প্রায় ১০ মাস পর জামিন পেলেন কার্টুনিস্ট কিশোর। খবরটি হতে পারতো স্বস্তির। কিন্তু এই জামিনে স্বস্তির চেয়ে বেদনা বেশি। অনেকেই বলছেন, ‘কারাগারে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর কারণেই শেষ পর্যন্ত কিশোর জামিন পেলেন।’ নিজের জীবন দিয়ে সহবন্দির জামিন নিশ্চিত করে গেলেন। হাইকোর্ট কিশোরের জামিন দেওয়ার সময় মুশতাকের মৃত্যুর বিষয়টি মাথায় রেখেছেন, এমনটি আমি মনে করি না। তারপরও এমন সন্দেহের কারণ হলো, গত বছরের মে মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হওয়ার পর মুশতাক এবং কিশোরের জামিনের আবেদন বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। সে কারণেই মুশতাককে কারাগারে জীবন দিতে হয়েছে। আমরা কিশোর এবং মুশতাকের জামিন না পাওয়া নিয়েই বেশি কথা বলছি বটে। কিন্তু তাদের গ্রেফতারটাই ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। স্রেফ কথা বলার অপরাধে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল।

পুলিশের তদন্তেও তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অপরাধ পাওয়া যায়নি। নিছক ষড়যন্ত্র আর গুজব ছড়ানোর দায়ে তাদেরকে মাসের পর মাস কারাগারে থাকতে হয়েছে। তাই দাবি তুলতে হবে, মামলাটি প্রত্যাহারের। শুধু এই মামলাই নয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার করে মতপ্রকাশের পথ রুদ্ধ করতে যত মামলা হয়েছে, সবই বাতিল করতে হবে।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে অবশ্যই দায়িত্বশীলতার সম্পর্ক থাকতে হবে। মূলধারার গণমাধ্যম তবু কিছু নিয়ম-নীতি মেনে চলে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেন যা ইচ্ছা তাই বলার অবাধ ক্ষেত্র।

কিশোর, মুশতাক, দিদার আর মিনহাজকে গ্রেফতার করা হয়েছিল বহুল সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। এই আইনটির মূল লক্ষ্য ডিজিটাল ক্ষেত্রে মানুষের বিশেষ করে নারীদের হয়রানি বন্ধ করা। কিন্তু আইনটির অপব্যবহার বেশি হয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করতে। আইনটি প্রণয়নের সময়ই সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন এবং সুশীল সমাজ প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু সরকার কারো কথাই আমলে নেয়নি।

মানুষকে রক্ষা করার জন্য প্রণীত আইনটিই ব্যবহৃত হচ্ছে দমন করার অস্ত্র হিসেবে। আরও অনেকের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আমিও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি করছি। তাহলে ডিজিটাল জগতে মানুষের কোনো নিরাপত্তা থাকবে না? ফেসবুকে যা ইচ্ছা তাই লেখা যাবে? অনেকে যা ইচ্ছা তাই লেখার স্বাধীনতা চাইছেন বটে। কিন্তু আমি সবসময় বিশ্বাস করি, যা ইচ্ছা তাই বলা বা লিখতে পারা মানেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নয়। স্বাধীনতার সঙ্গে অবশ্যই দায়িত্বশীলতার সম্পর্ক থাকতে হবে। মূলধারার গণমাধ্যম তবু কিছু নিয়ম-নীতি মেনে চলে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেন যা ইচ্ছা তাই বলার অবাধ ক্ষেত্র। ‘ভিডিও ছাইড়া দিমু’ এই ভয় দেখিয়ে কত দুর্বৃত্ত কত নারীর সর্বনাশ করছে, কত নারী আত্মহত্যা করছে; তার সঠিক হিসাবটা আমরা কখনো জানতেও পারছি না। তাই ডিজিটাল জগতের হয়রানি থেকে মানুষকে বাঁচাতে একটি আইন আমি অবশ্যই চাই। তবে বিদ্যমান আইনের পক্ষে সেটি করা আর সম্ভব নয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি এতটাই সমালোচিত, বারবার অপব্যবহারে এটি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। তাই এটি বাতিল করে একটি নতুন আইন করা যেতে পারে। যে আইন দুর্বৃত্তদের রোধ করবে, আর মানুষের কথা বলার অধিকারকে সমুন্নত রাখবে।

গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। আমি সবসময় মতপ্রকাশের স্বচ্ছ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। আমি জানি, স্বাধীনভাবে নিজের পছন্দ-অপছন্দ প্রকাশ করতে পারাটা মানুষের অন্তর্গত চাহিদা। মানুষ একবেলা না খেয়ে থাকবে, কিন্তু তাও গলা খুলে কথা বলতে চাইবে।

দেশে এত উন্নয়নের পরও মানুষ অসন্তুষ্ট কেন? কারণ মানুষ মন খুলে কথা বলতে পারছে না। সবসময় ঘাড়ের ওপর অপেক্ষা করে অদৃশ্য আততায়ী বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। কিন্তু তারপরও পরিস্থিতি একেবারেই রসাতলে গেছে, তেমনটিও আমি মনে করি না। আগে মতপ্রকাশের এত মাধ্যম ছিল না। এখন কিছু হলেই গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদের ঢেউ ওঠে, এই সুযোগই তো আগে ছিল না। আমরা আসলে গলা খুলে, চিৎকার করে; সব ন্যায্য কথা বলতে চাই। সবসময় পারি না। চারদিকে একটা ভয়ের আবহ।

আমরা সবসময় মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য চিৎকার করি। কিন্তু ভিন্নমতকে সহ্য করি না। ভিন্নমতের ব্যাপারে সরকারের যেমন, আমাদেরও সত্যিকার অর্থে জিরো টলারেন্স। ভিন্নমত মানেই আমাদের কাছে অপরাধ। আমরা শুধু সহমত সহ্য করি, ভিন্নমত নয়। ভিন্নমতের জন্য জীবন দেওয়া তো দূরের কথা, সুযোগ থাকলে ভিন্নমতের জীবন নিতে চাই আমরা।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রমাণ হিসেবে সরকার ৪২টি টিভির লাইসেন্স দেওয়া, ৩০টি টিভি অনএয়ারে থাকা, অসংখ্য পত্রিকা-অনলাইন-এফএম রেডিও’র উদাহরণ দেন। দাবিটি পুরোপুরি মিথ্যা নয়। দেশে ৩০টি টেলিভিশনে প্রতিদিন টক শো’তে বিএনপি নেতারা বা বিএনপি সমর্থিত পেশাজীবীরা আসেন; সরাসরি কথা বলেন, সরকারের সমালোচনা করেন। আমি গণমাধ্যমের সংখ্যা দিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে মাপতে চাই না। কতটুকু বলা যাবে, কতটুকু যাবে না; এই মাপকাঠি নির্ধারণই বড় সমস্যা।

মাপকাঠি কিন্তু সংবিধানে ঠিক করে দেওয়া আছে। সমস্যা হলো, আমরা সংবিধান মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নিজেরাই একটা মাপকাঠি ঠিক করে নিয়েছি। এই স্বেচ্ছা নির্ধারিত মাপকাঠিই আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অদৃশ্য এক ভয় আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। এই ভয়কে জয় করতে না পারলে আমাদের কিছু কথা বলেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে, পুরো কথা কখনোই বলা যাবে না।

সরকারি দলের অনেককে বলতে শুনেছি, ভিন্নমতের একটা সীমা আছে, ধৈর্যেরও একটা সীমা আছে। সমস্যাটা এখানেই। ধৈর্য কমে গেলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে পারেন। কারণ সরকারের ধৈর্যের সীমা মেপে তো আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে না। সমস্যা হলো সরকারের ধৈর্যের সীমা যেখানে শেষ, দমন সেখানেই শুরু।

গত ১১ বছর ধরেই আওয়ামী লীগ নিষ্ঠুর কায়দায় রাজনৈতিক ভিন্নমতকে দমন করে আসছে। কোটাবিরোধী আন্দোলন বা নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে সরকার কয়েকদিন ধৈর্য দেখাতে পারলেও বিএনপি-জামায়াতের ব্যাপারে একেবারে জিরো টলারেন্স। বিএনপি আন্দোলনের নামে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে দেশজুড়ে আগুন সন্ত্রাস চালিয়েছে, এটা যেমন ঠিক; আবার এটাও তো ঠিক কোনো উপায়ে আন্দোলন করার সুযোগ পাচ্ছে না একসময়ের প্রতাপশালী দলটি। রাস্তায় নামলেই পুলিশি আক্রমণের শিকার হচ্ছে বিএনপি নেতাকর্মীরা।

আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকতে আন্দোলন, সমাবেশ, মিছিল, হরতাল এমনকি রাজপথে সহিংসতাও করেছে। আওয়ামী লীগ করেছে বলেই বিএনপিরও সন্ত্রাস করার অধিকার আছে, এমন কু-যুক্তি আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের তো মিছিল, সমাবেশসহ নিয়মতান্ত্রিক সব কর্মসূচি পালন করার অধিকার আছে। যতক্ষণ কর্মসূচিটি শান্তিপূর্ণ থাকবে, ততক্ষণ পুলিশের কিছু করার কথা নয়।

কিন্তু বিএনপি মিছিল-সমাবেশ করতে নামলেই পুলিশ পিটিয়ে সরিয়ে দেয় বলে সমাবেশের অনুমতি নেই। এখন পুলিশ এলে বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতিই দেয় না। এভাবে বিএনপিকে কোণঠাসা করতে করতে রাজনীতিকে রাজপথ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে প্রতিবাদের সংস্কৃতি, ভিন্নমতের সংস্কৃতি আরও কোণঠাসা হয়েছে।

অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশে সরকারবিরোধিতাকেই রাষ্ট্রবিরোধিতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বললেই রাষ্ট্রবিরোধিতার মামলা হয়। অথচ এক সময় এই বাংলাদেশেই রাজনৈতিকবিরোধিতার চমৎকার সংস্কৃতি ছিল। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর ভিন্নমতের শ্রদ্ধা বা পরমতসহিষ্ণুতার একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে। কিন্তু মজাটা হলো, আমরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চাই বটে, কিন্তু ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা তো দূরের কথা, সামান্য সহনশীলতাও নেই। সবার মত একরকম হবে না। ভিন্নমতেই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। কারও মতের সঙ্গে না মিললে আমি যুক্তি দিয়ে তার মত খণ্ডন করবো। পাল্টা মত দেবো। কিন্তু আমরা দেই গালি। দুর্বল হলে গালি দেই। সবল হলে পেটাই। এই আমরাই আবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য গলা ফাটাই।

আমার ইদানীং মনে হয়, বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল হলো ফেসবুক। যেকোনো ঘটনা ঘটুক, ফেসবুকে দ্রুত একটা জনমত গড়ে ওঠে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকার সেই জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে দ্রুত ব্যবস্থাও নিচ্ছে। ফেসবুক যদি মানদণ্ড হতো, তাহলে বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সূচক আরেকটু ঊর্ধ্বগামীই থাকতো। ফেসবুকে মানুষ অনেক স্বাধীনভাবে নিজের মতামত দেয় বটে, তবে এই ফেসবুক দেখলেই বোঝা যায়, ভিন্নমতের প্রতি আমাদের অশ্রদ্ধা কতটা তীব্র। সারাক্ষণ গালাগালি, হুমকি, ভয় দেখানোই চলে সেখানে।  দু’দিন আগে প্রবাসী সাংবাদিক সুপ্রীতি ধর ফেসবুকে ভাষা নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। অনেকের সেটা পছন্দ হয়নি। নাই হতে পারে। কিন্তু তাকে যেভাবে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ করা হয়েছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত।

সত্যিই অসহিষ্ণুতা আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের সবাইকে ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, পরমতসহিষ্ণু হতে হবে; সেটা যেমন সরকারকে, তেমনি ব্যক্তিকেও।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
probhash2000@gmail.com