বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের রাজনীতি
শিক্ষক হারিয়ে গেছেন। খুঁজে পাচ্ছি না কোথাও। এমন কথা আমি প্রায়ই বলি। আড্ডাতে, আনুষ্ঠানিক আলোচনায়, লেখাতেও বিভিন্ন ভাবে শিক্ষক নিখোঁজ হওয়ার কথা বলি। কিন্তু শিক্ষক নিখোঁজ হওয়ার এই কথায় কাউকে উদ্বিগ্ন হতে দেখিনি। লণ্ঠন হাতে শিক্ষকের খোঁজে বের হবেন, এমন তাগিদ দেখি না কারো মধ্যে। কেউ বিদ্রূপের হাসি হাসেন। কারণ তারাতো দেখতেই পাচ্ছেন, শিক্ষক বহাল তবিয়তেই আছেন। ক্লাস নিচ্ছেন, ছুটিতে যাচ্ছেন, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন, সেমিনারে যোগ দিচ্ছেন নিশিতে ছোট পর্দায় বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথার প্রদর্শনীতে যোগ দিচ্ছেন। সুতরাং শিক্ষক নেই এমন কথা তারা মানতে চাইবেন না, এমনটাই স্বাভাবিক। শিক্ষকদের কাছেও এমন কথা বলেছি, জানতে চেয়েছি আপনারা কি নিজেদের শিক্ষক ভাবেন? দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছি। দেখেছি তাদের মধ্যকার পারস্পরিক দ্বন্দ্ব। কতো ভয়ঙ্কর নকশা তৈরি করেন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। সবচেয়ে লজ্জা পেয়েছি, ছাত্র সংগঠনের সাধারণ কর্মীর সঙ্গেও বিনয় ও প্রণতি সহযোগে তাদের কথোপকথন।
শিক্ষকরা নীল, গোলাপি ও সাদা রঙে নিজেদের রাঙিয়ে রেখেছেন। তাদের মনোজগতে শুধু একটি রাজনৈতিক দলের পতাকা উড়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি দেখতে পাচ্ছে না। শিক্ষকের চোখে পুরু চশমা থাকুক বা না থাকুক তিনি ঐ রাজনৈতিক দলটির ‘আয়না’ দিয়েই দেখছেন চারপাশ। তিনি যে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, যেখানে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নিজেরাও ডুবে থাকার কথা গবেষণার কাজে, তেমন আচরণ নেই তার মধ্যে। তার কর্মকাণ্ডে স্পষ্ট একজন রাজনৈতিক কর্মীর পরিচয় ফুটে উঠছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের যেকোনো দুর্বিপাকে শিক্ষক বা চিন্তক শ্রেণি কথা বলবেন, তাদের পর্যবেক্ষণ জানাবেন, এটাই স্বাভাবিক।
বিজ্ঞাপন
আমাদের শিক্ষকরাও কথা বলেন। এতোটাই বলেন যে, প্রয়োজন ছাড়া অপ্রয়োজনেও বলেন। সেই কথাগুলো দলীয় ইশতেহার, বিবৃতি, প্রচারণার মতো করে বলেন। তারা যখন কথা বলেন, তখন জনমানুষ সহজ ভাবেই বুঝতে পারেন যে, ঐ শিক্ষক কথা বলছেন যেন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতার চোখে চোখ রেখে। কিংবা দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা শুনতে পাবেন, এমন জোরে কণ্ঠ ছেড়ে বলছেন। কারণ এই কথা বলার একটা বিনিময় মূল্য আছে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসতে চান। ডিন বা উপাচার্য হতে চান।
দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছি। দেখেছি তাদের মধ্যকার পারস্পরিক দ্বন্দ্ব। কতো ভয়ঙ্কর নকশা তৈরি করেন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। সবচেয়ে লজ্জা পেয়েছি, ছাত্র সংগঠনের সাধারণ কর্মীর সঙ্গেও বিনয় ও প্রণতি সহযোগে তাদের কথোপকথন...
নানা নামের চেয়ারে আসীন হওয়ার লোভ তার আছে, বিভিন্ন দপ্তরের উপদেষ্টা, চেয়ারম্যান হওয়া থেকে শুরু করে সংসদ সদস্য পদে দাঁড়ানোর লোভটুকু বাদ দিতে চান না। বড় কিছু না জুটলেও বিভিন্ন দলের কমিটির সদস্য হওয়া কিংবা পালা-পার্বণে নিমন্ত্রণ পেলেই তৃপ্তির ঢেকুর দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। আমরা সম্প্রতি দুর্নীতি, অপমৃত্যুসহ বিভিন্ন ঘটনায় রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিজ দলের পক্ষে যতোটা না সাফাই গাইতে দেখেছি, তার চেয়েও বড় গলায় কথা বলেছেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো কোনো শিক্ষক। তারা আসলে কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করেন এক প্রকারের। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে মেধা গুরুত্ব পায় না। প্রার্থী কোন দল করতেন বা কোন দলের আনুকূল্য পেয়েছেন সেটিই বিবেচ্য। রাজনৈতিক দলের তিলক নিয়ে শিক্ষকতায় প্রবেশ করে, তিনি সেই দলের ঢোলক বাজাবেন এটাইতো স্বাভাবিক।
শিক্ষকরা রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত, গোড়া থেকেই। সেই বিভক্তি রাজনৈতিক আদর্শ এবং চিন্তার। খুব নিকট কাল পর্যন্ত এমন ছিলো যে, শিক্ষকের রাজনৈতিক অবস্থান শিক্ষার্থী বা শিক্ষাদান প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতো না। শিক্ষক তার রাজনৈতিক আদর্শ বাজারে তুলতেন না। চাইতেন না কোন বিনিময় মূল্য।
বিনিময়ের দুই একটি বিচ্ছিন্ন উদাহরণ হয়তো চলে আসতে পারে। কিন্তু সার্বিকভাবে শিক্ষকরা দলের কর্মীতে রূপ নিতেন না। এখন ডান, বাম, মধ্য সকলকেই শিক্ষকের চেয়ে বেশি যেন দলীয় নেতা বা কর্মী মনে হয়। নিজেকে বা অপরকে হয়তো বলতে হয়- তিনি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ান।
শিক্ষকের রাজনৈতিক অবস্থান শিক্ষার্থী বা শিক্ষাদান প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতো না। শিক্ষক তার রাজনৈতিক আদর্শ বাজারে তুলতেন না। চাইতেন না কোন বিনিময় মূল্য...
রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তির ভেতরে আরেকটি রাজনৈতিক বলয় তৈরি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। সেটি ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের। সেখানে রাজনৈতিক দল নেই। নিজ বা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে সকল মত সেখানে একাট্টা। আমরা দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনটা দেখেছি। জাতির অভিভাবক হয়ে ওঠা শিক্ষকদেরও দেখেছি, ব্যক্তিস্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয় অশান্ত করে তুলতে। শিক্ষার্থী ও সহকর্মীর সঙ্গে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ এসেছে অনেক শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। শোনা যায়, কোনো কোনোটির পেছনে আছে শিক্ষকদের নিজেদের প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতি।
সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিয়া রহমান অভিযোগ করলেন, অভিসন্দর্ভ তৈরিতে তার বিরুদ্ধে যে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ উঠেছে, তার পেছনে আছে শিক্ষক রাজনীতি। চৌর্যবৃত্তির সত্য মিথ্যে খুঁজে বের করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। কিন্তু সামিয়ার কথাতে একটি বিষয় তো আবারও প্রমাণিত, সত্যিই নোংরা রাজনীতি বলে কিছু আছে। না হলে তিনি ঐ রাজনীতির কাঁধে দোষ তোলার সুযোগ পেতেন কী করে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরুষ শিক্ষকরা চান না নারীরা এগিয়ে যাক, জ্যেষ্ঠরা চান না তরুণরা বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করুক। এই যে নিজেরাই নিজেদের পেছনে টেনে ধরছি, তার ফলাফল আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অবনমন। শিক্ষকদের ঘরোয়া রাজনীতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রবেশ করতে শুরু করেছে। কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষদ ভিত্তিক রাজনীতিও আছে। শিক্ষকদের এই কালো রাজনীতির বিস্তার যতো ঘটবে, ততো ত্বরান্বিত হবে আমাদের জ্ঞানের অবনমন।
তুষার আবদুল্লাহ।। গণমাধ্যমকর্মী