পেলেও পারলেন না মৃত্যুকে ডজ দিতে
মায়াবী কোনো বিভ্রম নয়। জীবনের অনুশাসন মেনে লোকটা মৃত। অতীত। তবু মনে হবে তিনি জীবিত! কারণ তিনি—পেলে। নিজের নামকে ভদ্রলোক এমনভাবে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন; পেলে সবসময়ই প্রেজেন্ট টেন্স।
ফুটবল থাকলে; পেলে পাস্ট টেন্স হতে পারেন না! এটুকু পড়ে আপনার মনে হতেই পারে, সদ্য মারা যাওয়া একজন ফুটবলারকে নিয়ে জীবন-মৃত্যুর এই ধোঁয়াশা তৈরি কেন!
বিজ্ঞাপন
কারণ—ডাক্তাররা পেলের ডেথ সার্টিফিকেট দিয়েছেন ২৯ ডিসেম্বর রাতে। ভক্তরা জানতে জানতে ৩০ ডিসেম্বর হয়ে যায়। কিন্তু ফুটবলপ্রেমীদের মনে তিনি এখনো জীবিত। স্মৃতির হাওয়ায়, মুগ্ধতার হাওয়ায়, শ্যাম্পেনের ফেনার মতো ভেসে বেড়াচ্ছেন তিনি ফুটবলানুরাগীদের মনোজগতে!
আরও পড়ুন >>> মেসির জাদু না ফরাসি বিপ্লব
তিন তিনটে বিশ্বকাপ জয়ী লোকটা অনেক বড় ফুটবলার ছিলেন। তা নিয়ে তর্কের কী আছে! পৃথিবীতে অন্য কোনো ফুটবলার তো আর তিনটে বিশ্বকাপ জেতেননি! সুতরাং তাকে আপনি রাজা বলুন। সম্রাট বলুন। তাতে কিচ্ছু যায় আসে না।
গায়ের রং বিচারে তাকে আপনি ‘ব্ল্যাক পার্ল’ বা ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’ কিংবা খাঁটি বাংলায় ‘কালো মানিক’ বলুন তাতে পেলের ফুটবলীয় দ্যুতি বাড়বে না। কমবেও না। তবে ফুটবলার পেলের মৃত্যু হয়েছিল সেই সত্তর দশকে। কিন্তু মানুষের মনে, স্মৃতিতে, স্নায়ুতে তিনি জীবিত ছিলেন। আছেন। হয়তো থাকবেন। এবং সেটা অশরীরীভাবে।
ডাক্তার পেলের ডেথ সার্টিফিকেট ঘোষণার পর বিশ্ব গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পেলে, পেলে আর পেলে! পত্রিকার পাতায় শিরোনামে পেলে। টেলিভিশনের পর্দায় হেডলাইনে সেই পেলে।
পৃথিবীতে অন্য কোনো ফুটবলার তো আর তিনটে বিশ্বকাপ জেতেননি! সুতরাং তাকে আপনি রাজা বলুন। সম্রাট বলুন। তাতে কিচ্ছু যায় আসে না...
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষের ওয়ালে ওয়ালে পেলে! তিনটা বিশ্বকাপ জেতা কিংবা নিজের নামের পাশে এক হাজার দুই’শ একাশি গোল রাখার চেয়ে কঠিন কাজ ফুটবল থেকে অবসরে যাওয়ার পরও প্রজন্মের পর প্রজন্ম নিজের ইমেজ এভাবে পরিবাহিত করা! সেই চ্যালেঞ্জে তিনি উতরে গেছেন। এবং রাজকীয়ভাবে।
কিন্তু তিনটা বিশ্বকাপ জেতার পরও বলতে হবে ফুটবল মাঠে তাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর লোক বিশ্ব দেখেছে। যে ব্রিটিশরা পেলেকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিল, ছেষট্টির বিশ্বকাপের আগে ওয়ার্ল্ড সকারে যারা লিখেছিলেন—'পেলে একডজ দু’বার দেন না। একভাবে দু’বার পাস বাড়ান না। একই ভঙ্গিতে দু’বার গোল করেন না।’
আরও পড়ুন >>> ফুটবল তারকারা যেভাবে উঠে এসেছেন
আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি বলছে এসব মিথ! সেই মিথ চ্যালেঞ্জ জানানোর ফুটবলীয় ডকুমেন্টারি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ছিয়াশির বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা নামের পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি লোকটার এক গোল!
মৃত্যুর আগে মেসির হাতে বিশ্বকাপ দেখে পেলে যতই বলুন, ‘যোগ্য লোকের হাতেই কাপটা উঠেছে। ওর ক্যারিয়ারের গতিপথ অনুযায়ী কাপটাও মেসির প্রাপ্য!’
চব্বিশ বছরের আগে দুটো বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা আর বারো গোল করা এমবাপ্পেকে নিয়ে যতই উচ্ছ্বসিত হোন না কেন পেলে, তিনি ভালো করেই জানেন ফুটবল বিশ্বে তাকে ব্যক্তিগত স্কিলে টক্কর দেওয়ার লোক একজনই। দিয়েগো ম্যারাডোনা।
ফিফার জনজরিপে যিনি পেলেকে অনেক পেছনে ফেলে শতাব্দীর সেরা ফুটবলারের খেতাব জিতে গেছেন! ফিফা টেকনিক্যাল কমিটি আর জুরি বোর্ডের সিদ্ধান্তে ম্যারাডোনার সাথে যৌথভাবে শতাব্দীর সেরা ফুটবলার ঘোষণা করা হয় পেলেকে।
তাহলে তিনটা বিশ্বকাপ জয়কে কী এক বিশ্বকাপের সমান্তরালে এনে দাঁড় করালেন না ম্যারাডোনা? নাকি ফিফাকে সেটা করতে বাধ্য করলেন ছোটখাটো এই আর্জেন্টাইন! সেই বিতর্ক চলমান থাকবে ফুটবল বিশ্বে।
আরও পড়ুন >>> ফুটবলে বাংলাদেশ কোথায়?
তবে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল সৌন্দর্য পেলের শিল্পী সত্ত্বায় বিকশিত। পেলের মাধ্যমে ফুটবলের সর্বজনীন হয়ে ওঠা স্বীকৃত। কিন্তু ফুটবল সমুদ্রে একের পর এক ঢেউ ভেঙে উপকূলে দাঁড়িয়ে থাকা জনসমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাওয়ায় রাজাকে পেছনে ফেলেছেন ম্যারাডোনা।
পেলে দুর্ধর্ষ, অসাধারণ। তা নিয়ে তর্কের জায়গা নেই। তবে মার খেয়ে রক্তাক্ত হতে হতে একা বিজয় মঞ্চে তিনি এগিয়ে যেতে পারেননি। সাহস আর সহনশীলতায় রাজাকে পেছনে ফেলেছিলেন রাজপুত্র।
পেলে বাষট্টির সেমিফাইনাল আর ফাইনাল খেলতে পারেননি চোটের কারণে। ছেষট্টিতে দুই ম্যাচ পরেই বাইরে। সম্রাট-রাজা মার খেয়েও রাজকীয় ক্ষমতা দেখাতে পারেননি মাঠে!
ম্যারাডোনা মৃত্যুর পর নিজেই লিখেছিলেন, ‘স্বর্গে আমরা এক সঙ্গে ফুটবল খেলবো।’ পেলে পৌঁছে যাওয়ায় স্বর্গেও সবর্কালের কী দারুণ সেরা একাদশ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে!
পেলেকে ছাড়াই বাষট্টির বিশ্বকাপ ফাইনাল জিতেছে ব্রাজিল। তাই সত্তরে বিশ্বকাপ জয় ছিল পেলের জন্য ঘরে-বাইরে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেখানে নিজেকে প্রমাণ করে দুই মলাটের মধ্যে তিনি জায়গা পেয়ে যান ‘ফুটবল সম্রাট’ হিসেবে।
সম্রাট তার সাম্রাজ্য ফেলে অন্ততলোকে। সেখানে হয়তো নিজের ইচ্ছা পূরণে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ম্যারাডোনা মৃত্যুর পর নিজেই লিখেছিলেন, ‘স্বর্গে আমরা এক সঙ্গে ফুটবল খেলবো।’ পেলে পৌঁছে যাওয়ায় স্বর্গেও সবর্কালের কী দারুণ সেরা একাদশ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে! গ্যারিঞ্জা-সক্রেটিস-বেস্ট-ম্যারাডোনা-রোসি.... কী সব নাম!
আরও পড়ুন >>> ফুটবল তারকা : যাদের শৈশব কেটেছে দারিদ্র্যে
তবে হ্যাঁ, এদের মধ্যে চরিত্র হিসেবে একেকজন একেক রকম। মাঠের বাইরে পেলে অন্যরকম এক ভাবমূর্তি ধরে রেখে চলে গেলেন। তাই তাকে নিয়ে কত বই, কত গান, কত সিনেমা।
তিনটা বিশ্বকাপে নয়, মৃত্যুর পরও পেলে উজ্জ্বল তার স্বচ্ছ ভাবমূর্তিতে। সংখ্যা দিয়ে পেলেকে মাপতে গেলে ফুটবল তার সৌন্দর্য হারায়।
পেলে সারা জীবন ছিলেন ফুটবল সৌন্দর্যের পূজারী। তার পক্ষে তাই বিশ্বব্যাপী ঐ বাণী ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব; ‘প্লে দ্য ফুটবল, সি দ্য ওয়ার্ল্ড, বি অ্যা জেন্টলম্যান, ফ্লাই দ্য ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ।’ তিনি যখন দূর আকাশে তখন দিন তিনেক তো ব্রাজিলের পতাকা অর্ধনমিত থাকবেই।
ওয়ার্ল্ডসকারের লেখা সত্যি হোক আর ‘মিথ’-ই হোক, পেলে একশ বিশ গজের সবুজ মাঠে অনেকভাবেই ডজ দিতে পারতেন। কিন্তু মৃত্যুকে ডজ দেওয়া সম্ভব হয়নি। মৃত্যু এমন এক ডিফেন্স যাকে ডজ দিয়ে জীবনে বেরিয়ে যাওয়া যায় না। পেলেও পারেননি। রাজা-বাদশা-রাজপুত্র কেউ পারেন না!
অঘোর মন্ডল ।। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক