ছবি : সংগৃহীত

ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্র উপকূলের দেশ হওয়ায় বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় প্রবণ দেশ। বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে দেখা যায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রাণহানিও নেহাত কম নয়। প্রাণহানি ছাড়াও ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এলাকার মানুষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী আগামী ২৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় ঘূর্ণিঝড় ’সিত্রাং’ বাংলাদেশে আঘাত হানতে পারে। এই ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে আছে ১৯টি জেলা।

সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং এই জেলাগুলোর অদূরবর্তী দ্বীপগুলোয় স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩ থেকে ৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে এবং চরগুলোর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। তবে, সিত্রাং সুপার সাইক্লোনে রূপ নেবে না বলেও জানিয়েছেন ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান।

আরও পড়ুন : জলবায়ু পরিবর্তন : ঝুঁকি মোকাবিলায় আমরা কি সক্ষম?

ঘূর্ণিঝড়, আবহাওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া; যা পৃথিবীতে তাপের ভারসাম্য রক্ষা করে। যদিও উপকূলে আঘাত হানলে এটি দুর্যোগে পরিণত হয়।

পৃথিবীতে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৮০টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়ে থাকে যার অধিকাংশই সমুদ্রেই শেষ হয়ে যায়। অল্পসংখ্যক ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানে। তার মধ্যে দুই একটি ভয়ংকর ক্ষতিসাধন করে।

পৃথিবীতে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৮০টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়ে থাকে যার অধিকাংশই সমুদ্রেই শেষ হয়ে যায়। অল্পসংখ্যক ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানে।

ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হওয়ার জন্য সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা কমপক্ষে ২৬-২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বিদ্যমান থাকা প্রয়োজন এবং কমপক্ষে ৫০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত এই তাপমাত্রা থাকতে হয়। এই কারণে দেখা যায় কর্কট ও মকর ক্রান্তিরেখার কাছাকাছি সমুদ্র অঞ্চলগুলোয় গ্রীষ্মকালে বা গ্রীষ্মের শেষে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়।

সাম্প্রতিক শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে দায়ী করেছেন অনেক আবহাওয়াবিদ ও বিজ্ঞানী। ১৯৭০ সালের পর ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রের তাপমাত্রা এক ডিগ্রির ফারেনহাইটের কাছাকাছি বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন আগের চেয়ে শক্তিশালী এবং বেশিসংখ্যক ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির কারণ হিসেবে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি দায়ী করেছেন আবহাওয়াবিদ ও বিজ্ঞানী।

আরও পড়ুন : পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের ভূমিকা কী?

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর। এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রাণ হারিয়েছিল সাড়ে ৫ লাখ মানুষ। পৃথিবীর ইতিহাসে ঘূর্ণিঝড়ে এত প্রাণহানি আর কখনো দেখা যায়নি।

১৯৮৮ সালের নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ে পাঁচ হাজার ৭০৮ জন, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। ১৯৯৭ সালের মে মাসে বাংলাদেশের সীতাকুণ্ড ও এর আশেপাশের এলাকায় আরেকটি ঘূর্ণিঝড় হয়, যার ফলে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়।

এছাড়াও বুলবুল (নভেম্বর, ২০১৯), ফণী (মে, ২০১৯), মোরা (মে, ২০১৭), রোয়ানু (মে, ২০১৭), কোমেন (জুলাই, ২০১৫), মহাসেন (মে, ২০১৩), আইলা (মে, ২০০৯), বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে এবং ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়।

কাছাকাছি সময়ের মধ্যে (নভেম্বর, ২০০৭) আঘাত হানা সবচেয়ে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’। সিডর এবং তার প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।

আগে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হলেও, কয়েক দশক ধরে ঝড় জলোচ্ছ্বাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ কমে এসেছে। তবে মাঝে মাঝেই অপ্রতিরোধ্য প্রকৃতির কাছে মানুষ হার মেনে যায়।

আরও পড়ুন : বিশ্ব পরিবেশ দিবস : আমাদের ব্যর্থতা ও করণীয় 

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী সিত্রাং আঘাত হানবে ২৫ অক্টোবর। ২৪ অক্টোবর রাত থেকে ২৫ অক্টোবর সন্ধ্যার মধ্যে আমাদের সমুদ্র উপকূলে আঘাত হানার কথা জানানো হয়েছে।

‘সিত্রাং’ নামটি থাইল্যান্ডের দেওয়া। জানা যায়, এই শব্দটি ভিয়েতনামিজ। যার অর্থ ‘পাতা’। সিত্রাংয়ের পর যে ঘূর্ণিঝড় আসবে তার নাম হবে ‘মন্দোস’।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের ম্যাপিং অনুযায়ী দিক পরিবর্তন করে ঝড়টি আগালে উপকূলের ৭৩০ কিলোমিটার এলাকায় এটি আঘাত করবে। তিন বছর যেসব ঘূর্ণিঝড় হয়েছে সিত্রাং আঘাত হানার এলাকা তার চেয়ে বড়। যেহেতু এই সময়ে অমাবস্যা থাকবে, তাই জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা বেশি।

ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ সম্বন্ধে অনেকেরই হয়তো ধারণা নেই। ২০০০ সালের আগে এই অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের কোনো নাম দেওয়া হতো না। কিন্তু এরপর থেকে ঝড়ের নামকরণ শুরু হয়।

ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়ার রীতি চালু করে ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন ও ইউনাইডেট নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়ার সদস্য দেশগুলো।

আরও পড়ুন : বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ কী? 

ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (WMO) অধীন জাতিসংঘের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমুদ্র তীরবর্তী ১৩টি দেশের আবহাওয়াবিদদের সংস্থা এস্কেপ ঘূর্ণিঝড়ের নাম দিয়ে থাকে।

প্রতিটি দেশ নাম প্রস্তাব করার সুযোগ পায়। এই ১৩টি দেশের কাছে আগাম পূর্বাভাস ও সতর্কবার্তা পাঠানো হয়। নামের সিরিয়াল অনুযায়ী এবার বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হলে তার নাম হওয়ার কথা ‘সিত্রাং’। আর তাই এই বছর ঝড়ের নাম হয়েছে ‘সিত্রাং’। ‘সিত্রাং’ নামটি থাইল্যান্ডের দেওয়া। জানা যায়, এই শব্দটি ভিয়েতনামিজ। যার অর্থ ‘পাতা’। সিত্রাংয়ের পর যে ঘূর্ণিঝড় আসবে তার নাম হবে ‘মন্দোস’। এই নামটি দিয়েছে সৌদি আরব। তারপরের ঘূর্ণিঝড়ের নাম ‘মোচা’ যেটি দিয়েছে ইয়েমেন।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ অনেকটাই সফলতা অর্জন করেছে বলে আমরা বিগত সময়গুলোয় দেখেছি। ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে ইতিমধ্যে আমরা জানতে পেরেছি ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ মোকাবিলায় প্রস্তুতির বিষয়ে।

সব ডিসিদের সঙ্গে মিটিং করে সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোয় আগাম প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জেনেছি। Cyclone Preparedness Programme (CPP)-কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রস্তুতি নিতে এবং সতর্কবার্তা প্রচার করতে। তারা ইতিমধ্যে প্রচারণা শুরু করছে।

আরও পড়ুন : জলবায়ু পরিবর্তন : তলিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশের ১৩ শতাংশ ভূমি

জেলা পর্যায়ের আশ্রয় কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার সময় মানবিক সহায়তার জন্য প্রত্যেক জেলায় ১ হাজার প্যাকেট করে শুকনা খাবার, ২৫ টন চাল, ড্রাই কেক ও বিস্কুট সরবরাহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘের সম্মানজনক ‘জাতিসংঘ জনসেবা পদক-২০২১’ পেয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।

কথায় নয় আমরা ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ মোকাবিলায় প্রস্তুতির বাস্তবায়ন দেখতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি ‘সিত্রাং’ বড় ধরনের আঘাত হানবে না। তবে ঝুঁকিতে থাকা ১৯টি জেলার প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি থাকা বাঞ্ছনীয়। 

ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ, গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
professorkabirul@gmail.com