আমেরিকার প্রশাসন বাংলাদেশের জন্য কতটা উপকারী?
প্রেসিডেন্ট বাইডেন আমেরিকায় ক্ষমতায় আসার পরে অনেকেই মনে করেছিলেন, জলবায়ুর ক্ষতিকর দিক থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে একটি বড় ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ঠিক তাই হয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে বাইডেন আমেরিকাকে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা থেকে বাঁচাতে যে নীতি গ্রহণ করেছেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জলবায়ু সম্পর্কিত প্যারিস এগ্রিমেন্ট গত চার বছর স্থবির হয়েছিল। এতে কেবল আমেরিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাইডেন, সরকারকে ৩০ ভাগ সরকারি জমি ও পানি আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সংরক্ষণ করার জন্য বলেছে এবং তিনি একটি টাস্কফোর্স তৈরি করেছেন, যারা সরকারের পরিবেশনীতি অনুযায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমছে কি না, তা দেখবেন। বাইডেন অবশ্য আরও নতুন নতুন কমিশন করবেন, সরকারের মধ্যে যাতে তার পরিবেশবান্ধব নীতিগুলো বাস্তবায়িত হয় এবং সেভাবেই কাজের সুযোগ বাড়ে; পাশাপাশি কয়লাখনির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যারা, তাদের স্থানান্তরকেও সরকার সহায়তা দিতে পারেন। আর এ লক্ষ্যে বাইডেন দুই ট্রিলিয়ন ডলারের ক্লাইমেট চেঞ্জ এজেন্ডা পাস করতে পারেন। এই নতুন নীতি অনুসরণ করার ফলে বাংলাদেশ উপকৃত হবে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এদেশের বহু মানুষ বাস্তুত্যাগ করতে বাধ্য হয়। গৃহহারা, ফসলহারা মানুষের দিকে চেয়ে কাজ করার সুযোগ হবে বিশ্ব অঙ্গনে। উল্লেখ্য, গত এক দশকে শুধু ৭ লাখ মানুষ স্থানচ্যুত হয়েছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, আমাদের অভ্যন্তরীণ মাইগ্রেশন যে হারে হচ্ছে, তাতে ২০৫০ সাল নাগাদ এই মাইগ্রেশন ১৩ দশমিক ৩ মিলিয়নে গিয়ে দাঁড়াবে। অন্যদিকে কোভিড-১৯ অতিমারিতে বিপুলসংখ্যক কম আয়ের মানুষ তাদের জীবিকা হারিয়ে গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে, আবার উত্তরবঙ্গসহ বেশ কিছু স্থানে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ঢাকা শহরে কাজের খোঁজে এসেছেন অনেক কৃষক। এসব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সহযোগিতা পাবে আমেরিকার কাছ থেকে।
বিজ্ঞাপন
নতুন নীতি অনুসরণ করার ফলে বাংলাদেশ উপকৃত হবে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এদেশের বহু মানুষ বাস্তুত্যাগ করতে বাধ্য হয়। গৃহহারা, ফসলহারা মানুষের দিকে চেয়ে কাজ করার সুযোগ হবে বিশ্ব অঙ্গনে।
২০২০ সালের নভেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন এবং ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত কমলা হ্যারিসকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। বারাক ওবামা ২০০৮ সালের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বারাক ওবামার প্রশাসন ও শেখ হাসিনা সরকার একসঙ্গে আগেই কাজ করেছে। ফলে বাংলাদেশ সম্পর্কে ওবামা প্রশাসনের ইতিবাচক ধারণা ছিল সবসময়। বারাক ওবামা এদেশের মোবাইল ব্যাংকিং নিয়ে ২০১৫ সালে প্রশংসা করেন। শেখ হাসিনা সরকারের অগ্রগতিতে সন্তুষ্ট হয়ে এদেশকে তিনি এশিয়ার টাইগার আখ্যা দেন। ওবামা সরকারের সময় ২০১৪ সালে সপ্তাহব্যাপী সফরকালে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অবদানের কথা প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শান্তিরক্ষা সম্মেলনে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অবদানের কথা তুলে ধরেছিলেন। সেই সম্মেলনে মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এবং রুয়ান্ডার রাষ্ট্রপতি পল কাগমে উপস্থিত ছিলেন। এদিক থেকে আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শেখ হাসিনাকে ভালো করেই চেনেন ও জানেন। এই পরিচয়ের ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে বাংলাদেশের ওপর।
আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন ও জঙ্গিবাদবিরোধী প্রসঙ্গে এ দুই রাষ্ট্র বেশকিছু সহায়তামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ওবামা প্রশাসনের আন্তর্জাতিক উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ, স্বাস্থ্য উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং পরিবেশ উন্নয়নমূলক অনেক কাজে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান সহযোগী ছিল। ২০১২ সালে রাষ্ট্রদ্বয়ের মধ্যে একটি কৌশলগত চুক্তি হয়। যুক্তরাষ্ট্র চলতি বছর আগস্ট মাসে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এজন্য প্রতি তিন থেকে চার মাস পর ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম এগ্রিমেন্ট (টিকফা)’-এর ইন্টারসেশনাল সভা করার প্রস্তাব দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওই সভায় যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের স্থগিতকৃত জিএসপি সুবিধা পুনরায় চালুর বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়। পরর্বতী প্রকল্প চালু হলে বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা প্রদানের বিষয় বিবেচনা করার সুযোগ আছে।
কোভিড-১৯ অতিমারিতে বিপুলসংখ্যক কম আয়ের মানুষ তাদের জীবিকা হারিয়ে গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে, আবার উত্তরবঙ্গসহ বেশ কিছু স্থানে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ঢাকা শহরে কাজের খোঁজে এসেছেন অনেক কৃষক। এসব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সহযোগিতা পাবে আমেরিকার কাছ থেকে।
শেখ হাসিনা সরকার মনে করে, জো বাইডেনের সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তৈরি পোশাক, হেলথ প্রোডাক্ট রফতানি, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, করোনাকালে তৈরি পোশাকের ক্রয় আদেশ বাতিল না করে ভ্যাকসিনসহ অন্যান্য মেডিকেল সামগ্রী উৎপাদন, শিল্প-কারখানা বাংলাদেশে রিলোকেশন, বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কারিগরি সহযোগিতা বৃদ্ধিসহ বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানের তৈরি পণ্য সহজে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির বিষয়ে মার্কিন সরকারের সহযোগিতা পাবে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে, এদেশে গণতন্ত্র আছে, আর জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এদেশের অবস্থান বিশ্বব্যাপী অভিনন্দিত। ২০১৬ সালেও বাংলাদেশ এশিয়ার মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পর সবচেয়ে বেশি মার্কিন সহায়তা লাভ করেছে। নভেম্বরে জয়ী হয়ে জো বাইডেন নিজেকে এমন এক নেতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন যিনি অনৈক্য নয় বরং করোনা মহামারি এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অশান্তির মধ্যে পতিত নিজের দেশ ও বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করবেন বলেছিলেন। তার বক্তব্যের এই স্পিরিট বাংলাদেশকে একসঙ্গে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করেছে। দুই দেশের সম্পর্ক মানবিক বিশ্ব গড়ার পথে এগিয়ে চলেছে।
ড. মিল্টন বিশ্বাস ।। অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়