বৈশ্বিক খাদ্য সংকট : বাংলাদেশ কি প্রস্তুত?
ইউরোপ ও আমেরিকা সফর শেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গণমাধ্যমের সাথে কথা বলার সময় ২০২৩ সালে বিশ্বে খাদ্য সংকট প্রকট হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। ইতিমধ্যেই জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থা, কৃষি সংস্থাসহ অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানও অনুরূপ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের অজুহাতে দেশে খাদ্যপণ্যের দাম অনেক দিন ধরে ক্রমাগতভাবেই বেড়েই চলছিল।
সরকার বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে, তারপরও খাদ্যপণ্যের দাম কমাতে পারেনি। সরকারের নানামুখী তৎপরতায় করোনা মোকাবিলায় যেরকম সফলতা আছে, তেমনি মৎস্য, পশুসম্পদেও দেশীয় চাহিদা মেটানোর মতো সক্ষমতা দেখিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
প্রধানমন্ত্রী খাদ্য সংকট মোকাবিলায় দেশের সব অনাবাদী কৃষি জমি চাষের আওতায় আনা ও স্থানীয় কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর ওপর বেশ জোর দিয়েছেন। তবে অনেক জায়গায় লোকজন অনেক অনাবাদী জমিতে লাল পতাকা টাঙিয়ে দিয়েছেন অনেক জায়গায় তা নিয়ে উৎকণ্ঠাও দেখা দিয়েছে।
আরও পড়ুন : বৈশ্বিক সংকট : দরকার মুদ্রানীতি ও বাজেটের যথাযথ সমন্বয়
তবে মানুষ কেন চাষাবাদ না করে কৃষি জমি খালি রেখেছেন অথবা কৃষিতে কৃষক বারবার কেন লোকসান গুনছে সেই বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য দেখা যায়নি। আবার দুই হাজার টাকার জন্য কৃষককে জেলে পাঠানোর মতো ঘৃণ্য দৃষ্টান্তও কম নয়।
কৃষি দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড হলেও দেশের কৃষকেরা এখনো তাদের ন্যায্য মর্যাদা পাননি। কৃষি উৎপাদনে বারবার জোর দেওয়ার কথা বলা হলেও প্রকারান্তরে মাঠ পর্যায়ে তার প্রতিফলন সীমিত।
ইতিমধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রধানরা খাদ্য ও জ্বালানি সংকটের বিষয়ে জনগণকে সতর্কবার্তা দিয়েছেন। জাতিসংঘ প্রধান আন্তোনিও গুতেরেস (António Guterres) ২০২২ সাল থেকেই দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা কথা বলেছেন। আর ২০২৩ সালে তা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
কৃষি দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড হলেও দেশের কৃষকেরা এখনো তাদের ন্যায্য মর্যাদা পাননি। কৃষি উৎপাদনে বারবার জোর দেওয়ার কথা বলা হলেও প্রকারান্তরে মাঠ পর্যায়ে তার প্রতিফলন সীমিত।
এদিকে জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (ফাও)-এর তথ্যমতে ২০২৩ সালে বিশ্বের প্রায় ৪৫টি দেশ চরম খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হবে। যার মধ্যে ১টি বাংলাদেশ। অর্থনীতিবিদদের মতে, ১৯৩০ সালের মতো আরও একটি সাল দেখতে চলেছে বিশ্ব। আর বাংলাদেশ আবারও পড়তে পারে 'ছিয়াত্তরের মন্বন্তর'-এ।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির তথ্যমতে, ২০২৩ সালের দুর্ভিক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বিশ্বের ৪৫টি দেশের প্রায় ২০ কোটি মানুষ। অর্থনীতিবিদরা ২০২৩ সালের সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে ৩টি প্রধান কারণ দাঁড় করিয়েছেন।
আরও পড়ুন : অর্থনৈতিক মন্দার শিকড় কোথায়?
করোনা মহামারি ও বিশ্ব অর্থনীতিতে এর প্রভাব, বিশ্বের প্রধান দুটি দেশের ভেতরকার যুদ্ধ এবং নানাবিধ সংঘাত ২০২৩ সালের সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের কারণ। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনও দুর্ভিক্ষের আর একটি কারণ বলে মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
পৃথিবীর মধ্যে কয়েকটি দেশকে এগ্রিকালচারাল পাওয়ার হাউস বলা হয়। ব্রাজিল, ক্যালিফোর্নিয়া, চায়না, কানাডা, আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশ এবং ইউক্রেন রাশিয়া। পুরো বিশ্বের মোট গমের ৩০ ভাগই উৎপাদিত হয় রাশিয়ায়। সূর্যমুখী তেলের ৬৫ ভাগ উৎপাদিত হয় রাশিয়ায়। যেই সংখ্যা নেহাতই কম নয়। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে বিশ্বের মোট খাদ্য সরবরাহের রাশিয়ার ভূমিকা কত বিশাল।
যুদ্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ায় উৎপাদিত খাদ্য দ্রব্যের পুরোটাই বিভিন্ন দেশে সরবরাহ থেকে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এদিকে ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে সেখানে খাদ্যশস্য উৎপাদনই হচ্ছে ব্যাহত। ইতিমধ্যেই ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে এই বছর শস্য উৎপাদন নেমে যেতে পারে অর্ধেকে। আর উৎপাদিত ফসল রপ্তানিতে পোহাতে হচ্ছে নানাবিধ বাধা। যার ধাক্কা বাংলাদেশেও পড়েছে।
তবে আশার কথা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বাংলাদেশের কৃষি বিশ্বের বুকে বীরদর্পে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশের কৃষকেরা।
করোনাকালে বিশ্বের অনেক শক্তিশালী দেশ যখন অর্থনৈতিক ভগ্নদশায় নিমজ্জিত ছিল সেই সময়ও বাংলাদেশের মানুষের কাছে আশার প্রদীপ হয়ে শিয়রে জ্বলেছে বাংলাদেশের কৃষি। বাংলাদেশ প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ কৃষি উপকরণ, বিশেষ করে সার বিদেশ থেকে আমদানি করে।
আরও পড়ুন : সন্নিকটে সংকট, শঙ্কিত কি অর্থনীতি!
ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে চলমান যুদ্ধের কারণে ২০২১ সালের তুলনায় এই বছর সার আমদানির জন্য প্রায় ৪ গুণ বেশি পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হয়েছে। বিপুল জনগোষ্ঠীর এই দেশে খাদ্যপণ্য আমদানি করে চাহিদা মেটানো কঠিন। তাই আমাদের দেশীয় উৎপাদন বাড়িয়ে যেকোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। আর এজন্য এখন থেকেই বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
বিশেষ করে সার, বীজ, কীটনাশক, ডিজেল, কৃষি যন্ত্রপাতি, বিদ্যুতের ওপর যেন কোনো আঘাত না আসে সেই বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। কৃষি উপকরণগুলো কৃষকের হাতের নাগালে থাকে তার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
করোনা মহামারি ও বিশ্ব অর্থনীতিতে এর প্রভাব, বিশ্বের প্রধান দুটি দেশের ভেতরকার যুদ্ধ এবং নানাবিধ সংঘাত ২০২৩ সালের সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের কারণ।
প্রকৃত কৃষকেরা যেন সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা ও সহায়তাগুলো পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার কৃষি খাতে বিভিন্ন প্রণোদনা দেন কিন্তু সরকার দলীয় লোকজনের পরিচয়ে প্রকৃত কৃষকের বাইরে একটি গোষ্ঠী সেগুলো ভাগিয়ে নেন। এটা কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে।
ফসলের ভরা মৌসুমে কৃষকেরা কৃষির খরচ নির্বাহ করতে অগ্রিম ফসল বিক্রি বন্ধ করতে স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। কৃষকের উৎপাদনের একটি বড় অংশ মধ্যস্বত্বভোগী ও ফড়িয়ারা নিয়ে নেন। সেটা বন্ধ করতে সরকারি উদ্যোগে কৃষি বিপণনে সমবায় পদ্ধতি জোরদারকরণ বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি বন্ধ করতে হবে।
আরও পড়ুন : মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা
দেশে উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের আমদানির বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মৎস্য সম্পদ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ হলেও বিপুল মাছ আমদানি হয়। পেঁয়াজের মৌসুমে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি হয়। এসব বিষয় কঠোরভাবে তদারকি না করলে দেশীয় কৃষকেরা তাদের পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাবেন না।
কৃষি গবেষণায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কৃষির আধুনিকীকরণ ও উৎপাদন বাড়াতে এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য জলবায়ু অভিঘাত সহিষ্ণু উদ্ভাবনী জাত নিয়ে গবেষণা বাড়াতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে আধুনিক জাত ও প্রযুক্তির জ্ঞান কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে।
এছাড়াও প্রতিবছর প্রায় ১ শতাংশ হারে কৃষিজমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে এবং ১.২২ শতাংশ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা কৃষি জমি হ্রাসে বড় কারণ। গ্রামাঞ্চলে বাসস্থান তৈরির জন্য প্রচুর পরিমাণ কৃষিজমি কমে যাচ্ছে, সেই ক্ষেত্রে যদি বহুতল ভবনের দিকে যাওয়া যায় তবে কৃষিজমি রক্ষা করা যাবে।
এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির প্রাপ্যতাও কমে যাওয়া, সাগরের তলদেশে উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় পানিতে লবনাক্ততা বাড়ছে। এসব বিষয়ে এখনই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। বৈশ্বিক খাদ্য পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, বাংলাদেশ তা মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।
এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)