মুঠোফোনে আসক্তি বাড়ার কারণ কী?
কয়েকদিন আগে নিউমার্কেটে ফুটপাতে হাঁটছিলাম, হাঁটতে গিয়ে চোখে পড়ল একজন দোকানি অধীর আগ্রহে মুঠোফোনের দিকে তাকিয়ে আছে, বোঝার চেষ্টা করলাম। পসরা সাজিয়ে কী এমন দেখছেন? বুঝতে পারলাম মুঠোফোনে গেমস খেলছেন। ওষুধের দোকানে ওষুধ কিনতে গিয়েছি, গিয়ে দেখি দোকানি গেমস খেলছেন। এটিএম বুথে টাকা তুলতে গিয়েছি, সেখানেও গিয়ে দেখি বুথের পাহারাদার দিব্যি বুথের ভেতরে চেয়ারে বসে শীতাতপ যন্ত্রের বাতাস উপভোগ করছেন আর মুঠোফোনে গেমস খেলছেন। শুধু কি তাই, উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিবর্গের সভাতে বসে গেমস খেলা দেখার অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। ক’দিন আগে উড়োজাহাজে কক্সবাজার যাচ্ছিলাম, সেখানে লক্ষ করি, অভিভাবক দু’বছরের বাচ্চার হাতে মুঠোফোন দিয়ে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। ট্রেনে চড়ে ভারতে যাচ্ছিলাম, সেখানে দেখেছি একজন মা তার বাচ্চার হাতে মুঠোফোন দিয়ে প্রকৃতি উপভোগ করছেন।
করোনার সময়ে প্রথমদিকে শিশুদের অনলাইন ক্লাসে পাঠদানের বিষয়ে যে ক’জন প্রথম মতামত প্রকাশ করেছিলেন তাদের মধ্যে আমি ছিলাম অন্যতম। পরবর্তী সময়ে দেখা গেল বাচ্চারা মুঠোফোনে ক্লাসের দোহাই দিয়ে মেসেঞ্জারের মাধ্যমে বিভিন্ন গেমসে ঢুকে যাচ্ছে। নিজেদের মতো সময় অতিক্রম করছে। একটি অভিজাত পরিবারের সন্তান অভিজাত বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে, মুঠোফোনে তাকে খেলতে না দিলে সে সন্তান তেড়ে আসে অভিভাবকের দিকে! ঘরে ঘরে স্মার্ট টেলিভিশন, সেখানেও বাচ্চারা গেমস খেলার সুযোগ গ্রহণ করছে। এমন একটি পরিবারের সঙ্গে আমার পরিচয় রয়েছে, যেখানে বাসায় ইন্টারনেট সংযোগ না থাকলে বাচ্চাটা মায়ের সঙ্গে থাকে, ইন্টারনেট সংযোগ এলে সে বাচ্চা মুঠোফোনে আসক্ত হয়ে পড়ে। এমনটিও দেখেছি, ১০ বছর বয়সী বাচ্চা আরেক বাচ্চার বাসার দরজায় রাত দশটায় কড়া নাড়ে ‘টপ আপ’ কেনার জন্য। বাচ্চারা গভীর রাত পর্যন্ত মুঠোফোনে সময় কাটাচ্ছে। সেদিন এক অভিভাবক বলছিলেন, বাচ্চা যতক্ষণ অনলাইনে ক্লাস করে ততক্ষণ তিনি বাচ্চার পাশে বসে থাকেন, যেন ক্লাসের বাইরে অন্য কোনো সাইটে ঢুকে না পড়ে। করোনাকালীন সময়ে এক অভিভাবক রীতিমতো বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের কাছে আর্তনাদ করে বলেছিলেন, দয়া করে বিদ্যালয়ের পোশাক পরে ভিডিও অন করে পাঠদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, কিন্তু বাচ্চারা সবাই একত্রিত হয়ে শ্রেণিশিক্ষককে বোঝায়, এভাবে তারা ক্লাস করবে না। এই মুঠোফোন নানা রকমের অশান্তি তৈরির কারখানা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিজ্ঞাপন
বাচ্চারা এখন চোর পুলিশ, কানামাছি, দাড়িয়াবান্ধা খেলে না, তারা একসঙ্গে জমায়েত হলে কার কত পয়েন্ট তাই নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে এই বাচ্চাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা হয় আমারও। কী হবে তাদের ভবিষ্যৎ?
আমার পরিচিত এক পরিবার আছে, তার পরিবারের বাচ্চা বেড়াতে বের হলে গাড়িতে পেনড্রাইভে গান শুনবে আর মুঠোফোনে গেমস খেলে গন্তব্যে যাবে। বাচ্চারা এখন চোর পুলিশ, কানামাছি, দাড়িয়াবান্ধা খেলে না, তারা একসঙ্গে জমায়েত হলে কার কত পয়েন্ট তাই নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে এই বাচ্চাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা হয় আমারও। কী হবে তাদের ভবিষ্যৎ? কেউ কি ভাবছি এই বিষয় নিয়ে?
নিজের জীবনের দিকে ফিরে তাকালে দেখি, আমার বাবা রাজধানীর ধূপখোলা মেলা থেকে কাঠের ঘোড়া এনে দিয়েছিলেন, বিকেল হলে যেটাতে চড়ে ছাদে খেলতাম। ব্যাডমিন্টন, লুডু, বাগাডুলি খেলা, ক্যারমবোর্ড এনে দিতেন আমার বাবা। আমরা তিন ভাইবোন তাই নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন বিকেল হলে, ছুটির দিনে মাঠে নিয়ে যেতেন, নদীর পাড়ে নিয়ে যেতেন। আহারে সোনালি শৈশব আমার। এখনকার বাচ্চারা না পায় মাঠ, না আছে নিরাপত্তা। কোথায় যাবে তারা? তাহলে প্রতিকার কী?
প্রতিকারের প্রথম ধাপ বাচ্চাকে গুণগত সময় দিতে হবে, বাচ্চাকে দায়িত্বশীল হওয়ার শিক্ষা প্রদান করতে হবে, বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করা শেখাতে হবে। নিজেদের মানসিক তুষ্টির কথা ভেবে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গঠন থেকে বিরত থাকতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসনে বড় করতে হবে। মাঠে খেলতে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। নিজেদের সামান্য মনোমালিন্যের জন্য বাচ্চাদের আত্মীয়স্বজনদের সান্নিধ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। আমার পরিচিত এক পরিবার আছে, যে পরিবারের অন্তঃকলহের কারণে ভাতিজা-ভাতিজির সঙ্গে বছরের পর বছর দেখা হয় না। যখন দেখা হয় তখন ফুপু, ভাইয়ের ছেলেকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদে।
ছুটির দিনে বাচ্চাকে নিয়ে নদীর পাড়ে না গিয়ে ফাস্ট ফুডের দোকানে বসে মেয়নেজ মেশানো বার্গার, হট ডগ খাওয়া, দামি মোবাইল বাচ্চাদের হাতে তুলে দেওয়ার নাম আধুনিকতা নয়। আধুনিকতা তাকেই বলে যেখানে মননশীলতা, মেধা, বিনয়, সহমর্মিতা, সহযোগিতা থাকবে।
ব্যক্তিজীবনে আমি যৌথ পরিবারে বড় হয়েছিলাম। চাচাতো ভাইবোন সবাই এক মন, এক আত্মা। সে পরিবারে বড় হয়ে শিখেছি, একতাই বল, একা থাকায় কোনো সার্থকতা নেই। সেই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হল জীবনে যে কক্ষে, যে সিটে উঠেছিলাম, সাত বছর সেই কক্ষ সেই বিছানা ব্যবহার করে বের হয়েছি। আমাদের বড় হওয়ার পেছনে কোনো প্রযুক্তি ছিল না, ছিল এক নিরাপদ পরিবেশ, ছিল আদর স্নেহ, মায়া মমতামাখা জীবন।
মুঠোফোন আসক্তি থেকে বের হওয়ার অন্যতম উপায় পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা। বাচ্চা কার সঙ্গে যাচ্ছে, কী করছে, সেগুলোর দিকে মনোযোগ দেওয়া।
ছুটির দিনে বাচ্চাকে নিয়ে নদীর পাড়ে না গিয়ে ফাস্ট ফুডের দোকানে বসে মেয়নেজ মেশানো বার্গার, হট ডগ খাওয়া, দামি মোবাইল বাচ্চাদের হাতে তুলে দেওয়ার নাম আধুনিকতা নয়। আধুনিকতা তাকেই বলে যেখানে মননশীলতা, মেধা, বিনয়, সহমর্মিতা, সহযোগিতা থাকবে।
করোনাভাইরাসের কারণে অনেকে কর্মহীন হয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়েছেন। এক্ষেত্রে পরিবারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হলেও বাচ্চাদের মানসিক লাভ হয়েছে বহুলাংশে, শহরের বাচ্চারা দাদু-দাদির আঁচলে ফিরতে পেরেছে। করোনাভাইরাসে ক্ষতি হয়েছে অনেক, তবু শিক্ষাও মিলেছে। গ্রামে গ্রামে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে শহরমুখী প্রবণতা কমে যাবে, এ বিষয়টি শিখিয়েছে করোনাভাইরাস।
গ্রামমুখী হওয়া বাড়িয়ে দেবে মাটির সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক। সুতরাং মুঠোফোনে আসক্তির জন্য বাচ্চাকে দায়ী না করে অভিভাবকরা শুধরে গেলে সামঞ্জস্যতা কমবে। ভারসাম্য রক্ষা হবে প্রকৃতির। সুতরাং প্রযুক্তি ব্যবহার বন্ধ করে নয়, প্রযুক্তিকে সঙ্গে নিয়ে তাকে নিয়ন্ত্রণে রেখে অনাগত সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য শিশুদের মুঠোফোনের আসক্তি থেকে মুক্ত করা সময়ের দাবি।
ড. জেবউননেছা ।। অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়