১০ ডিসেম্বর : কী খেলা হবে?
রাজনীতির ভাষা কেমন হওয়া উচিত? পুরোনো রাজনীতিকরা বলছেন, অবক্ষয়ের মুখ দেখতে হচ্ছে রাজনীতিকে। কথাটা উঠলো, কারণ রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন নেতাদের মুখে ‘খেলা হবে’ নামের এক স্লোগান বড় আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
রাজনীতি বিষয়ক সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্নে আসতে পারে—কে এই শ্লোগানের জনক? উত্তর হবে হয়তো কোনো একজনের নাম। তবে এখন সরকার ও বিরোধী দলের নেতারা পাল্টাপাল্টি এই স্লোগান ব্যবহার করছেন।
বিজ্ঞাপন
রাজনীতিতে বিরোধিতা আছে, পাল্টাপাল্টি আছে, হুশিয়ারি উচ্চারণও আছে। কিন্তু ‘খেলা হবে’র মতো ভাষার এমন প্রবল প্রয়োগ অতীতে দেখা যায়নি। আর যায়নি বলেই বিস্মিত প্রকৃত রাজনীতিবিদরা।
আরও পড়ুন : দলাদলি নয় গলাগলি হোক
আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা ও দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘খেলা হবে’ কোনো রাজনৈতিক স্লোগান হতে পারে না। সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘আমরা আজকাল একটা স্লোগান বের করেছি, খেলা হবে। আমার দৃষ্টিতে এটা রাজনৈতিক স্লোগান না, হতে পারে না। রাজনীতিতে মারপিট হবে, রাজনৈতিকভাবে আমার বক্তব্য আমি দেব। কী একটা কথা, খেলা হবে, খেলা হবে। আমার বিবেক বলে এই স্লোগান এভাবে না দেওয়াই উচিত।’
কিন্তু ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের নায়ক তোফায়েল আহমেদ যা-ই বলুন না কেন, এখনকার বাস্তবতা হলো, শালীনতা বা সৌজন্যের সীমা ছাড়িয়ে অত্যন্ত আক্রমণাত্মক ভাষা প্রয়োগ করে মাঠ গরম না করলে আর বাহবা পাওয়া যায় না। রাজনৈতিক শিক্ষাদীক্ষার বড় পরিবর্তন যে ঘটেছে সেটা টের পাওয়া যায় প্রতিনিয়ত।
রাজনীতিতে বিরোধিতা আছে, পাল্টাপাল্টি আছে, হুশিয়ারি উচ্চারণও আছে। কিন্তু ‘খেলা হবে’র মতো ভাষার এমন প্রবল প্রয়োগ অতীতে দেখা যায়নি।
রাজনীতিতে একদলের সঙ্গে অন্যদলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। একদল অন্যদলকে আক্রমণ করবে, এটাও অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু আক্রমণ তো হবে রাজনৈতিক, সমালোচনা হবে নীতির প্রশ্নে, রুচি বহির্ভূতভাবে কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ কাম্য নয়।
১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় মহাসমাবেশ কেন্দ্র করে যেটা হচ্ছে তা এক কথায় রাজনীতির এক ভিন্ন চেহারা। একটা উত্তেজনা ও আতঙ্ক এর মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে জনজীবনে। ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে ৩০০ নেতা-কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। সেখানে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে একজন মারাও গেছে।
আরও পড়ুন : আন্দোলনের ডামাডোলে থাকুক শান্তির বারতা
পুলিশের বক্তব্য হলো, সমাবেশ আরও তিনদিন পর, অথচ তিনদিন আগেই বিএনপির কর্মীরা দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান নিয়েছে। সরিয়ে দিতে গেলে পুলিশকে লক্ষ্য করে তারা ইট পাটকেল নিক্ষেপ ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে পুলিশের অন্তত ৫০ সদস্য আহত হয়েছেন।
ঘটনার নানারকম ব্যাখ্যা আসবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সংঘর্ষ হয়েছে এবং একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এর একটি বড় কারণ হলো, এই সমাবেশ নিয়ে বিএনপি নেতারাই এমন বক্তব্য দিয়েছেন, যে কারণেই এটি একটি সাধারণ সমাবেশ বলে আর ভাবতে পারছে না সরকার ও শাসক দল এবং মানুষও।
বিএনপি নেতা আমান উল্লাহ আমান বলেছিলেন, ১০ ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়। তারেক রহমান যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরবেন, এমন কথাও বলছেন তাদের কেউ কেউ। কেউ আবার বলছেন, ঘরে অন্তরীণ থাকা খালেদা জিয়াও ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশে উপস্থিত হবেন।
সমাবেশের জায়গা নিয়ে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে সেটাও বড় অদ্ভুত লাগছে। পুলিশ বলছে, তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আর বিএনপি নেতারা বলছেন, তারা তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় ছাড়া আর কোথাও সমাবেশ করবেন না। এই অনড় অবস্থান কেন তার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা বিএনপি মানুষের সামনে উপস্থিত করতে পারেনি।
আরও পড়ুন : ক্ষমতাবানদের পেছনে গড্ডলিকা
একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে, আমি বলবো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশের সুযোগ বিএনপির নেওয়া উচিত। দলের লক্ষ্য সমাবেশ করা, বক্তব্য দেওয়া। যদি তাই হয়, তাহলে যেকোনো সুযোগে সেটা করাই যৌক্তিক।
মানুষ কী এই ‘খেলা হবে’ শব্দকে গ্রহণ করেছে? আমাদের তা মনে হয় না। রাজনীতি সচেতন মানুষ রাজনীতিতে রাজনৈতিক শিক্ষা দেখতে চায়। অথচ আমাদের রাজনীতি মানেই যেন কিছু শব্দের খোঁচায় প্রতিপক্ষ উসকে দেওয়ার উদগ্র বাসনা।
২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারকে চাপে ফেলার মতো কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। দীর্ঘদিন পর আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এক বছর আগে থেকেই বড় ধরনের আন্দোলনে নামতে চাইছে বিএনপি। সেই লক্ষ্যে বিভাগীয় সমাবেশ করছে দল এবং সবশেষ হবে এই ১০ ডিসেম্বরে।
প্রশ্ন হলো আওয়ামী লীগেরই-বা শঙ্কা কেন এবং কোথায়? ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, ১০ ডিসেম্বর বিএনপি সমাবেশের নামে বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন ঢাকায় এনে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে এবং সেখান থেকেই এই ‘খেলা হবে’ কথার ব্যবহার শুরু। এর মধ্যে রাজনৈতিক মাঠে একে অন্যকে মোকাবিলার ইঙ্গিত আছে এবং জনতার ভয় সেখানেই। মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক দাম আর রোজগারহীন পর্যদুস্ত মানুষ রাজনৈতিক সহিংসতা ভয় পায়।
আরও পড়ুন : রাজনীতি কি মরণ খেলা?
মানুষ কী এই ‘খেলা হবে’ শব্দকে গ্রহণ করেছে? আমাদের তা মনে হয় না। রাজনীতি সচেতন মানুষ রাজনীতিতে রাজনৈতিক শিক্ষা দেখতে চায়। অথচ আমাদের রাজনীতি মানেই যেন কিছু শব্দের খোঁচায় প্রতিপক্ষ উসকে দেওয়ার উদগ্র বাসনা।
অবশ্যই রাজনৈতিক নেতারা কবিতার ভাষায় কথা বলবেন না। কিন্তু বর্তমানে যে ভাষার ব্যবহার দেখি সেটা শুনতে ইচ্ছা করে না। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মুখের যে ভাষা আমরা শুনছি এবং দেখছি তা কদর্যতা হার মানায় অনেক সময়।
কুকথার স্রোত যে থামতে চায় না রাজনীতিতে, সেটাই সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক। দায়িত্বশীল জায়গায় যারা আছেন তারা রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি থামাতে চেষ্টা করবেন সেটাই প্রত্যাশা। যেভাবে রাজনীতি থেকে সৎ মানুষ সরে গিয়েছেন অভিমানে এবং ভয়ে; তারা হয়তো আর ফিরবেন না এই ‘খেলা’র মাঠে।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন