জোশের লাগাম টানতে হবে
১০ জানুয়ারির ঘটনা। বরিশালের মিষ্টির দোকানে খেতে যান স্থানীয় কর্মচারী। বিল দিতে গিয়ে দশ টাকার পার্থক্য। রেস্টুরেন্ট কর্মচারীর দাবি বিল হয়েছে চল্লিশ টাকা আর ভোক্তা বলছেন ত্রিশ টাকা। ১০ টাকা নিয়ে দুজনের কথা কাটাকাটি। হাতাহাতি। ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু না—হয়নি। বরং আরও বেড়েছে।
ডালপালা গজিয়েছে। অকুস্থলে হাজির তৌহিদী জনতা! তাদের দাবি রেস্টুরেন্টে ধর্ম অবমাননা হয়েছে। খাবার বিল ৩০ না ৪০ টাকা—তা নিয়ে ধর্ম অবমাননা হয় কীভাবে?
বিজ্ঞাপন
এমন ভেবে যারা চোখ কপালে তুলছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলি—বরিশাল নদী বন্দর এলাকার সেই রেস্টুরেন্টের নাম ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। আর ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তোলা গোষ্ঠীর নাম—‘তৌহিদী জনতা’। এরপর শুরু হয় ব্যাপক হাঙ্গামা। খাবার দোকানে চালানো হয় ভাঙচুর। ঘটনাস্থলে আসে পুলিশ। নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে পরিস্থিতি। আহত হন পুলিশের দুই সদস্য। কী পাঠক, এবার পরিষ্কার হয়েছে পুরো ঘটনা?
আরও পড়ুন >>> ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার দিন
বরিশালের এই ঘটনা শোনার পর মনে পড়ে কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, সুনামগঞ্জের শাল্লা, রংপুরের পীরগঞ্জের মাঝিপাড়া, নড়াইলের সাহাপাড়া। সব জায়গায়ই কথিত ধর্ম অবমাননার কল্পিত অভিযোগ তুলে নির্বিচার হামলা হয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের বাড়িতে।
নির্বিচার আগুনে পুড়েছে বসত ঘর। স্বাধীন দেশের মাটিতে নিজের ঘর ছেড়ে বনে জঙ্গলে ধানের ক্ষেতে রাত কাটাতে বাধ্য হয়েছেন মানুষ। শিশু, নারী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এবং জোয়ান মানুষের কান্নায় ভারি হয়েছে লাখো শহীদের রক্ত ভেজা বাংলাদেশের বাতাস। এই তৌহিদি জনতা কারা? এতো জোশ তারা কোত্থেকে পায়? কারা তাদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়?
বর্তমান সরকার টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায়। জনগণকে দেওয়া নানা প্রতিশ্রুতির বেশিরভাগই তারা এরই মধ্যে বাস্তবায়ন করেছে। নানা প্রতিকূলতার পরও, দেশি বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রের পরও দেশকে এগিয়ে যাচ্ছে। এবার একটু এদিকে নজর দিন প্লিজ...
২০১৩ সালের কথা মনে পড়ে? ১৩ দফা দাবি নিয়ে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। নানা ঘটনা অনুঘটনার পর সেই বছরের ৫ মে শাপলা চত্বরে সমাবেশ করে হেফাজতে ইসলাম। এরপর নির্বিচার জ্বালাও পোড়াও আর ধ্বংসযজ্ঞে রাজধানী ঢাকাকে নরক বানিয়ে ছেড়েছিল তারা।
ইসলাম ধর্মের তমুদ্দুন রক্ষার মিশনে নেমে পবিত্র কোরান শরিফ আগুনে পোড়ানোর ঘটনাও ঘটেছিল তখন। শাপলা চত্বরের সমেবত জমায়েত নিয়ন্ত্রণ করেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। তা নিয়েও তখন ছড়ানো হয়েছিল পরিকল্পিত গুজব।
আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন
শাপলা চত্বরে পুলিশি অভিযানে বহু মানুষ মারা যাওয়ার গুজব ছড়িয়ে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করেছিল একটি মহল। পরে অবশ্য গণমাধ্যমের বরাতে সেই চেষ্টা সফল হয়নি। যাদের মৃত বলে দাবি করেছিল ‘অধিকার’ নামক এক এনজিও—গণমাধ্যম তুলে আনলো আদতে তারা সবাই জীবিত।
কিন্তু এসবের পর আসল খেলা শুরু হয় কয়েক বছর পর। যখন হেফাজতের চাহিদা মতো পাঠ্য বইয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। রাজনীতির খেলার নানার মারপ্যাঁচে হেফাজত ধীরে ধীরে কাছে চলে আসে ক্ষমতাকেন্দ্রে।
২০১৩ সালে সভা সমাবেশ কিংবা আন্দোলনের মাধ্যমে যা আদায় করতে পারেনি হেফাজত এবং তাদের অনুসারীরা। পরের বছরগুলোয় আপস এবং মিত্রতার সুযোগ নিয়ে তার অনেককিছুই আদায় করে নেয় তারা। ফলে দিনে দিনে বাড় বাড়ন্ত হয় তাদের। যার ফল রেস্টুরেন্টে খাবার বিল নিয়ে কথা কাটাকাটিকে তারা রূপান্তর করে ফেলে ধর্মীয় অবমাননায় কিংবা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার মতো ঘটনায়! সত্যিই বিচিত্র! খুবই বিচিত্র লাগে।
রাজনীতির মাঠে বাজছে নির্বাচনের ডামাডোল। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আছে আন্দোলনের মাঠে। সরকারি দল আওয়ামী লীগও নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু এসবের মাঝেও ওঁত পেতে আছে নানান সুবিধাবাদী শ্রেণি।
শুরুতে বলছিলাম—রামু, নাসিরনগরসহ বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা। দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও এসব ঘটনার একটারও বিচার কাজ এখনো শেষ হয়নি। কেন শেষ হয়নি কেউ বলতে পারে না। তবে অবশ্যই এসবের বিচার শেষ হওয়া উচিত। খুব দ্রুত শেষ করা উচিত।
আরও পড়ুন >>> আমরা কি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের পথে?
বর্তমান সরকার টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায়। জনগণকে দেওয়া নানা প্রতিশ্রুতির বেশিরভাগই তারা এরই মধ্যে বাস্তবায়ন করেছে। নানা প্রতিকূলতার পরও, দেশি বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রের পরও দেশকে এগিয়ে যাচ্ছে। এবার একটু এদিকে নজর দিন প্লিজ। ধর্মের দোহাই দিয়ে একশ্রেণির মানুষ, একটি গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ আদায় করে যাবে আর কত দিন?
নির্বাচন আসছে সামনে। রাজনীতির মাঠে বাজছে নির্বাচনের ডামাডোল। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আছে আন্দোলনের মাঠে। সরকারি দল আওয়ামী লীগও নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু এসবের মাঝেও ওঁত পেতে আছে নানান সুবিধাবাদী শ্রেণি।
রাজনীতির কাঁধে বন্দুক রেখে নিজেদের স্বার্থ আদায়ের চেষ্টায় লিপ্ত তারা। ধরেই নেওয়ার যায় থাকবে সামনের দিনগুলোয়ও। সুতরাং এদের ব্যাপারে এখনই সাবধান হতে হবে। লাগাম টানতে হবে।
খান মুহাম্মদ রুমেল ।। অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর, সময় টিভি