ছাত্ররাজনীতি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রেক্ষিত
বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতি নতুন নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের সাথে ছাত্ররাজনীতির বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এদেশে ছাত্ররাজনীতির রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।
পঞ্চাশ, ষাট এবং সত্তরের দশকে এদেশের ছাত্ররাজনীতি ছিল মানুষের কল্যাণের জন্য, জনস্বার্থ রক্ষার জন্য, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য। শুধু আন্দোলন সংগ্রামে নয়, ইতিবাচক রাজনীতিতেও শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
বিজ্ঞাপন
দেশের বিভিন্ন সংকটে তারা পালন করেছে যথোপযুক্ত ভূমিকা। এসব কারণে সমাজের মানুষের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ছিল আলাদা মর্যাদা। অনেককেই বলতে শুনেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যদি কখনো বাসে দাঁড়িয়ে যেত এবং বাসের সিটে বসা একজন বয়স্ক মানুষও যদি সেটা জানতে পারতো; তবে, সেই বয়স্ক ব্যক্তিও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সিট ছেড়ে দিতে চাইতো।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ইদানীং কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে বেশিমাত্রায় নেতিবাচক কথা শুনতে হচ্ছে? কেনইবা তারা বারবার গণমাধ্যমে নেতিবাচক শিরোনাম হচ্ছে? মে থেকে সেপ্টেম্বর, এই পাঁচ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় চারবার ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
ছাত্ররাজনীতি নিয়ে যতটা না আশার খবর পাওয়া যায় তার চেয়ে ঢের বেশি ছিনতাই, দুই পক্ষের মারামারি, সিট বাণিজ্যই সংবাদ শিরোনাম হয়।
জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও ছাত্রনেতাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। এই পরিস্থিতির জন্য পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করছে প্রশাসন ও ছাত্রনেতারা। সংবাদে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পরিবেশ পরিষদের’ নিয়মিত সভা না হওয়ায় বাড়ছে অস্থিতিশীলতা।
এর আগে, ছাত্ররাজনীতির জন্য আলোচনায় আসে ইডেন কলেজ। হোস্টেলগুলোয় সিট বাণিজ্যের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়েছে দুই গ্রুপের নেত্রীরা। পরিস্থিতি কলেজ কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার পরদিন ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়ে পরিবেশ অশান্ত করা হয়েছে। ছাত্ররাজনীতি নিয়ে যতটা না আশার খবর পাওয়া যায় তার চেয়ে ঢের বেশি ছিনতাই, দুই পক্ষের মারামারি, সিট বাণিজ্যই সংবাদ শিরোনাম হয়।
বেলজিয়ামের ঘেন্ট ইউনিভার্সিটি (Ghent University)-র কনফ্লিক্ট রিসার্চ গ্রুপ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রো গভর্নেন্স রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ-এর যৌথ উদ্যোগে করা একটি গবেষণার তথ্যমতে, ১৯৯১ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত, মোট রাজনৈতিক সহিংসতার ২৫ ভাগেরও বেশি ছাত্রদের দ্বারা সংগঠিত হয়েছে।
এছাড়া রাজশাহী ও সিলেটের মতো কিছু শহরে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় অংশ নেয় ছাত্ররা। স্বাধীনতার পর ৫ দশকে বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক কারণে প্রায় ১৫০ জন ছাত্র প্রাণ হারিয়েছে।
অর্থাৎ উপরের আলোচিত ঘটনাগুলোর কোনোটিই ছাত্ররাজনীতির এই গৌরবোজ্জ্বল অতীত ঐতিহ্যের সাথে মেলে না। কারণ ছাত্ররাজনীতি সেই উপায় যার মাধ্যমে ছাত্রদের সামাজিকীকরণ হয় এবং শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকার আদায়ের, রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালন এবং সকল ধরনের অন্যায্যতা, ন্যায়হীন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে সাহস করে।
ইতিহাস, গবেষণা, পাঠ্য খুললেই ছাত্রদের এই সামাজিকীকরণের উদাহরণ পাওয়া যায়। বিশেষত ১৯৫২-পরবর্তীতে পরাধীনতা, সামাজিক সংস্কার এবং শিক্ষা ও স্বাধীনতার পক্ষে, সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণের চিত্র পাওয়া যায়। এরপর ১৯৬২-র হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৬৬-র ঐতিহাসিক ৬ দফা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত বিশ্লেষণে দেখা যায়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা কর্মসূচি এবং পরবর্তীকালে তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা উপস্থাপিত হলে ছয় দফা সমর্থন ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে ছাত্রদের মধ্যে এক নজিরহীন ঐক্য গড়ে ওঠে। এরপর ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধ জ্বলন্ত উদাহরণ। অর্থাৎ প্রতিটি ঐতিহাসিক ও গণতান্ত্রিক বিজয়ে ছাত্ররা ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তীতে ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও এই দেশের ছাত্ররাজনীতির রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা।
সেই সময়ে ছাত্র আন্দোলনের নেতা তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আব্দুর রব, আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ নেতাদের জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ও ভূমিকা রাখার উদাহরণ পাওয়া যায়। গবেষক ড. মোহাম্মদ হাননান তার একটি লেখায় পূর্বের আন্দোলনগুলো বৈষয়িক লাভমুক্ত আন্দোলন হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শপথ নেওয়া সংসদ সদস্যদের ১৮২ জনই (৬১ দশমিক ৭ শতাংশ) পেশায় ব্যবসায়ী। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতিক তৈরি না হওয়ায় ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদরা অর্থের জোরে রাজনীতিতে এগিয়ে থাকছেন
তবে বর্তমান সময়ের ছাত্ররাজনীতিকদের মধ্যে সেই ছাত্র অধিকার, জাতীয় সংকটে নেতৃত্ব দিয়ে পথ দেখাবার উদাহরণ পাওয়া মুশকিল। যার অন্যতম কারণ শিক্ষার্থীদের ছাত্ররাজনীতিতে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আবাসিক হলে সিট পাওয়া, ক্ষমতার চর্চা করা, অর্থনৈতিক সুবিধা লাভ-মূলত এসব কারণেই ছাত্ররাজনীতিতে অংশ নেয় অনেক শিক্ষার্থী। আবার অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা।
ছাত্ররাজনীতি ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বড় রাজনৈতিক দলের বাইরে গিয়েও শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে নিজেদের লাঠিয়াল বাহিনী তৈরি করছেন রাজনীতিবিদরা—এমন অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে।
এসব কারণে বর্তমান সময়ের ছাত্ররাজনীতিকে অস্ত্র ও অর্থের রাজনীতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন গবেষক ড. মোহাম্মদ হাননান। তার মতে, ‘স্বাধীনতা পরবর্তীতে অস্ত্র ও অর্থের সংযোগ ঘটিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে ছাত্ররাজনীতিকে ব্যবহার শুরু করে। ফলে ছাত্ররাজনীতি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।’
যদিও রাজনীতিতে তরুণেরা একটি সৃজনশীল শক্তি হতে পারে। উদ্ভাবনের এই গতিশীল উৎস যা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু আজকের ছাত্ররাজনীতির জটিল প্রকৃতির কারণে শিক্ষার্থীরা মূল ধারার রাজনীতিতে অংশ নিতে চায় না।
গবেষণার তথ্য বলছে, জাতীয় রাজনীতি নিয়ে ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর কোনো আগ্রহ নেই। অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী বন্ধুমহলে রাজনৈতিক বিষয়াবলী নিয়ে আলোচনা করতেও আগ্রহ প্রকাশ করেন না। রাজনীতি এবং রাজনৈতিক আলোচনায় তরুণদের অংশগ্রহণের এই ক্রমহ্রাসমান মাত্রা কেবল নেতৃত্বের মানকেই বিপন্ন করে না বরং আগামীর গণতন্ত্রকেও বিপন্ন করে তোলে।
এর প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতেও দেখা যাচ্ছে। ছাত্ররাজনীতিকদের মধ্যে খুব কমসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে। সর্বোপরি সঠিক দিশা না থাকা, ছাত্রদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের কারণে শিক্ষার্থী রাজনীতিকরা পথভ্রষ্ট হচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় ফিরে আসি। ছাত্র নেতাদের দাবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাদের কথা বলার কোনো প্ল্যাটফর্ম নেই। তাদের এই দাবি কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজগুলোয় ছাত্র সংসদের কার্যকারিতা নেই প্রায় তিন যুগ। যেহেতু ছাত্র সংসদের নির্বাচন হচ্ছে না; সেহেতু যোগ্য ছাত্র নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না। কারণ যেসব ছাত্র পূর্বে ছাত্র সংসদের নির্বাচন করতো তাদের লক্ষ্যই থাকতো রাজনীতিবিদ হিসেবে ক্যারিয়ার গড়া।
রাজনীতি, প্রশাসন বা অন্য কোনো লক্ষ্যে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তারা ছাত্র জীবনেই নিয়ে নিতেন। আর ছাত্রদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব তৈরি না হওয়ার ফলে জাতীয় রাজনীতিতে রাজনীতিবিদের অভাব তৈরি হয়েছে। এই সুযোগে রাজনীতিবিদদের জায়গা দখল করছেন ব্যবসায়ী রাজনীতিকেরা।
গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শপথ নেওয়া সংসদ সদস্যদের ১৮২ জনই (৬১ দশমিক ৭ শতাংশ) পেশায় ব্যবসায়ী। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতিক তৈরি না হওয়ায় ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদরা অর্থের জোরে রাজনীতিতে এগিয়ে থাকছেন এবং নিজেদের প্রয়োজনে ছাত্ররাজনীতিবিদদের ব্যবহার করছেন।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটা বড় অংশ রাজনীতিবিদ ও নেতাদের পেছনে ব্যয় করা ছাত্ররাজনীতিবিদরা পড়ালেখা শেষ করে কী করবেন সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। যার ফলে অনেক সময় অনেক মেধাবী ছাত্ররাজনীতিবিদ হিসেবে ছিটকে পড়ছেন।
দেশের সামগ্রিক কল্যাণে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তাই শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে যোগ্য নেতৃত্ব তৈরিতে জোর দেওয়ার সময় এখনই। এক্ষেত্রে শুধু শিক্ষার্থীদের ওপর দায় চাপালেই চলবে না বরং ছাত্ররাজনীতির অতীতের গৌরবগাঁথা ও ইতিহাসকে ছাত্রসমাজের কাছে তুলে ধরতে হবে। এই দায় সরকার, রাজনৈতিক দলসমূহ এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ গণমাধ্যমকে নিতে হবে।
ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে ।। অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ এবং প্রশাসক, জনসংযোগ দপ্তর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়