উৎসবের সর্বজনীন অর্থনীতি
সামাজিক বা ধর্মীয় যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ উৎসবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটে। কেনাকাটা ও আনুষঙ্গিক ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারিত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রাণচাঞ্চল্যে ভরে ওঠে। উৎসবের কেনাকাটায় অর্থনীতি হয় মুখরিত।
ধর্মীয় ভাবাবেগ ছাড়াও উৎসব হাসিখুশি, আনন্দ, ভাতৃত্ব ও সম্প্রীতির সাথে অর্থনীতির জন্য ব্যাপক কল্যাণও বয়ে নিয়ে আসে। আর এই উৎসব যাদেরই হোক না কেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিশীলতায় তার প্রভাব কিন্তু সর্বজনীন।
বিজ্ঞাপন
পশ্চিমা অর্থনীতি যেমন বড়দিনের অপেক্ষায় থাকে। অথবা আরব অর্থনীতি যেমন হজের আগমনে তেজি হয়ে উঠে। ঠিক তেমনি, আমাদের দেশের অর্থনীতিও ঈদ, পহেলা বৈশাখ, দুর্গাপূজা ইত্যাদির জন্য প্রহর গুণতে থাকে।
এই দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় উৎসব দুর্গাপূজা। ঈদ ও পহেলা বৈশাখের মতো এত ব্যাপক না হলেও অর্থনীতিতে এর ভূমিকা খুব একটা কম নয়!
ধর্মীয় ভাবাবেগ ছাড়াও উৎসব হাসিখুশি, আনন্দ, ভাতৃত্ব ও সম্প্রীতির সাথে অর্থনীতির জন্য ব্যাপক কল্যাণও বয়ে নিয়ে আসে। আর এই উৎসব যাদেরই হোক না কেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিশীলতায় তার প্রভাব কিন্তু সর্বজনীন।
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, মহালয়ার মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। ১ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে ৫ অক্টোবর ২০২২ পর্যন্ত প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে পূজা শেষ হয়েছে।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্য মতে, এবার সারাদেশে ৩২ হাজার ১৬৮টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা উদযাপিত হয়েছে। ২০২১ সালে সারাদেশে পূজার সংখ্যা ছিল ৩২ হাজার ১১৮টি। ২০২১ সালের তুলনায় সারাদেশে এই বছরে ৫০টি অধিক মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকা মহানগরে এবার পূজার সংখ্যা ২৪১টি। ২০২১ সালের তুলনায় ৬টি বেশি।
বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে দুই বছর সীমিত পরিসরে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই বছর করোনার প্রাদুর্ভাব কমে আসায় আড়ম্বরপূর্ণভাবে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
দুর্গাপূজা আমাদের দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। তাই, এর আয়োজনও বেশ ব্যাপক। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নানা ধরনের অর্থনৈতিক উদ্যোগ। সেই উদ্যোগের সাথে নানাভাবে সংযুক্ত হয়ে পড়ে সমাজের বৃহত্তর সম্প্রদায়ও।
বিভিন্ন পেশার লোকবল ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এই উদ্যোগের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। ফলে, দুর্গাপূজা শুধু উৎসবের দিক থেকেই সর্বজনীনতা লাভ করে না, অর্থনৈতিক দিক থেকেও সর্বজনীনতা লাভ করে।
মণ্ডপ ও প্রতিমা তৈরি, প্রসাদ, পূজার যাবতীয় নৈবদ্য, ঢাক-ঢোল, সাউন্ড সিস্টেম, আলোকসজ্জা ইত্যাদির জন্য প্রতিটা পূজায় ব্যাপক অর্থ ব্যয় হয়। বেশিরভাগ পূজা কমিটি পূজা উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের নিমন্ত্রণ-পত্র, স্মরণিকা, ম্যাগাজিন প্রকাশ করে। ফলে, প্রকাশনা শিল্পও এর ফলে বাড়তি আয় করার সুযোগ পায়।
পূজা উপলক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্বস্তরের মানুষজনের বাড়তি কেনাকাটা অর্থনীতিতে বাড়তি গতি সঞ্চার করে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী সরকারি বা বেসরকারি চাকরিজীবীদের পূজার উৎসব ভাতায়ও বিভিন্ন ধরনের কেনাকাটা ও ভ্রমণে জাতীয় অর্থনীতিতেই যুক্ত হয়।
উৎসবকে কেন্দ্র করে হিন্দু ধর্মাবলম্বী গরিব-ধনী প্রায় সবার নতুন পোশাক, জুতা, স্যান্ডেল, নারীদের গয়না, প্রসাধনী সামগ্রী, সিঁদুর, আবির ইত্যাদি কেনাকাটায় অর্থনীতি বেশ জমে ওঠে।
পূজায় বড় একটি অর্থ লেনদেন হয় মিষ্টি, দই, প্রসাদ, খিচুড়ি, পাপড়, ফুচকাসহ নানা ধরনের খাবার-দাবার আয়োজনে। পূজামণ্ডপের সুবিধাজনক স্থানে অস্থায়ী দোকানিরা পূজা উপলক্ষে বাড়তি উপার্জনেরও সুযোগ পায়।
প্রতিটি মণ্ডপের পূজায় যদি গড়ে ৭৫ হাজার টাকা করে খরচ ধরা হয় তবে, শুধুমাত্র পূজা আয়জনের জন্যই সারাদেশে খরচ হয়েছে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। এই মুহূর্তে সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হচ্ছে যে, এবার পূজায় সব মিলিয়ে আর্থিক লেনদেন প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। এই বিপুল অর্থের লেনদেন জাতীয় অর্থনীতির গতিশীলতায় অবশ্যই বাড়তি জ্বালানি জোগাবে।
প্রতিটি উৎসবেরই একটি অর্থনৈতিক উপযোগিতা রয়েছে। প্রতিটি উৎসবই আমাদের মন ও পরিবেশ আলোকিত করার সাথে সাথে অর্থনীতিকেও আলোকিত করে....
২০২১ সালে কুমিল্লাসহ কয়েকটি জেলায় বিভিন্ন মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যা খুবই দুঃখজনক। এবার শারদীয় দুর্গা উৎসব যাতে নির্বিঘ্নে ঘটতে পারে তার জন্য সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা আগাম পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে।
কোনো স্বার্থান্বেষী মহল যাতে দেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য বিনষ্ট করতে না পারে তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার পাশাপাশি পূজা কমিটি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট অন্য সবাইকেও সতর্ক ও সচেষ্ট থাকতে হয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, প্রতিটি উৎসবেরই একটি অর্থনৈতিক উপযোগিতা রয়েছে। প্রতিটি উৎসবই আমাদের মন ও পরিবেশ আলোকিত করার সাথে সাথে অর্থনীতিকেও আলোকিত করে যা থেকে সবাই কোনো না কোনোভাবে উপকৃত হয়।
নীলাঞ্জন কুমার সাহা ।। ডিন, ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস স্টাডিজ ও সহযোগী অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়