অর্থনৈতিক মন্দার শিকড় কোথায়?
নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টার্ন স্কুল অব বিজনেস (NYU Stern School of Business)-এর অধ্যাপক নুরিয়েল রুবিনি (Nouriel Roubini)। ম্যাক্রো অ্যাসোসিয়েটস নামে তার একটি সংস্থাও রয়েছে। বলা হয়, অর্থনীতি নিয়ে ভবিষ্যৎ বাণী দিতে তার জুড়ি নেই।
সেই রুবিনি এবার বললেন, ২০০৮ সালের আর্থিক বিপর্যয়ের চেয়ে আরও ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হতে চলেছে গোটা বিশ্ব এবং তা আঘাত করতে পারে আমেরিকা ও সারা বিশ্ব। তার দাবি, এই মন্দা স্থায়ী হতে পারে ২০২৩ সাল পর্যন্ত।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে রুবিনি বলেন, সাধারণ মন্দার ক্ষেত্রে পুঁজিবাজার ৩০ শতাংশ ধসে যায়। এইবার পুঁজিবাজার পড়তে পারে প্রায় ৪০ শতাংশ ধসে। এই মন্দা দেখা দিলে বহু প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, কর্পোরেট সংস্থার মৃত্যু ঘটবে। তাদের নগ্নরূপ গোটা বিশ্ব দেখবে। এরকম একটা আশঙ্কার কথা অনেকদিন ধরেই উচ্চারিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন : মধ্যবিত্তের নতুন আতঙ্ক বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি
আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দেশবাসীকে সতর্ক করেছেন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের মানুষকে তিনি প্রতি ইঞ্চি জমিতে শস্য আবাদের পরামর্শ দিয়েছেন যাতে করে উৎপাদন বাড়িয়ে মানুষ সঞ্চয় করতে পারে।
কোভিড-১৯ মহামারির প্রকোপ শেষ হতে না হতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ডামাডোল আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিতিশীলতা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। কারণ, বিশ্বের অন্যতম খাদ্য জোগানদাতা রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় সরবরাহ ব্যবস্থায় মারাত্মক বিঘ্ন ঘটেছে।
বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম তো বেড়েছেই। বাংলাদেশের চিত্রও বেশ নাজুক। যদিও বলা হচ্ছে শিগগির সংকট কেটে যাবে, তবুও ভরসা নেই যে, স্বল্পমেয়াদে উন্নতির সম্ভাবনা আছে।
জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, বাণিজ্য-ভারসাম্য নেতিবাচক দিকে ঢলেছে, সরকারের ব্যয়ের সাথে আয়ের বিরাট ব্যবধান অব্যাহত আছে, টাকার মূল্যমান কমেছে...
জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, বাণিজ্য-ভারসাম্য নেতিবাচক দিকে ঢলেছে, সরকারের ব্যয়ের সাথে আয়ের বিরাট ব্যবধান অব্যাহত আছে, টাকার মূল্যমান কমেছে, বাজারে ডলারের তারল্য সুবিধাজনক নয়, উৎপাদনশীল কারাখানা গ্যাস, বিদ্যুৎ সমস্যার পাশাপাশি কাঁচামাল আমদানিতে এলসি সংকটে ভুগছে, মানুষ মূল্যবৃদ্ধির আঁচে পুড়ছে।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই বিলাসদ্রব্য আমদানি সীমিত করেছে ও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি আমদানি ব্যয় কমিয়ে এনেছে। কিন্তু এগুলোর বড় কোনো ইতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে দেখা যায়নি।
আরও পড়ুন : মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা
সবকিছুরই কারণ রয়েছে। কিছু কারণের শিকড় বিশ্ব অর্থনীতির মধ্যে প্রোথিত। কিন্তু এই সংকটের কারণ শুধু মাত্র সেখানে খুঁজলে হবে না। আমাদের নিজেদের দিকেও তাকাতে হবে। অর্থনীতিতে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী মন্দা অবশ্যম্ভাবী ছিল। কিন্তু তার মোকাবিলায় যে পন্থা নেওয়া উচিত ছিল সরকারের, সরকার সেভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
প্রথমেই যেটা বলা দরকার তা হলো আমরা দীর্ঘ সময় কোনো প্রকার অর্থনৈতিক নেতৃত্ব দেখতে পাচ্ছি না। অর্থমন্ত্রীর কাছে থেকে নেতৃত্ব আশা করছি অনেকদিন ধরেই, কিন্তু সেটা দৃশ্যমান নয়।
সরকারের দিক থেকে বলা হচ্ছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের জন্য খাদ্য আর জ্বালানি দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে ডলার সংকট বেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র উল্লেখ করে গণমাধ্যম বলছে, দেশে ২০২১-২২ সালে খাদ্যদ্রব্য আমদানি কমেছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ এবং জ্বালানি আমদানি কমেছে ১১ শতাংশ; বরং প্রধান ভূমিকা রেখেছে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, লোহাসহ বিভিন্ন ধরনের ধাতু, সার, ফার্মাসিউটিক্যালসসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্পপণ্যের রেকর্ড আমদানিতে।
আরও পড়ুন : বিদ্যুৎ সংকট : সমাধান হবে কবে?
এসব খাতে আমদানি বেড়েছে ৫৮ শতাংশের মতো, কিন্তু রপ্তানি বেড়েছে ৩৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। যার শুরু যুদ্ধের ছয় মাস আগে থেকেই (বণিক বার্তা, ৩ অক্টোবর ২০২২)। তাহলে বোঝা যাচ্ছে সংকট যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই শুরু হয়েছিল।
ব্যাংক এদিকে এলসি দিচ্ছে না। অথচ কত মানুষ কত অকাজে বাইরে যাচ্ছে। এমনকি ২০২৩ সালের সব বিজনেস ক্লাসের বিমান টিকিট নাকি বুক হয়ে আছে। এরা কারা? এদের দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার এখনই। আমাদের বাঁচার বড় উপায় রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয় এবং দেশের মানুষের সঞ্চয় প্রবণতা। কিন্তু রেমিট্যান্স ২০২১ সালের এই সময়ের থেকে কম আসছে।
এখন বলা হচ্ছে সৌর বিদ্যুতে যাবে। দশ বছরে সেদিকে কেন গেল না? কেন গ্যাস কূপ খননের কাজ না করে এলএনজি আমদানিতে এত উৎসাহ ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর নেই।
গার্মেন্টসের ওয়ার্ক অর্ডার কমেছে ১০ শতাংশ এবং রপ্তানি আয় ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের তুলনায় কমেছে ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। মানুষ সঞ্চয় করবে কী, উল্টো সঞ্চয় ভেঙে জীবন চালাচ্ছে মূল্যস্ফীতির প্রভাবে।
বিদ্যুৎ–সংকটের কারণে ফ্যাক্টরিগুলো এখন ৪০-৬০ শতাংশ ক্ষমতায় কাজ করতে পারছে। আমাদের রপ্তানির সব টাকা ফেরত আসছে না, সেটা নিয়েও কোনো বড় ভাবনা নেই কোথাও। যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাফল্য নিয়ে এত উচ্ছ্বাস, এত উন্মাদনা, এত উদযাপন সেই বিদ্যুৎ খাতের অবস্থা এখন এলোমেলো।
আরও পড়ুন : বৈশ্বিক মন্দা ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি
কেন তথাকথিত ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বসিয়ে বসিয়ে বিদ্যুৎ কোম্পানিকে টাকা দিতে গিয়ে জনগণের পকেটে হাত দিতে হচ্ছে, আপাতত প্রয়োজন বা চাহিদা না থাকলেও কেন কুইক রেন্টালের মেয়াদ বাড়ানো হলো এসবের কোনো স্বচ্ছ ব্যাখ্যা নেই কোথাও।
এখন বলা হচ্ছে সৌর বিদ্যুতে যাবে। দশ বছরে সেদিকে কেন গেল না? কেন গ্যাস কূপ খননের কাজ না করে এলএনজি আমদানিতে এত উৎসাহ ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর নেই। দাম আরেক দফা বাড়ানো হলো এই সপ্তাহেই, অথচ বিদ্যুৎ খাতের অপচয় আর দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে জনগণের ওপর এর বোঝা চাপানোর প্রয়োজন ছিল না।
আরও পড়ুন : প্রান্তিক আয়ের মানুষের আর্তনাদ কেউ কি শুনছে?
সংকট মোকাবিলা করতে প্রথম যেটা করণীয়, ঠিক তথ্য দিতে হবে। অর্থমন্ত্রীকে সামনে এসে কথা বলতে হবে। পাচার করা টাকা যেকোনো উপায়ে ফেরত আনতে হবে। সরকারি খাতে বাড়তি খরচ কোথায় কোথায় হচ্ছে তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। সব থেকে বড় প্রয়োজন বিভিন্ন শিল্প বিশেষজ্ঞ আর অ্যাকাডেমিশিয়ান দিয়ে কমিটি গঠন করে নিজেদের রক্ষা করার প্রস্তুতি।
জ্বালানি তেলের দাম মন্দায় কমে আসলে বাংলাদেশের বাজারে তার সমন্বয় বুদ্ধিমত্তার সাথে করতে পারলে সাধারণ মানুষ কিছুটা স্বস্তি পাবে। কৃষি আর রেমিট্যান্সে প্রণোদনাসহ আনুষঙ্গিক পদক্ষেপ ঠিক মতো নিতে পারলে মন্দার চাপ মোকাবিলা করা কিছুটা সহজ বলে বলে মনে করছি।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন