ডিজিটাল বাংলাদেশে সেবা কি ফ্রি?
বাংলাদেশে সেবা খাতের ধারণাটাই যেন নেই। একেবারে নেই, সেটা বলা বোধহয় ঠিক হবে না। ফায়ার সার্ভিস এবং ৯৯৯ নম্বরের জরুরি সেবা নিয়ে অভিযোগ কম। যদিও ২০২১ সালে কুমিল্লার দুর্গামণ্ডপে হামলার সময় ৯৯৯ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি।
এছাড়া সেবার অন্য যেসব খাত আছে, সেগুলোর নাম বদলে হয়রানি খাত রাখলে খুব ভুল হবে না। থানা, পুলিশ, আদালত, হাসপাতাল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, বিআরটিএ, ভূমি—যেখানেই যাবেন সহজে সেবা পাবেন না। পদে পদে মিলবে হয়রানি আর দুর্ভোগ।
বিজ্ঞাপন
সর্বত্র আসলে সেবা বিক্রি হয়। সেবা কিনতে কোনো আপত্তি নেই। কারণ এর কোনোটাই স্বেচ্ছাসেবা নয়। কিন্তু সরকারের নির্ধারিত রেটে আপনি সেবা কিনতে পারবেন না। অর্থ যত বাড়বে, দুর্ভোগ তত কমবে। ভয়ে মানুষ থানায় যেতে চায় না। তবে হাসপাতাল ভয় পেলে চলে না, যেতেই হয়। কিন্তু একবার সরকারি হাসপাতালে গেলে আর জীবনে আপনি অসুস্থ হতে চাইবেন না।
আরও পড়ুন >>> ২০২২ কেমন ছিল?
সরকারি হাসপাতালে গিজগিজ করে দালালরা। তারা চাইবে আপনাকে নিজেদের পছন্দের বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে। ব্যস, একবার দালালের পছন্দের বেসরকারি হাসপাতালে ঢুকলে আপনার স্বাস্থ্য এবং অর্থ দুই-ই যাবে। আর একবার বিচার চাইতে আদালত প্রাঙ্গণে পা রাখা মানে আজীবনের জন্য হয়রানির টিকিট কিনে ফেলা।
বিভিন্ন সময়ে আমাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছে। তবে আমি ভাগ্যবান, আমাকে কখনো থানা বা আদালতে যেতে হয়নি। ভাড়া থাকি বলে কখনো গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ-ভূমি অফিসে যেতে হয়নি। চাইলে বাংলাদেশের অনেক মানুষ থানা, পুলিশ, হাসপাতাল, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ভূমি অফিসে না গিয়েও আমার মতো জীবন কাটিয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু দুটি অফিস আপনি কিছুতেই এড়াতে পারবেন না।
ডিজিটাল বাংলাদেশে জন্ম নিলেই আপনাকে জন্ম নিবন্ধন করতে হবে। আর জাতীয় পরিচয়পত্রের হয়রানি আপনি জন্মের সময়ই বোনাস হিসেবে নিয়ে আসবেন।
ডিজিটাল বাংলাদেশে জন্ম নিলেই আপনাকে জন্ম নিবন্ধন করতে হবে। কারণ পরে জাতীয় পরিচয়পত্র করতে আপনার জন্ম নিবন্ধন লাগবেই। আর বর্তমানে জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া এখন দেশের অনেক সেবাই পাওয়া যায় না। এমনকি সরকারের নানা সামাজিক নিরাপত্তার সেবা পেতেও জাতীয় পরিচয়পত্র লাগে। তাই জাতীয় পরিচয়পত্রের হয়রানি আপনি জন্মের সময়ই বোনাস হিসেবে নিয়ে আসবেন।
সবাইকে না হলেও অনেক মানুষকে পাসপোর্ট অফিসেও যেতেই হয়। যেহেতু যেতেই হয়, তাই জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র আর পাসপোর্ট অফিসে হয়রানি সবচেয়ে বেশি। অথচ বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিকের এই তিনটি সেবা পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
আরও পড়ুন >>> জনগণের টাকায় আনন্দ উল্লাস!
সরকার নিয়ম করেছে, জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টের সব তথ্য অভিন্ন হতে হবে। খুবই যৌক্তিক কথা। একজন নাগরিকের সব তথ্য অভিন্ন থাকাই তো উচিত। এই বাধ্যবাধকতার সুযোগে তিনটি অফিসে যেন হয়রানির হাট বসে যায়। বাংলাদেশের বাস্তবতায়, কখনো কখনো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের খামখেয়ালিতে জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্টে নাম, বাবা-মায়ের নাম, জন্ম তারিখ বা ঠিকানায় টুকটাক ভুল থেকে যেতে পারে। কিন্তু সেই টুকটাক ভুল আপনাকে নিয়ে ডুবিয়ে দিতে পারে হয়রানির মহাসমুদ্রে।
ধরুন, আপনি পাসপোর্ট করতে গিয়ে জানলেন, আপনার জন্ম নিবন্ধন বা এনআইডিতে কোনো ভুল আছে। ছুটলেন সেগুলো সংশোধন করতে। ছুটলেন মানে ছুটতেই থাকলেন। আপনার জুতা ক্ষয় হবে, স্বাস্থ্য নষ্ট হবে, কিন্তু সংশোধন আর হবে না। জন্ম নিবন্ধন, এনআইডি আর পাসপোর্টের চক্কর এমনই জটিল, সত্যি সত্যি আপনি বাবার নাম ভুলে যেতে পারেন।
পাসপোর্ট করতে, রিনিউ বা নবায়ন করতে এখন অনলাইনে ফরম পূরণ করতে হয়। টাকার পরিমাণের ওপর নির্ভর করে ছবি তোলার তারিখ আগে-পরে হয়। বেশি টাকা দিলে আগে তারিখ মেলে, কম টাকা দিলে পরে। এটাও যৌক্তিক।
আমি নিজে এই প্রক্রিয়ায় পাসপোর্ট রিনিউ বা নরায়ন করেছি। কিন্তু হঠাৎ জরুরি প্রয়োজন পরায় আগে তারিখ চাইতেই বললো, তাহলে আরও টাকা দিতে হবে। বাড়তি টাকা দিয়েই তারিখ এগিয়ে আনতে হয়েছিল।
আরও পড়ুন >>> টাকার নাকি পাখা গজাইছে!
কেউ আমার কাছে পাসপোর্টের ব্যাপারে কোনো সহায়তা চাইলে বলি, সবই তো অনলাইনে। সহায়তা করার কিছু নেই। শুনে তারা মুখ টিপে হাসে। আমি যেটা সরল বিশ্বাসে বিশ্বাস করে বসে আছি, অনেকেই বলল, পাসপোর্ট অফিসের দালালদের ধরলেই আগে তারিখ পাওয়া যায়।
জন্ম নিবন্ধন, এনআইডি আর পাসপোর্টের চক্কর এমনই জটিল, সত্যি সত্যি আপনি বাবার নাম ভুলে যেতে পারেন...
আমি ভেবেছিলাম, সব অনলাইনে আসার পর দালালদের দিন ফুরিয়েছে। কিন্তু আমার জানি নাকি ভুল। দালালরা নাকি তাদের পছন্দের তারিখ আগে বুক করে রাখে। অনলাইনে ফরম পূরণ করা যায় সহজেই। তারপর শুরু হয় পাসপোর্ট অফিসের পেছনে দৌড়ানো। ছবি তুলতে লাইন, পাসপোর্ট তুলতে লাইন। লাইন মানে কিন্তু যেমন তেমন লাইন নয়।
কোনো একটা পাসপোর্ট অফিসে গেলেই দেখতে পাবেন, লাইনের বহর। সাপের মতো আঁকাবাঁকা হয়ে কখনো কখনো লাইন কিলোমিটার ছাড়িয়ে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে যখন ঘর্মাক্ত কলেবরে ছবি তুলতে যাবেন, নিজেকেই নিজে চিনতে পারবেন না।
আরও পড়ুন >>> অর্থনৈতিক মন্দার শিকড় কোথায়?
আবেদন জমা দেওয়ার পর শুরু হবে অপেক্ষা। এরপর পড়বেন পুলিশ ভেরিফিকেশনের কবলে। প্রত্যেক নাগরিকের পাসপোর্ট পাওয়ার অধিকার আছে। সেখানে পুলিশের যাচাই লাগবে কেন, বুঝি না। আর ভেরিফিকেশনে যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তাকে সন্তুষ্ট করতে না পারলে আপনার রিপোর্ট ভালো আসবে না। আপনি পাসপোর্টও পাবেন না।
বাংলাদেশের বৈধ নাগরিকের পাসপোর্ট বা এনআইডি পেতে হয়রানি হতে হয়। কিন্তু টাকা দিয়ে রোহিঙ্গারা অহরহ এনআইডি বানায়, পাসপোর্ট বানায়; সেই পাসপোর্টে বিদেশেও চলে যায়।
কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক মিলিয়ে দেশে মোট ৩০টি পাসপোর্ট অফিস আছে। শোনা কথা, টাকা ছাড়া নাকি সেখানে গাছের পাকাও নড়ে না, পাসপোর্টের পাতা নড়া তো দূরের কথা।
আরও পড়ুন >>> মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা
৯ জানুয়ারি দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কুমিল্লা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে নাকি প্রতিদিন ১০ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেন হয়। এই যদি হয় আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের দশা, বাকিগুলোর কথা ভাবুন।
যুগান্তরের প্রতিবেদন ঠিক হলে প্রতিদিন বিভিন্ন পাসপোর্ট অফিসে কয়েক কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়। এই দুর্দিনে পাসপোর্ট অফিসগুলো হতে পারে, সরকারের আয়ের প্রধান উৎস। খালি ঘুষকে বৈধ করে দিতে হবে!
বাংলাদেশের অনেক উন্নতি হয়েছে, ডিজিটাল থেকে বাংলাদেশ এখন স্মার্ট হওয়ার পথে। কিন্তু সেবা খাতে হয়রানির শেষ হচ্ছে না। একটা হয়রানি মুক্ত বাংলাদেশ দেখার স্বপ্ন আমার। এই জীবনে কি দেখে যেতে পারব?
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ