মাহসা আমিনি : নারী মুক্তির নতুন অধ্যায়
১৮৫২ সালে ৩৫ বছর বয়সী নারীবাদী ইরানি অ্যাক্টিভিস্ট তাহিরিহ ঘোরাতোলেইন (Tahirih Ghoratolein)-কে হত্যা করা হয় ইরানে। তিনি ব্যাপটিজমে বিশ্বাসী এবং হিজাব বিরোধী ছিলেন। হত্যার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বলে গেছেন, তোমরা আমাকে হয়তো অতি দ্রুত হত্যা করবে কিন্তু নারী শক্তির শক্ত বন্ধনকে কখনো হত্যা করতে পারবে না।
তাকে হত্যা করার ঠিক ১৭০ বছর পর সেই ইরানেই ২২ বছর বয়সী কুর্দিশ তরুণী মাহসা আমিনি (Mahsa Amini)-কে মোরাল পুলিশেরা শরিয়াহ এবং সরকারি মোতাবেক হিজাব না থাকায় গ্রেফতার করে। দুইদিন পর পুলিশ হেফাজতে তার মৃত্যু হয়।
বিজ্ঞাপন
মাহসা আমিনিকে গ্রেফতার করার পর তার ভাই জানান, তারা তেহরানের জীবনযাপন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। তারা কুর্দিশ শহরের সাথে যুক্ত ইরানের সীমানায় অবস্থিত সাক্কাজে এসেছিলেন বেড়াতে। সেখান থেকেই তার বোনকে হাজতে নেওয়া হয়। অপমানিত এবং অত্যাচারিত মাহসা প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতাল নেওয়ার দুইদিন পর তার মৃত্যু হয়।
আরও পড়ুন : নারীর প্রতি বুলি আর গালি
মাহসা আমিন, যার কুর্দিশ নাম ছিল জিনা অর্থাৎ জীবন। যদিও তিনি পৃথিবীর কাছে মাহসা আমিনি নামেই বহুল আলোচিত হয়ে গেলেন। তার মৃত্যুর খবর কুর্দিশে ছড়িয়ে পড়লে তা বিস্তারিত আসতে আসতে ইরান এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ প্রতিবাদে জ্বলে উঠতে শুরু করে। প্রতিবাদীরা সরব হয়ে ওঠে কুর্দিশ স্লোগান—জিন, জিয়ান, আজাদি—নারী, জীবন, মুক্তির আহ্বানে।
ইরান একটি গণতন্ত্র বিরোধী দেশ, যেখানে নিয়মনীতি তৈরি করা হয়েছে অত্যন্ত রূঢ় উপায়ে। সেখানকার যেকোনো নাগরিক তা পুরুষ বা নারী হোক রাষ্ট্রের নিয়ম বিরোধী হলে তার বা তাদের ভাগ্যে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে।
ইরান একটি গণতন্ত্র বিরোধী দেশ, যেখানে নিয়মনীতি তৈরি করা হয়েছে অত্যন্ত রূঢ় উপায়ে। সেখানকার যেকোনো নাগরিক তা পুরুষ বা নারী হোক রাষ্ট্রের নিয়ম বিরোধী হলে তার বা তাদের ভাগ্যে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে....
বিশেষ করে ইরানে অবস্থিত কুর্দিশিয়ান এবং নারীদের অবস্থান ভয়ানক নাজুক। এমনকি ইরানে বসবাসকারী কেউ নিজস্ব কুর্দিশ নাম ব্যবহারে বিধিনিষেধ রয়েছে।
ইরানে বসবাসকারী কুর্দিশ নাগরিকদের ইরানি নামে সব ধরনের বৈধ কাগজ থাকতে হয় এবং ইরানের মোরাল পুলিশ সেইসব শক্ত নিয়মের রক্ষক হিসেবে কাজ করে থাকে। অনেকের মতে মাহসা আমিনি শুধু হিজাবের জন্য নয় একজন কুর্দিশিয়ান এবং নারী হওয়ায় তার জীবন কেড়ে নেওয়া হয়েছে অকালেই।
আরও পড়ুন : মুক্তনীলের মুক্ত বিহঙ্গ
মাহসা আমিনির মৃত্যু হওয়ার পর থেকে চলমান আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে ১৫০টি শহরে সমাবেশ হয়েছে এবং বিক্ষোভ চলছে।
‘একনায়কের পতন চাই’ আর ‘নারী, জীবন, মুক্তি’ স্লোগানে জ্বলছে ইরানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের তরুণ প্রজন্ম। অথচ ইরানে চলমান সরকারবিরোধী বিক্ষোভের নেপথ্যে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল জড়িত বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি।
পুলিশের হেফাজতে থাকা কুর্দিশ তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরুর পর এই বিষয়ে কথা বলেন খামেনি। ০৩ অক্টোবর ২০২২, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর ক্যাডেটদের গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে খামেনি বলেন, মাহসা আমিনির মৃত্যুতে আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রমাণ ছাড়াই কিছু মানুষ হিজাব খুলে ফেলেছে, পবিত্র কোরআন পুড়িয়েছে এবং মসজিদে ও গাড়িতে আগুন লাগিয়েছে।
আমি পরিষ্কারভাবে বলছি, এসব দাঙ্গা এবং অস্থিতিশীলতা আমেরিকা ও দখলদার ভুয়া জায়নবাদী রাষ্ট্রের কারসাজি। দেশে-বিদেশে তাদের ভাড়াটে এজেন্টরা কিছু ইরানির সহায়তায় এসব করছে।
আরও পড়ুন : বাল্যবিবাহ উপসর্গ মাত্র, মূল ব্যাধি পিতৃতন্ত্র
খামেনির বক্তব্যের পরপরই ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদসংস্থা ইরনা (IRNA)-এর বরাতে বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানান, ইরানে পুলিশি হেফাজতে নিহত কুর্দিশ তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যু শরীরের কোনো আঘাতের ফলে হয়নি বলে এক সব পরীক্ষকের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শরীরের বেশ কয়েকটি অঙ্গ অকেজো হয়ে যাওয়ায় মস্তিষ্কে অক্সিজেন স্বল্পতার ফলে মাহসা আমিনির মৃত্যু হয়। সব পরীক্ষকের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, আমিনির মৃত্যু মাথা ও শরীরে আঘাতের কারণে হয়নি।
অন্তর্নিহিত অসুখের ফলে তিনি পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন পড়ে যান। প্রথম কয়েক মুহূর্তে হৃদযন্ত্র ও শ্বাসযন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করতে না পারায় অক্সিজেনের গুরুতর অভাবের ফলে তার মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তিনি কোমায় চলে যান।
মাহসা আমিনি এখন একটি প্রতীকী নাম, এই আন্দোলন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা সকল নারীর মানুষ হয়ে জন্মানোর পরিচয় স্থাপনার সরব উপস্থাপন।
১৯৭৯ সালে খামেনি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য যেসব শরিয়ত মোতাবেক নিয়মনীতি বিধিনিষেধ তৈরি করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট অবস্থানে নারীরা রয়েছেন এবং মোরাল পুলিশিং এইসব বিধিনিষেধের মাধ্যমে সব থেকে বেশি নারীদের উপর অত্যাচার অবিচার করে থাকে।
মাহসা আমিনির মৃত্যু হয়তো এখনই অনেক সমস্যার সমাধান আনবে না তবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তরুণ প্রজন্ম নারী জীবনে মুক্তি আসুক, এই প্রত্যয়ে বিক্ষোভ করে যাচ্ছেন এবং তা অনেক বড় প্রাপ্তি।
আমি বিশ্বাস করি যে আন্দোলনের সময়সীমা যত দীর্ঘ তার সফলতার শেকড় ততটাই গভীর এবং ঘন। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষ এই প্রতিবাদে সংহতি জানাচ্ছেন নারী, জীবন, মুক্তি স্লোগানের সাথে।
আন্দোলন চলাকালীন চরম সংকটের মধ্যে বিক্ষোভ থেকে পাওয়া এটা প্রধান সফলতা। সম্প্রতি জানা যায়, ইরানে সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান চাইছে সেখানকার শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা।
আরও পড়ুন : টিপ পরছোস ক্যান : ব্যক্তি স্বাধীনতা কোথায়?
পোশাকের স্বাধীনতা চেয়ে শুরু হওয়া সরকারবিরোধী আন্দোলনে নতুন করে ইরানে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে তেহরানের শরীফ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির শিক্ষকেরা। তাদের আন্দোলন এবার খামেনির অপসারণের পথে চলবে।
তিনি বা তার সরকার হয়তো জানতেনই না যে তাদের বিরুদ্ধে আর কত দিক থেকে বা কত উপায়ে বিক্ষোভ শুরু হবে। এবার শুধু দেখার পালা, আরেক ধাপ সফলতার পথে এগিয়ে যাওয়া সাধারণ মানুষের দিকে।
বাংলাদেশের মানুষের কাছে আবারও বলতে চাই, মাহসা আমিনির জন্য আজ সারা বিশ্বে যে প্রতিবাদ করা হচ্ছে তা শুধুমাত্র হিজাব বিরোধী আন্দোলন নয়। এই আন্দোলন নারীর অস্তিত্ব, পরিচয় এবং স্বাধীন জীবনযাপন রক্ষায় বহু পুরোনো বিক্ষোভের নতুন বহিঃপ্রকাশ।
আরও পড়ুন : নারীর মানবাধিকার কতটা নিশ্চিত?
মাহসা আমিনি এখন একটি প্রতীকী নাম, এই আন্দোলন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা সকল নারীর মানুষ হয়ে জন্মানোর পরিচয় স্থাপনার সরব উপস্থাপন। এর সাথে সংহতি দেওয়ার অর্থ ইসলাম বিরোধীতা নয়, নারী জীবন মুক্ত হওয়ার জন্য কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে একযোগ হওয়া।
সর্বোপরি বিশ্বের যেকোনো উগ্র মৌলবাদী একনায়কতন্ত্র, স্বৈরাচার এবং অগণতান্ত্রিক নেতা এবং অনৈতিক নিয়মনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। সবাইকে মনে রাখতে হবে, যে যত অপমান আর উপেক্ষাই করা হোক না কেন মনুষ্য জন্মে নারীরা বারবার ফিরে আসবেন, সবার সাথে হাসবেনও।
শাওন মাহমুদ ।। শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা