ছবি : সংগৃহীত

দশ ঘণ্টা ধরে বর্ধিত বৈঠক করেছে সাদ্দাম হোসেন আর শেখ ইনানের ছাত্রলীগ। দলের সব স্তরের নেতা কর্মীদের বক্তব্য শুনেছেন এই নব নির্বাচিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তাদের সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, অভিযোগ, অনুযোগ সবকিছুই।

তথ্যটা শুনলেই মনে হতে পারে তা অসত্য। কিন্তু ভাবনার বাইরেও জগৎ তৈরি করেছে ছাত্রলীগ। বাস্তবতার আর পরিবর্তনের এক ছাত্রলীগ। আর এই বদলে যাওয়া ছাত্রলীগই আজকের বাস্তবতা। আপনি মানুন কিংবা না মানুন।

ছাত্রলীগের নানাবিধ নামকরণ হয়েছিল। ছাত্রলীগের কিছু কর্মীরা বিচ্ছিন্নভাবে যতটা না দলের নিয়ম শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ করতে গিয়ে সব পাপের বোঝা কাঁধে নিয়েছিলেন সেটা কখন তারা কাটিয়ে উঠবেন, একটা সময় এটা ভাবা ছিল ভীষণ রকমের অলীক কল্পনার মতো।

বিশ্বজিৎ আর আবরারের দুটো ঘটনা ছাত্রলীগের ওপর যেমন ভয়াবহ তিরস্কারের প্রলেপ এঁকে দিয়েছিল ঠিক একই সময়ে এই প্রলেপ থেকে ছাত্রলীগ বের হতে পারবে এমনটা ভাবাও ছিল দুষ্কর।

ছাত্রলীগের এই হড়কে যাওয়াতে আগাছায় ভর্তি হয়ে গিয়েছিল ছাত্র রাজনীতি। যেই আলোর ‘ব্যাটন’ ছিল তাদের হাতে, যে প্রজ্ঞা আর মেধার স্ফুরণ ছিল এদের ঘিরে সেখানে এই হঠাৎ বিচ্যুতি একদিকে যেমন পীড়াদায়ক ছিল অন্যদিকে ছিল নিজেই নিজের হন্তারক হয়ে ওঠার মতো। 

বিশ্বজিৎ আর আবরারের দুটো ঘটনা ছাত্রলীগের ওপর যেমন ভয়াবহ তিরস্কারের প্রলেপ এঁকে দিয়েছিল ঠিক একই সময়ে এই প্রলেপ থেকে ছাত্রলীগ বের হতে পারবে এমনটা ভাবাও ছিল দুষ্কর।

এই সুযোগে কোটা বিরোধী আন্দোলন কিংবা নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন বেহাত হয়ে চলে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা পর্যন্ত বীতশ্রদ্ধ হয়ে মানহীন এক চরিত্রকে করে তোলে ডাকসুর ভিপি। এখন অবশ্য সেই ভুল তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। অবশ্য সেই সময় ভাবনার ভিন্ন ন্যারেটিভের সুযোগ ছিল না।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ‘আগে গুণবিচারী পরে দর্শনধারী’, নিয়মে চলে। ফলে ছাত্রলীগ সেই সময় যে সময়ের মধ্য দিয়ে নিজেদের নিয়ে যাচ্ছিল সেটা ছিল বড় যন্ত্রণার।

চোখের সামনে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া একটি সংগঠন যখন ভুল পথের অংশীদার হয় তখন বিষাদ কিংবা বেদনাগ্রস্থ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও থাকে না।

মুক্তিযুদ্ধ বলি আর দেশের সব সংগ্রাম-বিপ্লবে ছাত্রলীগের বিকল্প এই বদ্বীপে কেউ ছিল না কখনো। বামপন্থীদের নানা শাখা-প্রশাখা আর নিজেদের ভেতর মস্কো-চায়নার জটিল সমীকরণে দেশীয় পদ্ধতির ছাত্রলীগ ছিল অর্গানিক এবং সুস্বাদু।

জনগণের একেবারে কাছের দল যার গর্ভে যেমন ছিল শহরের বিত্তবান লোকের সন্তানও অন্যদিকে প্রান্তিক পর্যায়ের কারো সন্তানও। ফলে মূল দল আওয়ামী লীগের মতো একদিকে যেমন এই ছাত্রলীগের ছিল ‘ডাইভার্স’ পরিচয়, অন্যদিকে ছিল প্রজ্ঞা আর জ্ঞানের মিশেলে এক অনন্য বিপ্লবী মানসিকতা।

সময় পাল্টে যায়। সময়ের তীব্র স্রোতে হয়তো বিচ্যুত হয় মানুষ। সংগঠন তো শেষ পর্যন্ত মানুষের হাতেই। কিন্তু যখন এই সংগঠনের ছেলেরা ধর্ষণ বিরোধী মিছিল নিয়ে সামনে এগোয়, যখন মানুষের অক্সিজেন দিতে গিয়ে ছাত্রলীগের ছেলেমেয়েরা অক্সিজেন বিপ্লব করে, যখন এই ছাত্রলীগের কর্মীরা প্রান্তিক জনতার সাথে একই কাতারে এসে তাদের হাত ধরে শান্তির পরশ হয়ে ওঠে তখন ছাত্রলীগের পুরোনো বোঝাপড়া শুরু হয়। যেই বোঝাপড়া এতদিন নিজের সাথে নিজেরই ছিল।

রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে দাঁড়িয়ে বর্তমান সভাপতি সাদ্দাম যখন বলছিল, আমরা এসেছি মৌলবাদের শিকড় উপড়ে ফেলতে। তখন বুক চিরে যে আনন্দ বয়ে গিয়েছিল সেটি অপার্থিব। সাদ্দাম আরও বলছিল, এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যারা কাবুল বানাতে চায় আমরা তা হতে দেবো না। এখানে মৌলবাদীদের ঠাঁই হবে না। আমরা বুঝে যাই গ্রহ তার নক্ষত্রপথে চলে এসেছে। ফলে আমরা আশাবাদী হই।

একথা অনস্বীকার্য যে ছাত্রলীগ এই দেশে ‘কেষ্ট ব্যাটা’র এক ভয়াবহ চরিত্রের আবর্তে পড়ে গেছে। যা কিছু হারাবে, যা কিছু ঘটবে, যা কিছু আশাতীত কিংবা যা কিছু প্রশ্নবোধক তার সবকিছুতেই ছাত্রলীগকে জড়াবার চেষ্টা চলবে। 

চোখের সামনে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া একটি সংগঠন যখন ভুল পথের অংশীদার হয় তখন বিষাদ কিংবা বেদনাগ্রস্থ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও থাকে না।

আগে চেষ্টা হয়েছে, আরও হবে। কারণ এই দেশের সবকিছু হারালে শেষ পর্যন্ত কেষ্ট ব্যাটাই দোষী হয়। তাকেই নিন্দের কলঙ্ক মাথায় নিয়ে চুপ করে থাকতে হয়। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আজকে মৌলবাদের এই দমে যাওয়া ছাত্রলীগের অর্জন সেটা এই সমালোচকরা স্বীকার করবেন না। এই বাস্তবতাও হয়তো ছাত্রলীগের জানা।

বর্তমান কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পরীক্ষিত সৈনিক। ছাত্র রাজনীতির যেই টাইম ফ্রেম রয়েছে সেটার ভেতরেই তারা যে রাজনীতি এখন পর্যন্ত করেছেন সেটি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু আমার কাছে ছাত্রলীগের যে বিষয় এই মুহূর্তে জরুরি বলে মনে হয় সেটি হচ্ছে তাদের নিজেদের সাথেই নিজেদের বোঝাপড়া।

যে অনুযোগ আর অভিযোগ রয়েছে কর্মীদের পক্ষ থেকে কিংবা বিভিন্ন জেলা থেকে শুরু করে কমিটি পর্যায়ে এগুলো মেরামত করা থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ে জনতার সাথে মিশে গিয়ে কাজ করাটাই ছাত্রলীগের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।

আসন্ন নির্বাচনের আগে ছাত্রলীগের নানাবিধ ভূমিকা আর কার্যকলাপ মূল দলের জন্য যেমনটা হবে অতি গুরুত্বপূর্ণ সেই সাথে নিজেদের গায়ে আসা নানাবিধ অপবাদের মোক্ষম জবাব দেওয়ারও এক সুবর্ণ সুযোগ এটি।

আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আমি দেখেছি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্রলীগের উপর সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ভরসা কী করে বাড়ছে। বিশেষ করে ডাকসু নির্বাচনে জয়ী হওয়া চরিত্রদের বর্তমান রাজনীতি এই ছাত্রছাত্রীদের এটা অনুধাবন করাতে সক্ষম হয়েছে যে, ছাত্রলীগই এই দেশের ছাত্ররাজনীতির আলোকবর্তিকা।

এই সত্য যদি হয় ধ্রুব তাহলে ছাত্রলীগের উপর দায়িত্বও আরও দ্বিগুণ হয়ে যায়। ফলে নিজেদের ভেঙে আরও সামনে আগানোই হোক ছাত্রলীগের মূল অঙ্গীকার। নিজেদের সাথে বোঝাপড়ার মতো বিপ্লব আর নেই খুব সম্ভবত।

ব্যারিস্টার নিঝুম মজুমদার ।। আইনজীবী ও সলিসিটর