মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, জনযুদ্ধের ইতিহাস
ক্ষোভ এবং লোভ মানুষকে ক্ষুদ্র করে। রাজনীতিতে এই দুইয়ের বসবাস শুরু হলে, সত্য চাপা পড়তে থাকে অহরহ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ রাজনৈতিক লড়াই থেকেও বিশাল অর্থ বহন করে। রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভিন্ন দিকে তফাৎ থাকার কারণে সেই বিশালতা থেকে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে গভীরে।
মুক্তিযুদ্ধের অর্থবহ কারণগুলো চাপা পড়ে গেছে ক্ষোভের কাতারে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে যুক্তিযুক্ত উপায়ে লড়াই করার থেকে ওদের মন গড়া অবান্তর মতামতের কঠিন জবাব দেওয়ার জন্য, ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের তুলনা করতে করতে, মুক্তিযুদ্ধ অবহেলিত হয়েছে ক্রমশ।
বিজ্ঞাপন
রক্ত ঋণে পাওয়া স্বাধীনতা ক্ষোভের বিষয় নয়, ক্ষুদ্র নয়, তা ভুলে গিয়েছি আমরা। পঞ্চাশ বছরে সবচেয়ে বেশি বিকৃত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের যে বিষয়গুলো স্বাধীন দেশের মানুষের জানার মাধ্যমে ধারণ করাতে জরুরি ছিল সেগুলোয় তৈরি হয়েছে মনগড়া শূন্যতা, এর কারণ শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতাদর্শের বিভেদ।
আরও পড়ুন : ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত : ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের ইতিহাস
মানুষকে যা জানানো হয়েছে তার বেশিরভাগই গুরুত্বহীন বিষয়, কখনো কখনো নিজস্ব ভাবনায় তৈরি ঘটনা। এসব কারণে প্রজন্মের কাছে জানার বা পড়ার আগ্রহ কমে গেছে।
ইতিহাস বিকৃতি হয়েছে বারবার। জনগণের একটি অংশ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মানে না। আরেকটি অংশ মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ বাণিজ্যিক রূপ দিয়েছে। অত্যন্ত নিষ্প্রাণ এবং নিস্তেজ ব্যাখ্যা উপস্থাপনে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সঠিক ও গ্রহণযোগ্য কথা হৃদয়ে ধারণ করতে বা নিতে চায় না নতুন প্রজন্ম।
ইতিহাস বিকৃতি হয়েছে বারবার। জনগণের একটি অংশ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মানে না। আরেকটি অংশ মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ বাণিজ্যিক রূপ দিয়েছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ভালোবাসা আর আবেগে জড়ানো হলেও তা কখনো কখনো কোনো ব্যক্তির কাছে, দলের কাছে হাস্যকর হয়েছে। ওইসব ব্যক্তি, দলবাজদের ও ঘর সংসার সন্তান আছে। তারা তাদেরটা গুছিয়ে নিচ্ছে, মেরুকরণ হচ্ছে।
বড়রা ছোট থেকে এইসব জানানোর দায়িত্ব নেয় না। পরিবার, স্কুল সব জায়গাই এই দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়ে রয়েছে অবহেলা। মুক্তিযুদ্ধ সবকিছুর ঊর্ধ্বে—এই বিশালতা আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি, শুধুমাত্র ক্ষোভ আর লোভের কারণে।
রাজনৈতিক বিতর্ক বা প্রভাবের বলি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। রাজনীতির বলয়ে আটকে যাওয়া মানুষের কাছে সবচেয়ে সহজ অবলম্বন—সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, তাতে এসেছে বন্ধ্যাত্ব। এখন নাটক, টিভি, সিনেমা, যাত্রা, পথনাটক, কবিগান চর্চায় মুক্তিযুদ্ধ উঠে আসে না।
আরও পড়ুন : ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি : আগামীর দৃঢ়তা
চলচ্চিত্র তৈরি হয় না কোনো মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব বা ইতিহাস নিয়ে। পাঠ্যপুস্তকেও আমাদের বীরদের নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো লেখা নেই। জানানোর সুযোগ রাখা হয়নি তাদের কাউকে। গল্প, কবিতা বা উপন্যাসে উঠে আসেনি তাদের বীরত্বগাঁথা।
দেশে ক্ষোভের রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ কলুষিত করেছে, জাতি দ্বিধাবিভক্ত করে দিয়েছে। যে দেশের বিরাট একটা অংশ শহীদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে, জাতির পিতা অস্বীকার করে, মুক্তিযুদ্ধ আসলে পাকিস্তান ভেঙে টুকরো করার ষড়যন্ত্র এই তত্ত্বেও বিশ্বাস করে, সেই দেশের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ ধারণ করবে কোন গভীর ভাবনা থেকে?
সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, যাদের পরিবারের কেউ মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যায়নি বা অংশগ্রহণ করেনি তারা একেবারেই ভুলে গেছে সেই সময়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করার হীনমন্যতা থেকে তারা খুব সচেতনভাবেই বিষয়কে এড়িয়ে চলেন।
মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে প্রজন্মের অনীহা কেন? দোষটা অগ্রজদের, মুক্তিযোদ্ধাদের, স্বাধীনতা পরবর্তী বুদ্ধিজীবীদের।
মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে প্রজন্মের অনীহা কেন? দোষটা অগ্রজদের, মুক্তিযোদ্ধাদের, স্বাধীনতা পরবর্তী বুদ্ধিজীবীদের। আমাদের জন্মযুদ্ধের ইতিহাস, বীরত্বের শোকগাঁথা প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরার কাজটা কখনোই তারা সঠিক সময়ে করেননি।
নৈতিক মূল্যবোধের অভাব এবং ক্ষোভ/লোভ তাদের মাঝেও বিচরণ করেছে বিধায়, তাদের কাছ থেকে জানানোর আগ্রহও তৈরি করা যায়নি। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধারাও রাজনৈতিক দলীয়করণের অন্তর্ভুক্ত হয়ে, নিজেদের বীরত্ব ইতিহাসে লেখার চাইতে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। তাই যে দল যেভাবে মুক্তিযুদ্ধকে উপস্থাপন করতে বলেছে, সেদিকেই গেছেন তারা।
এই অহমবোধের বিষয়ে নিজস্বীকরণ করার সুতীক্ষ্ণ ব্যাপার আছে। মুক্তিযুদ্ধ কী বা কেন হয়েছিল তা পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষাক্ষেত্র থেকেই আলোচনায় আসার কথা। নিজ অস্তিত্ব, পরিচয়, জন্মসূত্রের শেকড়ের টানে পক্ষ বা বিপক্ষ নেই।
আরও পড়ুন : বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন
এখন জাতীয়তা আর জাতীয়তাবাদের নানান অপব্যাখ্যার খপ্পরে পড়ে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত হয়েছে বাংলাদেশ তৈরির ইতিহাস। নিজের দায় এড়াতে আরেকজনের দিকে আঙুল তোলার অভ্যাস আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে যোজন যোজন দূরে। এর ফলাফল ভোগ করতেই হবে।
মানুষ সেটাই ধারণ করে যার সাথে তার অস্তিত্বের বাঁধন আবিষ্কার করতে পারে। ধারণের আকারে তৈরি হয়েছে শূন্যতা, অসত্যতা আর উন্নাসিকতা। আমরা ভুলেই গেছি যে মুক্তিযুদ্ধ কল্পকথা নয়।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনগণের হৃদয়ের লড়াই, আমাদের স্বাধীন ভূমির লড়াই, রক্তমাখা ঋণের লড়াই, লাল সবুজের পতাকার লড়াই।
শাওন মাহমুদ ।। শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা