কৈশোরবান্ধব যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা কেন জরুরি
মাত্র ১৫ বছর বয়সে যখন রাবেয়ার বিয়ে হয়েছিল, তখনও ঋতুকাল সম্পর্কে সে ঠিকমতো জানত না। জানত না এই সময়টায় তার কী করা দরকার, স্বামী সহবাস করা যাবে কি না, তাকে কতটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। শুধু ঋতুকাল কেন, তার দেহের আরও অন্যান্য পরিবর্তন নিয়েও রাবেয়ার কোনো ধারণা ছিল না। এতসব অজানা বিষয় ও ভয় নিয়ে সে যখন স্বামীর সংসারে গিয়েছিল, তখনো কেউ তাকে কিছু জানায়নি। অসহায় রাবেয়ার একমাত্র আশ্রয় ছিল ঘরে বসে চুপিসারে কান্নাকাটি করা।
একই অবস্থা হয়েছিল ১৪ বছর বয়সী নাসিরের। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নাসির নিজেকেই যখন চিনতে পারত না, দেহের নানা পরিবর্তন নিয়ে তার মনেই অনেক প্রশ্ন জমা হয়েছিল, তখন সে উত্তর পায়নি সেইসব প্রশ্নের। এরপর নাসির ফুটপাত থেকে একটা যৌন বিষয়ক বই কিনে তার আগ্রহ মেটানোর চেষ্টা করেছিল এবং বলাই বাহুল্য যার ফল ভালো হয়নি।
বিজ্ঞাপন
একইভাবে ময়না যখন ১২ বছর বয়সে তার পরিধেয় বস্ত্রে রক্তের ফোঁটা দেখেছিল, তখন সে ভয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল। ভেবেছিল তার ভয়াবহ কোনো অসুখ করেছে। দৌঁড়ে বাবার কাছে গিয়ে এই ভয়ের কথা বলেছিল। রাবেয়া, নাসির এবং ময়না কোনো কাল্পনিক চরিত্র নয়, তারা আমাদের বন্ধু, ভাই-বোন কিংবা আমরাই। যারা কোনোদিনও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং যৌন জীবন নিয়ে কোনো তথ্য পায়নি তাদের স্কুল, পরিবার বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে। এরকম তথ্য না পাওয়া শিশু-কিশোরের সংখ্যা দেশে অনেক।
বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বয়সে থাকা শিশুরা এমন একটা সমাজ বা গোষ্ঠীর মধ্যে বাস করে, যারা সনাতনি ধ্যানধারণা বিশ্বাস করে ও চর্চা করে। এরা কোনোভাবেই কিশোরদের সঙ্গে যৌন জীবন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো আলোচনাকে গ্রহণ করে না।
অথচ সত্য হলো, একজন শিশু যখন তার বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছে, তখন তার ভেতরে মনো-দৈহিক, সামাজিক এবং আবেগজনিত অনেক প্রশ্ন দেখা দেয় বা সমস্যা তৈরি হয়। এ সময় নিজের দেহ ও মনের এমন সব পরিবর্তন সে লক্ষ করে, যা সম্পর্কে সে জানে না। এই বিষয়গুলো নিয়ে কেউ কখনো তার সঙ্গে আলোচনাও করেনি। তার কোনো ধারণাই নেই জীবনের এই অদ্ভুত পরিবর্তন নিয়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ১০-১৯ বছর পর্যন্ত কৈশোরকাল এবং এটাই বয়ঃসন্ধিকাল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৮ সালের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ১৬ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ২ কোটি ৭৭ লাখ কিশোর-কিশোরী। এ সময়টাতে মানুষের দেহ, মন ও বুদ্ধিবৃত্তিক যে পরিবর্তন ঘটে, তা একেবারেই অচেনা তাদের কাছে। এসব সমস্যা নিয়ে কারো সঙ্গে শেয়ার করা যায় না। অনেক প্রশ্ন তৈরি হয় শরীর ও মন নিয়ে, কিন্তু উত্তর পাওয়া যায় না।
আইসিডিডিআরবি’র ২০০৫ সালের তথ্যানুযায়ী, বয়ঃসন্ধিকালের শিশুরা বাবা-মা অথবা তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে নিরাপদ যৌন জীবন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে তেমন কোনো কথাই বলে না। অন্যদিকে অভিভাবকরাও বিষয়গুলো সম্পর্কে তাদের সচেতন করেন না।
সেই গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এই ঝুঁকিপূর্ণ বয়সে থাকা শিশুরা এমন একটা সমাজ বা গোষ্ঠীর মধ্যে বাস করে, যারা সনাতনি ধ্যানধারণা বিশ্বাস করে ও চর্চা করে। এরা কোনোভাবেই কিশোরদের সঙ্গে যৌন জীবন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো আলোচনাকে গ্রহণ করে না। বরং এই বিষয়ক আলোচনাকে ঘরে-বাইরে, এলাকায়, স্কুলে এখনো ভয়াবহভাবে ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়।
প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কতগুলো জরুরি বিষয় জানা দরকার। যেমন— প্রজনন স্বাস্থ্যতত্ত্ব, যৌনতা, পরিবার পরিকল্পনা এবং যৌনবাহিত রোগ। এসব নিয়ে আলোচনা করাটা বাংলাদেশে প্রায় সবধরনের পরিবারে গর্হিত কাজ এবং মনে করা হয় এটা একটা সামাজিক ট্যাবু।
যখন কোনো শিশু-কিশোরের মনে তার ব্যক্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়, তখন সে তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে নানাভাবে। পাড়া-প্রতিবেশী বা বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বা ইন্টারনেট বা ফেসবুক থেকে পাওয়া তথ্য সবসময় যথেষ্ট হয় না। এখান থেকে পাওয়া তথ্য মাঝেমধ্যে ভুলও হয়। সেক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছানো শিশুরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুল বা অসম্পূর্ণ তথ্য পেয়ে থাকে।
এ বয়সীরা খুব আবেগনির্ভর হয়, তারা ঝুঁকি নিতে ভালোবাসে। আবার অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকে বলে সবসময় সিদ্ধান্তও নিতে পারে না বা সাহস পায় না। বয়ঃসন্ধিকালের প্রেম, ভালোবাসা, দৈহিক সম্পর্ক, বৈবাহিক জীবন ও দাম্পত্য সম্পর্ক, সন্তান ধারণ এই বয়সীদের খুবই শঙ্কার মধ্যে ফেলে দেয়। এর জের ধরে অনেকেই আত্মহত্যা করে, হতাশায় ভোগে, মনোবৈকল্যের রোগী হয়।
একজন শিশু যখন বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছে, তখন সেই শিশুর দিকে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। ছেলেমেয়েরা যদি এই সময়ে বয়ঃসন্ধিকালের জন্য সংবেদনশীল নীতিমালা ও সুবিধাদি পায়, তাহলে তারা নিজেদের জীবন ও যৌবনের ওপর অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ আনতে পারবে। নিজেদের মনোদৈহিক পরিবর্তন নিয়ে মনে কোনো প্রশ্ন বা ভুল ধারণা থাকবে না। তারা তাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এবং নিজের জীবনের জন্য ক্ষতিকর কোনো পদক্ষেপ নেবে না।
প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কতগুলো জরুরি বিষয় জানা দরকার। যেমন— প্রজনন স্বাস্থ্যতত্ত্ব, যৌনতা, পরিবার পরিকল্পনা এবং যৌনবাহিত রোগ। এসব নিয়ে আলোচনা করাটা বাংলাদেশে প্রায় সবধরনের পরিবারে গর্হিত কাজ এবং মনে করা হয় এটা একটা সামাজিক ট্যাবু।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, শত প্রতিরোধ সত্ত্বেও দেশে বাল্যবিয়ে রোধ করা যাচ্ছে না। ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে শতকরা ৫৯টি মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছরের আগেই। শতকরা ২২ জনের বিয়ে হয় ১৫ বছরের আগে। বাল্যবিয়ে ঘটার দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ দেশ। সেখানে মেয়ে শিশুরা প্রজনন স্বাস্থ্য ও যৌন জীবন সম্পর্কে কোনো ধারণা না নিয়েই বয়স্ক স্বামীর সহবাসের সঙ্গী হতে বাধ্য হয়।
জাতীয় কৈশোর স্বাস্থ্য কৌশলপত্র, ২০১৭-২০৩০-তে চারটি কৌশলগত নির্দেশনা রয়েছে যেমন— কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য, কৈশোরকালীন পুষ্টি, কিশোর-কিশোরীদের মানসিক সমস্যা ও মাদকাসক্তি, কৈশোরকালে সহিংসতা ও নির্যাতনের দিকে দৃষ্টি প্রদান। বাংলাদেশ জনসংখ্যা নীতি ২০১২-তে কিশোর-কিশোরীদের পরিবার পরিকল্পনা, প্রজনন স্বাস্থ্য, প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ ও এইচআইভি, পুষ্টি সম্পর্কিত সচেতনতা, তথ্য প্রদান, কাউন্সিলিং জোরদারকরণে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অপারেশন প্ল্যান ২০১৭-২০২২-তে কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা উন্নতকরণের কথা বলা হয়েছে।
তবে কাগজে-কলমে কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবার কথা যতটা বলা হচ্ছে, বাস্তবে এর প্রয়োগ তেমনটা নয়। সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে বাবা-মা, অভিভাবক, শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা, ধর্মীয় নেতা, সামাজিক মতমোড়লদের আমরা এই ইস্যুটি নিয়ে তেমনভাবে সচেতন করতে পারছি না। ফলে সংকট আরও বড় হচ্ছে।
শাহানা হুদা রঞ্জনা ।। সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন