অর্থনীতির বিশ্বকাপ!
তখন স্কুলে পড়তাম। কী এক ওষুধ খেয়েছিলাম, নাম মনে পড়ছে না। খাওয়ানোর সময় বলা হয়েছিল, নাও মজা খাও। মুখে নিয়ে মজা পেলাম ঠিক, কিন্তু চিনির প্রলেপ সরে যেতেই বিস্বাদ তিতা।
৩২ দল নিয়ে কাতারে বসা ফুটবল আসর আমার তেমন চিনির প্রলেপ দেওয়াই মনে হচ্ছে। কাতার বিশ্বকাপ আয়োজন দূরে থাক, চূড়ান্ত পর্বে খেলার মুরোদ পেল কোন উপায়ে? টাকা দিয়ে ফিফাকে কিনে নিয়েছিল কাতার।
বিজ্ঞাপন
আরব বিশ্বের সবচেয়ে ধনী এই একরত্তির দেশটি মুদ্রা ছুঁড়ে দিয়ে শুধু বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত করেনি, হয়েছে এককভাবে আয়োজক দেশ। অন্য কোনো আরব দেশকে এই অহং-এর সঙ্গী করেনি।
আরও পড়ুন : ফুটবল : বাঙালির প্রেম, বাঙালির জ্বর!
কাতার ১৮ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করে আগের সব বিশ্বকাপের খরচের রেকর্ড ভেঙে দিল, বিশ্ব অর্থনীতির এই মন্দাকালে। বিশ্বকাপ আয়োজনে সড়ক যোগাযোগ, বিমানবন্দর ও স্টেডিয়াম নির্মাণে তাদের মোটা টাকা খরচ করতে হয়েছে।
দেশটি যে আশা করেছিল ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ লাখের মতো ফুটবল ভক্ত পর্যটক সফর করবেন, তাদের সেই লক্ষ্য পূরণ হবে কি না এবং হলেও সেখান থেকে বিশ্বকাপের লগ্নি উঠে আসবে, তাও আমি মনে করি না।
কাতারের এই বিনিয়োগ মূলত আরব বিশ্বসহ গোটা গোলকের মাঝে আধিপত্য এবং আভিজাত্যের প্রদর্শন...
কাতারের এই বিনিয়োগ মূলত আরব বিশ্বসহ গোটা গোলকের মাঝে আধিপত্য এবং আভিজাত্যের প্রদর্শন। তবে ব্যয়ের কথা যেহেতু বলা হলো, সেহেতু আয়োজক দেশের লগ্নি উঠে আসার একটা ধারণাও পাওয়া যাচ্ছে।
বলা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি, তার প্রভাব পড়েছে টিকেটের ওপরও। ২০১৮ সালের রাশিয়ার বিশ্বকাপের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি দিয়ে গ্যালারিতে যাওয়ার সুযোগ মিলছে। ফাইনালের টিকেটের সর্বনিম্ন দাম পাউন্ডের হিসাবে ৬৮৪, সর্বোচ্চ ৫ হাজার পাউন্ড। অন্যান্য খেলার টিকিটের গড় মূল্য ২৮৬ পাউন্ড।
আরও পড়ুন : ফুটবল যে কারণে আগাচ্ছে না
বিশ বছরের মধ্যে ফুটবল ভক্তরা এবার সবচেয়ে বেশি দরে টিকেট কিনেছেন। আয়োজকরা টিকেট বিক্রি করে আয় করবেন, ২০ বিলিয়ন ডলার। আয় আছে ২ লাখ ৪০ হাজার হসপিটালিটি প্যাকেজ থেকেও।
ফুটবল-ক্রিকেটের বড় কোনো আসর বসলেই আমরা বলি, জ্বরে কাঁপছে বিশ্ব বা দেশ। জ্বরে কাতর ভক্তরা তখন আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। তাদের ইচ্ছে ও কাজগুলো পরিচালিত হয় আবেগে। তাইতো জমি বিক্রি করে কেউ প্রিয় দলের দীর্ঘ পতাকা তৈরি করে ফেলেন।
পুরো বাড়ি পছন্দের দলের পতাকা দিয়ে ঘিরে ফেলছেন বা রঙ করছেন। পরিবারের সকলের জন্য, নিজের জন্যে একাধিক জার্সি কেনা হচ্ছে। বাড়ির ছাদে বারান্দায়, অফিস ঘরে, গাড়িতে উড়ছে পতাকা।
আরও পড়ুন : সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ : পুরুষতন্ত্রকেও হারাতে হয়েছে নারী ফুটবলারদের
শুধু জার্সি, পতাকা কিনেই আবেগ শেষ হচ্ছে না। খেলা দেখতে বসে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি পানীয় খেয়ে নেওয়া, রাত জেগে খেলা দেখার আয়োজনের খাবারদাবার, বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। রেস্টুরেন্ট বা বারে বসে খেলা দেখার বাড়তি বিল, যোগ হচ্ছে অর্থনীতির চক্রতেই।
বাংলাদেশ অর্থনীতির মন্দাকালের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে এই মুহূর্তে। ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়ছে জনজীবন থেকে শুরু করে আমদানি, রপ্তানিখাতে।
রাষ্ট্র নিজেও ব্যয় সংকোচন নীতিতে আছে। কিন্তু তাতেও কি বাঙালির কাঁপন কমলো? বাজারের থলেতে শিম, আলু, ডিম বা মাংস না উঠলেও, পতাকা উড়ছে ঠিক...
রাষ্ট্র নিজেও ব্যয় সংকোচন নীতিতে আছে। কিন্তু তাতেও কি বাঙালির কাঁপন কমলো? বাজারের থলেতে শিম, আলু, ডিম বা মাংস না উঠলেও, পতাকা উড়ছে ঠিক। জার্সিটাও ঝকঝকে।
অর্থনীতির ভাষায় এই জ্বরের আবেগকে ‘অ্যানিমেল স্পিরিট’ বলা হয়। এই অ্যানিমেল স্পিরিটে আগের আয়োজক ও জয়ী দেশগুলোর তাৎক্ষণিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। পরের বছর আবার প্রবৃদ্ধির চাকা শ্লথ ও স্থবিরও হয়।
আরও পড়ুন : নারীদের জয়, ফুটবলের কি?
এবারের বিশ্ব অর্থনীতি কোভিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তাপ উত্তাপে অসুখে আছে। এই অসুখের মাঝে ৩২ দেশকে ঘিরে যে উন্মাদনা অর্থনীতির, তাকে আপাতত চিনির প্রলেপ বলতে পারি।
এই প্রলেপ কত গাঢ় এবং আদৌ আয়োজক দেশ এবং তাদের সহযোগী আরব দেশ এবং বিশ্ব অর্থনীতির তেতো ভাবটা মুছে দিতে পারে কতটা, সেটা নির্ভর করছে বিশ্বকাপ শেষে তারল্যের চঞ্চলতার উপর।
তাই আপাতত অঞ্চলে বন্দি তারল্য আবেগে কতটা চঞ্চল হয়ে উঠে, ফুটবলের পাশাপাশি, সেই চঞ্চলতার দর্শক হয়ে থাকা।
তুষার আবদুল্লাহ ।। গণমাধ্যমকর্মী