ফেস্টিভ্যাল ট্যুরিজম : পর্যটনের নতুন সংযোজন
বাঙালি বরাবরই ভ্রমণপিপাসু। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ নানাবিধ প্রয়োজনে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করে। বাঙালি জাতি ইতিমধ্যে ভ্রমণের প্রেমে পড়েছে। নান্দনিক বাংলাদেশ এখন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের ভ্রমণ গন্তব্য।
আনন্দঘন পরিবেশে সময় কাটানোর জন্য দেশে এখন অনেক পর্যটন স্পট রয়েছে, যা অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের ভ্রমণে উৎসাহিত করে। নানারকম কৃষ্টি-কালচার এদেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করে।
বিজ্ঞাপন
পূজা ও ঈদের ছুটিতে সময় প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ভ্রমণ প্রবণতা বৃদ্ধি পায় ও বিভিন্ন উৎসবে যোগদানের জন্য আন্তঃজেলা ভ্রমণ বৃদ্ধি পায়।
বিশ্বায়নের যুগে কর্মব্যস্ত জীবনে বিনোদনের বিকল্প নেই, তাই এই বছর পূজা ও ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী বাংলাদেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে পর্যটক সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে। ট্যুর অপারেটররা দেশ ও বিদেশ ভ্রমণের আকর্ষণীয় প্যাকেজ অফার করে তার মধ্যে মধ্যবিত্ত সমাজের প্রথম পছন্দ বাংলাদেশের কক্সবাজার, কুয়াকাটা, বান্দরবান, রাঙামাটি, সিলেট, খাগড়াছড়ি ও কুমিল্লা ছাড়াও ভারত (কলকাতা, শিমলা, মানালি), নেপাল, ভুটান।
উচ্চবিত্ত শ্রেণির পছন্দ থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, মিসর, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও অন্যান্য দেশ। ঈদের ছুটিতে যেহেতু পর্যটক সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তাই বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ‘পর্যটন-ব্যবস্থাপনা’ গুরুত্ব পায়।
মানুষ যখন পরিবার-পরিজন নিয়ে নিজ জেলায় ঘুরতে যায় তখন জেলাভিত্তিক পর্যটনকেন্দ্রগুলোয় বিনোদন প্রেমীদের ভিড় বাড়ে। তাই জেলাভিত্তিক পর্যটন স্থাপনাগুলো উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন করা খুবই প্রয়োজন।
দুর্গোৎসব ও ঈদ-এ-মিলাদুন্নবীর ছুটিতে প্রচুর পর্যটকের সমাগম হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যটন আকর্ষণগুলোয় তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায় এই বছর প্রচুর পরিমাণ পর্যটক ভ্রমণে গিয়েছেন। পর্যটকদের আগমনে মুখরিত তিনটি (বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি) জেলার সব পর্যটন স্পট।
নয়নাভিরাম প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে ভরপুর আমাদের দেশের এক দশমাংশ এলাকা নিয়ে পাহাড়-নদী-অরণ্য বেষ্টিত নৈসর্গিক মনোরম দৃশ্য ঘেরা বহুমাত্রিক আকর্ষণীয় সবুজ বনভূমি খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর দৃষ্টিনন্দন বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি কৃষ্টি আচার-অনুষ্ঠানে সমৃদ্ধ বিচিত্র জীবন ধারা, পাহাড়ি স্বচ্ছ জলের লেক, ইতিহাস ও ঐতিহ্যময় স্থান, বিভিন্ন উৎসব-পার্বণ এবং বুনো পশু ও পাখপাখালির মিষ্টি কলরবে মুখরিত অভায়রণ্যে সমৃদ্ধ পার্বত্যাঞ্চলে রয়েছে পর্যটন শিল্পের অমিত সম্ভাবনা। ব্যবসায়ীরা জানান যে, সপ্তাহ জুড়ে হোটেল-মোটেল ও কটেজ ভাড়া হয়ে গেছে।
অন্যদিকে অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর সাগরকন্যা কুয়াকাটার পর্যটনকেন্দ্রিক বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন অনেক ব্যবসায়ী। পদ্মা সেতু চালুর পর এরই মধ্যে হোটেল, রেস্তোরাঁসহ নানা ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ শুরু হয়েছে।
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যাওয়ায় পর্যটকদের টানে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার এই পর্যটনকেন্দ্র। তাছাড়া সমুদ্রের অসীম জলরাশি, সমুদ্রবক্ষে জেলেদের মাছ ধরার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য, সমুদ্রপাড়ঘেঁষা বন-বনানী, কুয়াকাটা পর্যটক-দর্শনার্থীর কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
কিছুদিন আগেও কুয়াকাটা যেতে পথেই দীর্ঘ সময় চলে যেত পর্যটকদের। পদ্মা সেতুর দ্বার উন্মোচনের পর সেই ভোগান্তি আর নেই। ফলে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়েছে। আর তাদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতে গড়ে উঠছে নানা অবকাঠামো।
বিনোদনপিপাসু মানুষ বাজেট প্যাকেজের সুযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে থাকে। যারা পরিবার-পরিজন নিয়ে এক দিনের ভ্রমণে যেতে আগ্রহী, তাদের কাছে ঢাকার নিকটবর্তী পর্যটনকেন্দ্র পদ্মা রিসোর্ট, গাজীপুরের ঢাকা রিসোর্ট, এলেঙ্গা রিসোর্ট, ড্রিমল্যান্ড রিসোর্ট, ভাওয়াল রিসোর্ট ও নড়াইলের অরুণিমা রিসোর্ট ও গলফ ক্লাবের পর্যটক চাহিদা বেশি।
বিছানাকান্দি ও সিলেটের চা-বাগান পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র। সুতরাং উল্লেখ্য পর্যটনকেন্দ্রগুলোর যাতায়াত ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়োজন পর্যটক চাহিদা মেটানোর জন্য।
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক স্থাপনা। ছুটিতে মানুষ যখন পরিবার-পরিজন নিয়ে নিজ জেলায় ঘুরতে যায় তখন জেলাভিত্তিক পর্যটনকেন্দ্রগুলোয় বিনোদন প্রেমীদের ভিড় বাড়ে। তাই জেলাভিত্তিক পর্যটন স্থাপনাগুলো উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন করা খুবই প্রয়োজন।
পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়ে অনেক পর্যটনকেন্দ্র সক্ষমতার বেশি পর্যটক আসার কারণে পর্যটন এলাকার হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট-এর চাহিদা বেশি থাকায় এই সুযোগে হোটেল কক্ষ ভাড়া, খাবার দাম, পর্যটন কেন্দ্রের গাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য সহায়ক সেবার ক্ষেত্রে বেশি দাম ধার্য করেন। তাই পর্যটক সেবা নিশ্চিত করার জন্য তদারকি সংস্থার নজরদারির পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে পর্যটকবান্ধব মানসিকতার খুবই প্রয়োজন।
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে উল্লেখযোগ্য পর্যটন প্রসার প্রয়োজন। অল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করলে সমবায় পর্যটন, কমিউনিটি বেইজড পর্যটন আরও সম্প্রসারিত হবে।
এই ধারায় দেশের পর্যটন উন্নয়নে জেলাভিত্তিক পর্যটন উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রয়োজন যা টেকসই পর্যটন উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। দেশীয় পর্যটকের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজিকরণ ও পর্যটন আকর্ষণগুলোর ডিজিটাল ব্র্যান্ডিং করা প্রয়োজন।
বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের জন্য ই-ভিসা চালু ও অন-অ্যারাইভাল ভিসার দেশের সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। পর্যটন প্রমোশনে ও ব্যান্ডিংয়ের জন্য গণমাধ্যমের সহযোগিতা ও তাদের সাথে পার্টনারশিপ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
পর্যটনের নতুন ধারণা PPCP (Private-Public-Community Partnership) এর উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। পর্যটন শিল্পের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য প্রথমত চাহিদা নিরূপণ করা প্রয়োজন এবং সেই অনুযায়ী জোগান নিশ্চিত করার জন্য জেলাভিত্তিক সফট স্কিল ট্রেনিং প্রয়োজন।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য গ্রামীণ পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন একান্ত প্রয়োজন।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি-২০৩০) অর্জন ত্বরান্বিত করতে সমবায়ভিত্তিক পর্যটন, গ্রামীণ পর্যটন, কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম, জেলাভিত্তিক পর্যটন, সাংস্কৃতিক পর্যটন ও হাওর পর্যটন উন্নয়নের মধ্য দিয়ে একতা-সাম্য ও সহযোগিতার প্রত্যয় বৃদ্ধি করে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে পর্যটনশিল্প বাংলাদেশে জাতীয় উন্নয়নে বড় অবদান রাখতে পারে।
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে উল্লেখযোগ্য পর্যটন প্রসার প্রয়োজন। অল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করলে সমবায় পর্যটন, কমিউনিটি বেইজড পর্যটন আরও সম্প্রসারিত হবে। গ্রামের মানুষের মধ্যে মমত্ববোধ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সহযোগিতা, একতা, সাম্য বৃদ্ধি পাবে যা বর্তমানে চলমান উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে সহযোগিতা করবে এবং বাস্তবায়িত হবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা।
সর্বোপরি ফেস্টিভ্যাল ট্যুরিজম ব্র্যান্ডিং করা গেলে অভ্যন্তরীণ পর্যটন সম্প্রসারিত হবে উল্লেখযোগ্য হারে, তৈরি হবে কর্মসংস্থানের সুযোগ ও সমৃদ্ধ হবে দেশের অর্থনীতি।
ড. সন্তোষ কুমার দেব ।। চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
santus@du.ac.bd