওপরই বর্তাবে।
ব্যবসায়ী ও শিল্প উৎপাদকরা যখন তাদের কোনো পণ্যের দাম নির্ধারণ করেন তখন যাবতীয় আনুসাঙ্গিক খরচগুলো ধরেই হিসাব কষেন।
আরও পড়ুন >>> বৈশ্বিক খাদ্য সংকট : বাংলাদেশ কি প্রস্তুত?
বিশেষ করে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় শিল্পের জন্য গ্যাসের ইউনিটের দাম একই নির্ধারণ করার কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবেন। তারা বড় শিল্পের সাথে পাল্লা দিয়ে ঠিকতে পারবে না। তখন ব্যবসা বাণিজ্যে আবারও বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের আধিপত্য বাড়তে পারে।
তবে দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি করে জ্বালানি খাতের সামগ্রিক অনিয়ম, অব্যবস্থাপনাকে আড়াল করা হচ্ছে। বিতরণ কোম্পানিগুলোর অনিয়ম, অপচয় ও বেশি দামে এলএনজি আমদানির বন্ধ করলেই গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়তো না।
এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)