ছবি : সংগৃহীত

ডিমের হালি ২৫ পয়সা, চাল ২ টাকা, একটা ইলিশ মাছ ৭/৮ টাকা! অবাক হওয়ার মতো অবিশ্বাস্য দাম। না, এই কালে নয় আরও পাঁচ দশক আগে এসব পণ্যের দাম এমনই ছিল। কিন্তু এখন তা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে?

এখন ৫০ টাকায় এক হালি ডিম, ১ কেজি চাল ৫০ থেকে ৯০ টাকা, একটা ইলিশ (মাঝারি) ১ হাজার টাকা আর সাতশো টাকা কেজিতে কিনতে হয়। এই হিসাবে ৫০ বছর পর ১ হালি ডিমের সম্ভাব্য দাম কত হবে? ৮০ গুণ বাড়বে ডিমের দাম। ৫০ বছর পর ১ কেজি চাল হয়তো কিনতে হবে আট-নয়শো টাকায়। একটা ইলিশের দাম ১৪৭ গুণ বেড়ে কত দাঁড়াবে? টাকা মূল্যহীন হচ্ছে পণ্যের কাছে।

তরকারি দাম এখানে যুক্ত নাই করলাম। আর এই পরিমাণের খাবার কিনতে তখন বস্তা ভরে টাকা নিয়ে যেতে হবে বাজারে। আমার এই পরিসংখ্যান অবিশ্বাস্যই বটে। তবে যে কেউ ভালো করে হিসাব যন্ত্র নিয়ে হিসাব কষে নিলে অবিশ্বাস আর ঘোর কাটবে বৈকি!

আরও পড়ুন : দ্রব্যমূল্য : সবই বাড়ছে, কমছে কী? 

এখন যাদের বয়স ৪৫ তাদের নিশ্চয় মেনে আছে তখন ১ পয়সারও মূল্যমান ছিল। সেই সময় ১ পয়সায় মিলতো একটা বুনবুনি (ছোট গোল চকলেট)। এক পয়সায়ও তখন বেশ কেনাকাটা করা যেত। আর আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে টাকার মূল্যমান।

রিকশাওয়ালা ন্যূনতম ভাড়া ২০ টাকা নিতে রাজি হয় না। ভিক্ষুককে এখন ১/২ টাকা দেওয়া যায় না। ১০ টাকা ২০ টাকা ৫০ টাকা ১০০ টাকা, ৫০০ টাকাও এখন মূল্যহীন। হাজার টাকা তারওতো একই দশা।

হারিয়ে গেছে পয়সা! অভ্যন্তরীণ মুদ্রাবাজারে মূল্যহীন হয়ে পড়েছে পয়সা। ক্রমাগত জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে পয়সা এখন অচল। হারিয়ে গেছে প্রায় মুদ্রাবাজার থেকে।

বাস কন্ডাক্টর এবং এমনকি ভিক্ষুকও এখন পয়সা দেখলে নাক সিটকায়। বস্তুত মুদ্রাবাজারে পয়সা মূল্যহীন হয়ে পড়েছে প্রায় এক দশক আগেই। তবে মূল্যহীন হয়ে পড়লেও খুব সীমিত পর্যায়ে দু-একটি ক্ষেত্রে (যেমন বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিল প্রদান) এগুলোয় ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। কিন্তু এখন তাও নেই।

আরও পড়ুন : স্ট্যাগফ্লেশন : বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন পথে?

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এক পয়সা, পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, পঁচিশ পয়সা ও পঞ্চাশ পয়সা ইত্যাদি বিভিন্ন মানের মুদ্রা প্রচলিত ছিল। কিন্তু কালক্রমে জীবন-যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে এগুলোর ব্যবহার ক্রমশ কমতে থাকে।

মূলত নব্বই দশকের গোড়া থেকেই পয়সার ব্যবহার ক্রমশ কমতে থাকে। আর পয়সার ব্যবহার কমে আসায় এই সময় নতুন করে বাজারে পয়সার সরবরাহও বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরিবর্তে এক টাকা সমমানের পয়সা বা নোট বাজারে ছাড়া হয়। বর্তমানে এক টাকা, দুই টাকা ও পাঁচ টাকার সমমানের পয়সা বা নোট বাজারে চালু রয়েছে।

৯০ দশকের কথা তখন ১ টাকার নোট দিয়ে কম করে হলেও ৮টি লজেন্স পাওয়া যেত, সিঙ্গারা ছিল ৫০ পয়সা। আইসক্রিম ছিল ২৫ থেকে ৫০ পয়সা, দুই টাকায় ৫০ গ্রাম চানাচুর বা বাদাম পাওয়া যেত। এক টাকায় ৪০টি মার্বেল পাওয়া যেত।

এখন আপনাকে যদি দুই টাকার মূল্যায়ন করতে বলা হয় তবে একটা নোটের মূল্য আপনার-আমার কাছে মূল্যহীন। অথচ ছোট সময়ের এই এক টাকার নোট আপনাকে যে সুখের অনুভূতি দিয়েছে এখন পকেটে থাকা ২০০০ টাকাও সেই অনুভূতি দিতে পারে না।

আরও পড়ুন : মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত : সবার জীবন যায় যায় 

যখন আমরা ছোট ছিলাম তখন চাহিদা ছিল ছোট। এই কারণে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে ব্যবধান কম ছিল বিধায় মনে অনেক সুখ ছিল। কিন্তু এখন প্রত্যাশা অনেক বড়, প্রাপ্তি বেশি। দুঃখের ভাগটাও বেশি। আসলে নামতে নামতে তলানিতে এসে ঠেকল টাকার দাম। বর্তমানে এশিয়াতে মুদ্রা হিসাবে সব চেয়ে খারাপ পারফর্মেন্স করেছে টাকা। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট ও ক্রেডিট ডেফিসিটের জন্যই টাকার দামের এই রেকর্ড পতন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হস্তক্ষেপ করতে পারে বলে আশা করছে অর্থনৈতিক মহল।

করোনা আর রাশিয়ার যুদ্ধে যতটা না বাড়ার কথা তার চেয়ে অনেক বাড়িয়েছে এদেশের সিন্ডিকেটওয়ালারা। সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির হার যেমন অনেক কম ছিল, তেমনই গ্রামের বাজারে জিনিসপত্রের দাম শহরের তুলনায় কম হারে বাড়ত, আর খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির হারের তুলনায় অনেক কম।

বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল খুবই অল্প—২০১৯ সালের এপ্রিলে মাত্র ১.৩১ শতাংশ। মূল্যবৃদ্ধির হার বেড়ে যাওয়ার ফলে মধ্যবিত্তের তো অবশ্যই নাভিশ্বাস উঠছে, কিন্তু দাম বাড়ার প্রকোপ গরিব মানুষের ওপর পড়ছে সব চেয়ে বেশি। এর কারণ প্রথমত, শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি গরিব মানুষ বাস করেন; দ্বিতীয়ত, অপেক্ষাকৃত সচ্ছলদের তুলনায় গরিব মানুষ খাবার-দাবারের পেছনে তাদের আয়ের আরও বেশি অংশ ব্যয় করে থাকেন, ফলে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে তাদেরই সবচেয়ে ক্ষতি এবং কষ্ট অনেক বেড়ে যায়।

আরও পড়ুন : প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার দায় 

কিছুদিন আগেও একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিয়ে বাজারে গেলে যতটা চাল-ডাল-তেল-মশলা, ফলমূল, মাছ-মাংস কেনা যেত, এখন তার চেয়ে কম কেনা যাচ্ছে।

আজকের পণ্যের দামের সাথে পরের বছরের দাম মিলছে না। বাড়ছে সীমহীন গতিতে। টাকার দাম পড়ে যাওয়ার আরেকটা কারণ হলো, বিদেশি মুদ্রার বাজারে টাকার নিরিখে ডলারের দাম বাড়ছে সবসময়। অর্থাৎ, প্রতিটি ডলার কিনতে বছর ঘুরলেই বেশি টাকা লাগছে। তাই পণ্যমূল্য দিনদিন অসহনীয় হচ্ছে।

২০২২ সালের চিত্র দেখলেই বোঝা যাবে বছর বছর কীভাবে দাম বাড়ছে। এপ্রিল মাসে দেশে খুচরা পণ্যের বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৭.৭৯ শতাংশ। তার মানে, ২০২১ সালের এপ্রিলে খুচরা বাজারে জিনিসপত্রের দাম যা ছিল, তার তুলনায় ২০২২-এর এপ্রিলে জিনিসপত্রের দাম ৭.৭৯ শতাংশ বেড়েছে।

তুলনার জন্যে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০২২-এর মার্চ মাসে মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৯৫ শতাংশ, আর ২০২১-এর এপ্রিল মাসে তা ছিল ৪.২৩ শতাংশ।
সম্প্রতি বাংলাদেশে শহরাঞ্চলে যে হারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, গ্রামাঞ্চলে বাড়ছে তার তুলনায় বেশি হারে। ২০২২-এর এপ্রিলে শহরাঞ্চলে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির হার ৭.০৯ শতাংশ, গ্রামাঞ্চলে ৮.৩৮ শতাংশ।

আরও পড়ুন : আসুন মুড়ি খাই! 

পাহাড়ি এলাকায় মূল্যবৃদ্ধির হার আরও বেশি। সাম্প্রতিক কালে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার অনেক বেশি— গ্রামে এবং শহরে। গ্রামে ৮.৫ শতাংশ, শহরে ৮.০৯ শতাংশ। অর্থাৎ, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিই মূলত খুচরা বাজারে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির হার ঠেলে তুলে দিচ্ছে। এভাবেই বছরবছর বাড়ছে পণ্যেও দাম।

একবার কোনো পণ্যের দাম বাড়লে আর তা কমে না। তাই বছর যত যাচ্ছে পণ্যের দামও বাড়ছে। বাড়ার হার যে বেশি এটা কেউ খেয়াল করছে না। কষ্টের কথা হলো-বিভিন্ন পণ্যের শতকরা হারে কত ভাগ দাম বেড়েছে, তা হয়তো সার্বক্ষণিকভাবে হিসাব করে রাখার মতো কোনো সংস্থা নেই দেশে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এমন নীতি কখনো গ্রহণ করা হয়নি। তাই দেশে চাল, ডাল, আটা, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। টাকা যেন একবারেই মূল্যহীন হচ্ছে।

মীর আব্দুল আলীম ।। সাংবাদিক