ছাত্রলীগ : প্রত্যাশা পূরণে কতটা সক্ষম?
শিক্ষা, শান্তি, প্রগতির পতাকাবাহী সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ হাতে গড়া এই ছাত্র সংগঠনের রয়েছে অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল রাজনৈতিক ইতিহাস। এদেশের প্রতিটি গণআন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নাম।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি সময়ের প্রয়োজনে বাংলা, বাঙালি, স্বাধীনতা ও স্বাধিকার অর্জনের লক্ষে তৎকালীন তরুণ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরণা ও পৃষ্ঠপোষকতায় একঝাঁক স্বাধীনতাপ্রেমী তারুণ্যের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় এশিয়া মহাদেশের ‘বৃহত্তম’ ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
বিজ্ঞাপন
প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে সংগঠনটির পরিবর্তিত নাম হয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
আরও পড়ুন : ছাত্রলীগ নিয়ে এত সমালোচনা কেন?
সংগ্রামী এবং স্বাধীনতার চেতনায় লালিত সংগঠনের প্রতিষ্ঠা পরবর্তী প্রথম প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ছিল বাঙালীর ভাষা আন্দোলন। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠা হয় বাঙালির ভাষার অধিকার।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভ্যানগার্ড হিসেবে নিয়োজিত ছিল ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। যুক্তফ্রন্টের বিজয় সুনিশ্চিত করতে যাদের ছিল অনবদ্য ভূমিকা। শিক্ষার অধিকার আদায়ে ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর রাজপথে রক্ত দিয়েছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ—বঙ্গবন্ধু প্রণীত ঐতিহাসিক ছয় দফা, যার পরিপ্রেক্ষিতে বেগবান হয় আমাদের মহান স্বাধীনতা আন্দোলন; এই ছয় দফা দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, প্রতিটি অলিতে গলিতে ছড়িয়ে দিতে নিরলসভাবে পরিশ্রম করেছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
তৎকালীন শাসক শ্রেণির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দেশপ্রেমের বলে বলিয়ান হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছিল বঙ্গবন্ধুর ভ্যানগার্ড হয়ে। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে বাংলার ছাত্রসমাজ সারাদেশে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলে, যা রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। পদত্যাগে বাধ্য করা হয় পাক শাসক এবং বন্দিদশা থেকে মুক্ত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আরও পড়ুন : ধর্মের রাজনীতি নাকি রাজনীতির ধর্ম
তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ বাংলার ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে সারা বাংলাদেশে পাকিস্তানের অপশাসনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে ছাত্রলীগ ছিল সদা তৎপর।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশে ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং শহীদ হন ছাত্রলীগের বহু নেতাকর্মী।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগের সমাবেশে বলেছিলেন—‘দানবের সঙ্গে লড়াইয়ে যে কোনো পরিণতিকে মাথা পেতে বরণের জন্য আমরা প্রস্তুত। তেইশ বছর রক্ত দিয়ে এসেছি। প্রয়োজনে বুকের রক্তে গঙ্গা বহাইয়া দেব। তবু সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও বাংলার বীর শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করব না।’
বঙ্গবন্ধুর কথাই তার একান্ত অনুগত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সতেরো হাজার নেতা-কর্মী মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের বুকের তাজা রক্তে স্বাধীন করেছিল প্রিয় মাতৃভূমি।
আরও পড়ুন : ছাত্রলীগ : আদর্শিক রাজনীতির ধারক
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারা অব্যাহত থাকে। ঘৃণ্য রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে ৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী সময়ে যখন এদেশের গণতন্ত্র হাটতে শুরু করে উল্টোপথে, তখন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ছিল ঐতিহাসিক ভূমিকা।
সামরিক জান্তা সরকারের জুলুম, নির্যাতন, বুলেটের আঘাতকে উপেক্ষা করে স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলনের মাধ্যমে অবসান ঘটায় দীর্ঘ পনেরো বছরের সামরিক শাসনের।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দেশপ্রেম, মানবপ্রেম এবং দেশের স্বার্থে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারা অব্যাহত আছে আজও। এদেশের ইতিহাসের অন্যতম কালো অধ্যায় ১/১১-এর সময় জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ ছাত্র-শিক্ষক সবার মুক্তি এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ গড়ে তুলেছিল দুর্বার গণআন্দোলন।
প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকে যখনই বাংলাদেশ সামাজিক, রাজনৈতিক, সংস্কৃতির সংকটের মুখোমুখি হয়েছে তখনই আলোর দিশা হয়ে সংকট মোকাবিলা করেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে এখনো অবধি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তৈরি করেছে হাজার হাজার দেশপ্রেমিক নেতা-কর্মী। যাদের অবদানে আজও স্ব-মহিমায় উড়ছে শিক্ষা শান্তি প্রগতির পতাকা।
আরও পড়ুন : সম্প্রীতি ফিরে আসার প্রত্যাশায়
এদেশের স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অবদান অনস্বীকার্য।
দেশ এবং মানবসেবায় নিরলস পরিশ্রমী এই ছাত্র সংগঠন তাই রয়েছে সারাদেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়। ৭৫ পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনায় সকল অপশক্তির ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে সফলতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম এই সংগঠন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার্থীদের হাতে অস্ত্রের বদলে কলম তুলে দেওয়ার কৃতিত্বও ঐতিহাসিক এই ছাত্রসংগঠনের। আমরা দেখেছি করোনা মহামারির সময়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সৃষ্টি করেছে মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সারা বাংলাদেশের প্রতিটি আনাচে কানাচে বাংলাদেশর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পাশে দাঁড়িয়েছে অসহায় মানুষের। খাদ্য সহায়তা, অক্সিজেন সহায়তা, চিকিৎসা সেবাসহ যেকোনো প্রয়োজনে দেশের সংকটকালে সর্বদা মানুষের পাশে ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
কালের বিবর্তনে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম এই সংগঠন এখন সবচেয়ে অবহেলিত। ছাত্রলীগের প্রটোকল নিয়ে এমপি মন্ত্রী হওয়া যায়। যেকোনো প্রোগ্রামে অডিটোরিয়াম বা মাঠ ভরাতে দর্শক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কখনো কখনো লাঠিয়াল হিসেবেও কাজে লাগানো হয়। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করা যায় না। দিনশেষে হারিয়ে যায় ছাত্রলীগের প্রকৃত ত্যাগী কর্মীরা।
আরও পড়ুন : যুবলীগের যে ধরনের রাজনীতি করে
ছাত্রলীগের শরীরে ঘামের গন্ধ থাকে। তবে ছাত্রলীগের রক্তে উন্মাদনা থাকে, দেশপ্রেম থাকে, আপস না করার দুর্বিনীত দুঃসাহস থাকে। বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনা বুকে ও মগজে নিয়ে ঘুমাতে যায় ছাত্রলীগ।
দিনশেষে তাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশেষ বিশেষ আয়োজনে ছাত্রলীগের আমন্ত্রণ মেলে না, সেখানে জায়গা করে নেয় রাজাকার সন্তানরা। ছাত্রলীগের বহু ত্যাগী নেতাকর্মীদের জীবন সংসারে, ঘরে-বাইরে সবকিছু ত্যাগ করতে করতে বাকি আছে শুধু দলটা ত্যাগ করার। সেই সময়ও হয়তো সমাগত। আর তারা সুসময়ে এমনিতেই অভিমানে দূরে থাকে।
দুঃসময়ে বুক পেতে আগলে রাখে দল। আগামীতে হয়তো আগলে রাখার হিসাবটাও বদলে যাবে। কেননা বক্তৃতায় আপনারা যতই বলেন তারা দলের প্রাণ, এগুলো শুধুই আপনাদের বড় বড় বক্তৃতা।
আরও পড়ুন : সম্প্রীতি কোথায়?
জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিগত দিনে রাজপথের নেতৃত্ব দানকারী, জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে অবদান রাখা, বিচক্ষণ নেতৃত্বের কাঁধেই উঠুক ছাত্রলীগের ভার। ছাত্রলীগ প্রসঙ্গে জাতির পিতা বলেছেন—‘আমি দেখতে চাই, ছাত্রলীগের ছেলেরা যেন ওই যে কী কয়, নকল, ওই পরীক্ষা না দিয়া পাস করা, এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলো।’
বঙ্গবন্ধুর সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের দায়িত্ব ছাত্রলীগের। তাই যোগ্য ব্যক্তিদের ছাত্রলীগের নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে ছাত্রলীগ একটি মেধাবী সংগঠনে পরিণত করা এখন সময়ের দাবি।
এন আই আহমেদ সৈকত ।। সাবেক ছাত্রনেতা