ছবি : সংগৃহীত

একটি সমাজ, একটি রাষ্ট্র স্বপ্ন দেখে মূলত তাদের তরুণ প্রজন্ম নিয়ে। বলা চলে একটি সমাজ, একটি রাষ্ট্রের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা অনেকাংশে নির্ভর করে তরুণ প্রজন্মের সাফল্য-ব্যর্থতার ওপর। কিন্তু আমাদের জন্য হতাশার বিষয় হচ্ছে, আমাদের তরুণ প্রজন্মের বৃহৎ অংশই আজ হতাশায় নিমজ্জিত।

তাদের হতাশা বিভিন্ন ধরনের। নিজের প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার হতাশা, পরিবার বা সমাজের প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারার হতাশা, পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল করতে না পারার হতাশা, সহপাঠীদের থেকে পিছিয়ে পড়ার হতাশা, পড়াশোনা শেষে চাকরি না পাওয়ার হতাশা, প্রেমিক-প্রেমিকাকে না পাওয়ার হতাশা ইত্যাদি।

আমি সেদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তরুণ-তরুণীদের মতামত জানতে পোস্ট করেছিলাম—‘এতকিছু থাকতে আপনি অনার্স করতে গেলেন কেন?’

আরও পড়ুন >>> বিসিএস নির্ভর জাতি! 

পোস্টের নিচে মন্তব্যগুলো দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। প্রায় ছয় হাজার মন্তব্য পড়েছিল, কিন্তু সেখানে আট-দশটি মন্তব্য ছাড়া আর কোনো ইতিবাচক বা গঠনমূলক মন্তব্য খুঁজে পাইনি। 

প্রায় ৯৯ শতাংশ মন্তব্যই ছিল নেতিবাচক। আর এই ৯৯ শতাংশ নেতিবাচক মন্তব্যে একটি বিষয় ফুটে ওঠেছে তারা কেন অনার্স পড়ছেন তারা নিজেরাই জানেন না। যাকে বলা যায়, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যহীন ও উদ্দেশ্যহীন গ্র্যাজুয়েশন বা পড়াশোনা।

সেখানে একজনের মন্তব্য করেছিলেন, ‘অনার্স না করলে বেকারত্বের সার্টিফিকেট কেমনে পাবো স্যার?’ অর্থাৎ, তিনি ধরেই নিয়েছেন অনার্স শেষ করে তিনি কিছুই করতে পারবেন না। বেকার থাকবেন।

আরেকটি সমস্যা হলো, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে কর্মক্ষেত্রের তেমন মিল পাওয়া যায় না। ফলে তারা চাকরি যেমন পাচ্ছেন না, তেমনি নিজের অর্জিত জ্ঞান দিয়ে কিছু একটা করতে পারবেন তেমন সুযোগও খুব একটা নেই।

আমাদের দেশে সরকারি চাকরির স্বল্পতা রয়েছে। সেজন্য এই তরুণ ধরেই নিয়েছেন, অনার্স শেষে তাকে বেকার থাকতে হবে। এখানে আমাদেরও দায় রয়েছে।

চাকরির বাইরে ব্যবসা-বাণিজ্য, উদ্যোক্তা হতে আমরা তরুণের স্বপ্ন দেখাতে পারি না। কিছু তরুণ-তরুণী নিজ ইচ্ছায় অথবা কারো অনুপ্রেরণায় উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী হতে চাইলেও পুঁজি পাচ্ছেন না। অর্থাৎ, তারা পুঁজির অভাবে উদ্যোক্তা হতে পারছেন না।

আরও পড়ুন >>> বিসিএস : মেধাবীরা কেন মাঠে? 

অথচ, এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ব্যাপক ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো তরুণ উদ্যোক্তাদের লোন দিতে ততটা উদ্যমী বা আগ্রহী হতে দেখা যায় না। কিন্তু অনেক ব্যাংক যথাযথ নাম-ঠিকানাবিহীন প্রতিষ্ঠানে শত শত কোটি এমনকি হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়ে দিচ্ছে বলে সম্প্রতি জাতীয় গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচনায় দেখা গেছে।

আর এসব দেখে তরুণ উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা হতাশ। তারা ভাবেন, ‘আমরা ব্যাংকে গেলে লোন পাই না। কিন্তু তারা ঠিকানাবিহীন প্রতিষ্ঠানে হাজার কোটি টাকা লোন দিয়ে দিচ্ছে।’

আরেকটি সমস্যা হলো, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে কর্মক্ষেত্রের তেমন মিল পাওয়া যায় না। ফলে তারা চাকরি যেমন পাচ্ছেন না, তেমনি নিজের অর্জিত জ্ঞান দিয়ে কিছু একটা করতে পারবেন তেমন সুযোগও খুব একটা নেই।

তাই এই প্রজন্মের হতাশা দূর করতে শিক্ষাক্ষেত্রের জ্ঞান ও কর্মক্ষেত্রের জ্ঞানের সমন্বয় ঘটাতে হবে। সবাইকে উচ্চশিক্ষিত বানানোর নামে বেকার বানানোর প্রতিযোগিতা থেকে কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি অধিক জোর দিতে হবে। কারণ, উচ্চশিক্ষা সবার প্রয়োজন নেই।

আরও পড়ুন >>> সরকারি চাকরি কেন সবার প্রথম লক্ষ্য? 

কর্মমুখী সবার প্রয়োজন। জিপিএ-৫ ভিত্তিক শিক্ষার্থী মূল্যায়নের চেয়ে দক্ষতার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করতে হবে। কেউ জিপিএ-৫ পেলেই 'মেধাবী', আর জিপিএ-৫ না পেলে 'মেধাবী নয়' এমন চিন্তাভাবনা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এই ধরনের চিন্তাভাবনা শিক্ষার্থীদের হতাশ করে দেয়। উদ্ভাবনী দক্ষতা অর্জনে অনীহা তৈরি করে।

সবাইকে উচ্চশিক্ষিত বানানোর নামে বেকার বানানোর প্রতিযোগিতা থেকে কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি অধিক জোর দিতে হবে। কারণ, উচ্চশিক্ষা সবার প্রয়োজন নেই...

অ্যাকাডেমিক জিপিএ-৫ পাওয়া আর ব্যক্তি জীবনে জিপিএ-৫ পাওয়া একই কথা নয়। পরিশ্রম করেও অনেক সময় জিপিএ-৫ পাওয়া যায় না। কিন্তু, তাই বলে সেই পরিশ্রম কি বৃথা? কখনোই না। বরং, আপনি পরিশ্রমের মাধ্যমে যা শিখেছেন, সেই শেখাটাই আপনার ব্যক্তি জীবনকে জিপিএ-৫ বানাবে।

আর যেসব অভিভাবক ভাবছেন—তাদের ছেলে/মেয়ে, ভাই/বোন কিংবা নিকট আত্মীয়ের কেউ একজন জিপিএ-৫ পায়নি বলে, তিনি ব্যর্থ বা অসফল; তাহলে আপনারা ভুল করছেন। তার চেয়ে বরং আপনারা তাদের দক্ষতা ও নতুন কিছু শেখার ওপর জোর দিন।

আরও পড়ুন : মহামারিতে তারুণ্যের সংকট ও সমাধান

মনুষ্যত্ব বোধসম্পন্ন মানুষ হতে সাহায্য করুন। দিনশেষে তারাই সফল হবেন, যারা সত্যিকার অর্থে পরিশ্রমী, যারা দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছেন।

আমার এসএসসি ও এইচএসসি কোনোটায় জিপিএ-৫ ছিল না। আমার রেজাল্ট যা-ই হতো, কোনো রেজাল্টই আমাকে হতাশ করতে পারেনি। সাময়িক খারাপ লেগেছে হয়তো। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম যে, আমার পরিশ্রমের প্রতিদান তাৎক্ষণিকভাবে না পেলেও একদিন পাবো।

আমার স্কুলের যে তিনজন সহপাঠী জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন, তাদের একজন এইচএসসিতে অনুত্তীর্ণ হয়েছেন! আরেকজন হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে চাকরি করছেন। আরেকজন শেষ পর্যন্ত তেমন কিছুই করতে পারেননি।

তাই জিপিএ-৫ পেলেই সফল বা মেধাবী এমন ভাবার সুযোগ নেই। পরিশেষে কর্মদক্ষতা অর্জনই মূল বিষয়, যা কর্মজীবন সমৃদ্ধ করবে।

গাজী মিজানুর রহমান ।। ৩৫তম বিসিএস ক্যাডার; লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার