বৈশ্বিক খাদ্যসংকট ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি
প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট কারণে পৃথিবী এখন খাদ্যসংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। মহামারির পর সারা বিশ্ব অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে চলছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আবার বিশ্বকে বড় সংকটে ফেলে দিয়েছে।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম ২০২১ সালের এই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশেও এর বড় প্রভাব পড়েছে। গোটা বিশ্ব এখন একটা মন্দার দিকে চলে যাচ্ছে। একদিকে মন্দা বাড়ছে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে এবং একই সঙ্গে কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
গোটা বিশ্বের জন্যই এটি গুরুতর সংকট। মানুষের হাতে খাদ্যপণ্য পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। আবার তা সম্ভব হলেও অধিকাংশ মানুষের হাতে তা কেনার মতো অর্থও থাকছে না। একটি মানবিক বিপর্যয়।
আরও পড়ুন : বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ কী?
২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বে তীব্র খাদ্যসংকট বিরাজ করবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৫৩টি দেশের মোট ২২ কোটি ২০ লাখ মানুষের জন্য জরুরি সহায়তারও প্রয়োজন হতে পারে। এর মধ্যে ‘হাঙ্গার হটস্পট’ বা মারাত্মক ক্ষুধা পীড়িত হিসেবে চিহ্নিত ১৯ দেশের পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)।
খাদ্যের অভাব ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে শুধু দুর্ভিক্ষই হবে তা নয় বরং এর জেরে বিভিন্ন দেশে বৈষম্য ও সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে। এমন পরিস্থিতিতে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে খাদ্যসংকট কমাতে ২০২৫ সালের মধ্যে অন্তত ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
জাতিসংঘের বিশেষ উদ্যোগে ইউক্রেন থেকে ৩০ লাখ টন খাদ্য সরবরাহের পাশাপাশি বিশ্ব সংস্থাগুলো মিলে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোয় আর্থিক সহায়তা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি রয়েছে। খাদ্যসংকট মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংক ৩ হাজার কোটি ডলারের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
চলতি বছর শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে তা নয়, জলবায়ুগত কারণেও হচ্ছে। এই বছর বিশ্বজুড়েই প্রচণ্ড গরম পড়েছে। ইউরোপীয় খরা পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের (ইডি) তথ্যানুসারে, আর্দ্রতা হারিয়ে ইউরোপের ৪৭ শতাংশ এলাকার মাটি শুকিয়ে গেছে। ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে ২০২৩ সালের শুরুতে খাদ্য স্বল্পতার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
আরও পড়ুন : প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার দায়
প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ভারতসহ এশিয়ার শীর্ষস্থানীয় চাল রপ্তানিকারক দেশগুলোয় চলতি বছর উৎপাদন কম হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এর ফলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এসেছে খরা।
এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ হঠাৎ করেই পৃথিবীতে আঘাত করেছে। বড় বড় নদীর শুকিয়ে যাওয়া এবং বৃষ্টিপাত না হওয়া কিছুটা দুশ্চিন্তার সৃষ্টি করেছে। কারণ এভাবে চলতে থাকলে চলতি সংকট আরও বেশি ঘনীভূত হবে। উৎপাদন কমে যাবে এবং আগামী দিনগুলোয় মানুষকে নিশ্চিত খাদ্য সংকটে পড়তে হতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে মরুকরণ ও খরা—বর্তমানে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির জন্য বিশাল হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বছর বিশ্ব মরুকরণ ও খরা মোকাবিলা দিবস (১৭ জুন ২০২২)-এর প্রতিপাদ্য করা হয়েছে—‘সবাই মিলে খরা সমস্যা কাটিয়ে উঠি’।
এই বিপর্যয়কর অবস্থা মোকাবিলার জন্য অবিলম্বে অবনমিত (ক্ষতিগ্রস্ত) ভূমি পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন। খরা পীড়িত উত্তরাঞ্চলে খরা সহিষ্ণু ফসলে উৎসাহ প্রদানসহ পানির সঠিক ব্যবস্থাপনা করা জরুরি।
গোটা বিশ্বের জন্যই এটি গুরুতর সংকট। মানুষের হাতে খাদ্যপণ্য পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। আবার তা সম্ভব হলেও অধিকাংশ মানুষের হাতে তা কেনার মতো অর্থও থাকছে না...
খাদ্যের একটি বড় অংশ আমাদের আমদানি করতে হয়। একটি পণ্যের উদাহরণ দিয়ে বলি। গম এখন আমাদের প্রধানতম খাদ্য হয়ে উঠেছে, চালের পরেই তার স্থান। আমরা ক্যালরির ৭-৮ শতাংশ এখন গম থেকে নিচ্ছি। এটি বিশাল অংশ। এই চাহিদা আরও বাড়ছে, কিন্তু গমের উৎপাদন তো বাড়ছে না।
গমের বার্ষিক মোট চাহিদার মাত্র এক-চতুর্থাংশ উৎপাদন করতে পারে বাংলাদেশ। গমের অবশিষ্ট চাহিদা বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করার মাধ্যমে মেটানো হয়। বেশিরভাগই আমদানি করি আবার রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে।
আরও পড়ুন : চা শ্রমিক : যে জীবন দাসত্বের!
গম উৎপাদনের ক্ষেত্রে শীর্ষ অবস্থানে থাকা রাশিয়া ও ইউক্রেন তাদের যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে উৎপাদন ও বণ্টন পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে। ভারত এবং কানাডা থেকেও আমরা গম আমদানি করে থাকি, যদিও সেটি কম।
ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়ার তৈরি ‘নর্ড স্ট্রিম-২’ পাইপলাইন বন্ধ থাকার ফলে ইউরোপের তীব্র জ্বালানি সংকট নিরসনে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর চাপ অনেকটা বেড়েছে। এমন চাপের মুখে জ্বালানি সরবরাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশও কিছুটা বিপাকে পড়েছে বলে মনে করা হয়।
কৃষি প্রধান বাংলাদেশে চাষাবাদের অন্যতম অংশীদার সার, যার বৃহৎ অংশের জোগান দেওয়া হয় আমদানির মাধ্যমে। এক্ষেত্রে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি, যার প্রভাব সরাসরি প্রান্তিক কৃষিতে গিয়ে পড়ছে।
এক সময় কৃষিনির্ভর অর্থনীতির কথা বলা হলেও সেই বাস্তবতা এখন নেই। আমরা আমদানি নির্ভর দেশ হয়ে পড়েছি। এটি ভবিষ্যতে অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে। এই ব্যাপারে এখন থেকেই নীতিগত কৌশল গ্রহণ শুরু করতে হবে। অপরিহার্য খাদ্যপণ্যগুলোর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশ নিজেদেরই উৎপাদন করতে হবে।
আরও পড়ুন : মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত : সবার জীবন যায় যায়
ভূমির পরিমাণ কম হলেও এখনো এখানে মাটির উর্বরতা ভালো, ভালো বৃষ্টিপাত হয়, পানির জোগানও ভালো; ফলে উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ আছে। সেটি যাতে কোনোভাবেই কমে না যায়।
একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, কৃষিতে কিন্তু খরচ বেড়ে যাচ্ছে। কৃষি উপকরণের দাম বেড়ে যাচ্ছে। কৃষি শ্রমিকও এখন আর আগের মতো সহজলভ্য নয়। নতুন নতুন কৃষিপ্রযুক্তি আসছে, সেগুলোর সঙ্গে কৃষককে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে, সেগুলো কিনতে সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে।
এক সময় কৃষিনির্ভর অর্থনীতির কথা বলা হলেও সেই বাস্তবতা এখন নেই। আমরা আমদানি নির্ভর দেশ হয়ে পড়েছি। এটি ভবিষ্যতে অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে।
অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাবের বিষয়টি বারবার আলোচনায় আসে। বড় বড় কোম্পানি বা গোষ্ঠীও এখানে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে, আমদানি খাতও তারা নিয়ন্ত্রণ করছে। পণ্যের দাম নির্ধারণে তাদের স্বার্থ বড় হয়ে উঠছে। এতে ভোক্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে মার্কেট মেকানিজম বা ইকোনমিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট দিয়ে।
পণ্য আমদানির বিষয়টি ভূরাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। ভূরাজনীতির সঙ্গে বৈশ্বিক খাদ্যবাজার জড়িয়ে পড়াটা বিপজ্জনক। মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তেমনটাই আমরা দেখতে পারছি। এখানে এক দেশ আরেক দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে।
কূটনৈতিকভাবে খাদ্য আমদানি-রপ্তানিতে নানা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বাধা আসছে। এখানে অনেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানও জড়িয়ে পড়েছে, তারা কিছু রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের মতো ছোট দেশগুলোর জন্য নানা ঝুঁকি তৈরি হবে। ইতিমধ্যে হয়েছেও। ফলে খাদ্য আমদানিতে আমাদের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
আরও পড়ুন : আসুন মুড়ি খাই!
মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কবলে পড়া, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কার অবস্থা কতটা নাজুক এটা জানে সবাই। পাকিস্তান, ভুটানও খুব বেশি শক্ত অবস্থানে নেই আপাতত।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার, বেসরকারি খাত, উৎপাদক এবং ভোক্তাদের সম্মিলিতভাবে দায়িত্ব নিতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা সবসময়ই একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। প্রাকৃতিক সম্পদের স্বল্পতা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিশ্বের কিছু অংশে সংঘাতের কারণে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য ও ক্ষুধা বাড়ছে।
সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্ন হওয়ায় খাদ্যের দামও বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদসহ সংশ্লিষ্ট সব খাতে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করতে হবে।
খাদ্য নিরাপত্তা সবসময়ই একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। প্রাকৃতিক সম্পদের স্বল্পতা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিশ্বের কিছু অংশে সংঘাতের কারণে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য ও ক্ষুধা বাড়ছে।
পাশাপাশি কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন সম্পর্কিত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা জোরদার করতে হবে। গবেষণার চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে, তা সমাধানে একটি সামগ্রিক পদ্ধতি বের করতে হবে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন যে, বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন ও মজুতের ক্ষেত্রে বড় সংকট হবে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে খাদ্যসহ সব জিনিসের দাম বাড়ায় নিম্ন ও নিম্নমধ্যম আয়ের মানুষের জন্য কিছুটা সংকট তৈরি হবে। বড় ধরনের না হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামান্য পুষ্টিহীনতা তৈরি হতে পারে।
সরকারের শীর্ষ মহলের আশঙ্কা, বোরো ও আউশে ফলন কম হওয়ায় ২০২২ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে চালের দাম বাড়তে পারে। তাই বাড়তি মজুত গড়তে বিশ্ব অর্থনীতির চলমান সংকটের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে অতিরিক্ত খাদ্য আমদানির নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরই মধ্যে পাঁচটি দেশ থেকে খাদ্য আমদানির চুক্তি হয়েছে।
আরও পড়ুন : ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই’
পরিশেষে বলা যায় এবারের বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে খাদ্যকে এখন আর শুধু খাদ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে না, এখন এটি একটি অস্ত্র হয়ে উঠেছে, আমাদের প্রস্তুতি দরকার। কোনোভাবেই খাদ্যসংকট পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া যাবে না। এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে একই জমিতে একাধিক ফসল উৎপাদন করতে হবে।
পতিত জমিকেও ব্যবহারোপযোগী করে নিতে হবে, যাতে অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন করা যায়। আমাদের ফুড ডাইভার্সিটি বা খাদ্যে বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। সবাইকে মিতব্যয়ী হতে হবে।
সর্বোপরি, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতায় আমরা সম্ভাব্য বৈশ্বিক খাদ্যসংকট পরিস্থিতি থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারব এবং ফুড সভরেনটি বা খাদ্য সার্বভৌমত্ব/খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হব।
ড. আনোয়ার খসরু পারভেজ ।। গবেষক ও অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
khasru73@juniv.edu