মহররম থেকে দুর্গোৎসব : সম্মিলন ও শক্তি
ফেলে আসা ছোটবেলা মাঝে মধ্যেই দুয়ারে এসে কড়া নাড়ে। সেদিন মনে পড়ল মহররমের কথা।
শেরপুর—আমাদের সেই মফস্বলের গল্প। গোধূলির লাল আকাশ দেখে আমরা বলতাম, হাসান-হোসেনের রক্ত। দাদি বলতেন কারবালার গল্প।
বিজ্ঞাপন
গ্রামের যে স্কুলে আমি পড়তাম তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট একটা খাল। খালের পাশে সবুজ ঘাসের চত্বরে বসত মহররমের মেলা। চিনির সাজ, বাতাসা, বাদাম তক্তি, মাটির ঘোড়া, টমটম গাড়ি, পুতুল, হাড়ি-পাতিলের পসরা বসত। সেই মেলায় ঘুরপাক খেত লাল-সবুজ নিশানওয়ালা মিছিল। লম্বা বাঁশের মাথায় দোল খাওয়া নিশানের দিকে তাকিয়ে থাকতাম আমরা। বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে মিছিলগুলো যেত।
মিছিলের আগে পিছে থাকত মর্সিয়ার বিভিন্ন দল। দলগুলো কারবালার যুদ্ধ নিয়ে শোকাত্মক গান-গল্প বয়ান করত। তার সঙ্গে দেখাত লাঠি খেলা, বেত খেলা, তলোয়ারের খেলা। আমরা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে গোল হয়ে সেই খেলা দেখতাম।
মহররম ফুরিয়ে যেতে না যেতেই শরতের বাতাসে ভাসত দুর্গাপূজার গন্ধ। জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে যেত, এবার মা ঘোড়ায় চড়ে আসবেন, নাকি নৌকায় করে আসবেন! ঘোড়ায় চড়ে এলে শুকনো থাকবে, আর নৌকায় এলে প্রচুর বৃষ্টি হবে; আমরা এসব শুনতাম।
আরও পড়ুন : শারদীয় দুর্গোৎসব : সম্প্রীতির উৎসব
কিনু সরকার ছিলেন আমাদের পাড়ার পুরোনো কারিগর। তিনিই প্রতিমা বানাতেন। খিটখিটে মেজাজের বুড়ো মানুষ। মাটির হাড়ি-পাতিল, বাসন কোসন বানাতেন। আর প্রতি বছর বানাতেন পাড়ার প্রতিমা।
ছোট্ট একটা কারখানা ছিল তার। এলাকার লোকজনের প্রয়োজন মিটে যেত। তার কাছেই প্রথম দেখেছিলাম মাটি দিয়ে গড়া এত সুন্দর করে জিনিস। তার কাছেই জেনেছিলাম রঙের আঁচড় দিয়ে তৈরি করা যায় এত সুন্দর মানুষের মুখ!
সেই আশি-নব্বইয়ের দশকে আমাদের পাড়ায় উৎসবের বন্যা বয়ে যেত। আমাদের কাছে দুর্গাপূজা মানেই ছিল দূরদূরান্ত থেকে বাড়িতে আত্মীয়স্বজন আসা, বাড়ির রাস্তায় মানুষের ঢল, মেলা, লাল-সবুজ-হলুদ বাতির সজ্জা, মাইকে বাজানো জনপ্রিয় হিন্দি-বাংলা গান।
মহররম ফুরিয়ে যেতে না যেতেই শরতের বাতাসে ভাসত দুর্গাপূজার গন্ধ। জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে যেত, এবার মা ঘোড়ায় চড়ে আসবেন, নাকি নৌকায় করে আসবেন!
সারা বছর ধরে আমরা এই উৎসবের জন্য অপেক্ষা করতাম। আমাদের শিশুমনে ধর্ম কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। হিন্দু-মুসলমান বন্ধুরা মিলে প্রতিমা দেখতে বের হতাম। আমাদের সেই শহরের গলির পর গলিতে ছিল মায়াময় প্রতিমার মুখ। শহরের সীমানা ছাড়িয়ে আমরা চলে যেতাম কোনো দূর গ্রামে।
হয়তো সেই গ্রামে নেই বিদ্যুতের উজ্জ্বল আলো। তবু সব আয়োজন যেন আহ্বান করত। গোয়ালপট্টির বাতাসে ভাসত জিলাপি আর আমিত্তি ভাজার গন্ধ। পেটপুরে দই-মিষ্টি খেয়ে দে ছুট...।
এরই ফাঁকে আমরা হয়তো সিনেমা দেখতাম। আমাদের শহরে ছয়টা-সাতটা সিনেমা হল ছিল। পূজা উপলক্ষে সব হলে ছবির ব্যবসা ছিল জমজমাট। টিকিট পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়ত।
নবমীর রাত থেকে আমাদের মন খারাপ শুরু হয়ে যেত। পরদিন দশমী। ঢাকের শব্দে বাজত বিসর্জনের ব্যথা। দশমীর দিন সকাল থেকেই মনে হতো চারদিকে মনমরা ভাব। আমাদের কান্না পেত। দুপুর তিনটার দিকে মণ্ডপ থেকে প্রতিমা বের করা হতো। তার আগেই আমরা খাওয়াদাওয়া শেষ করে প্রস্তুত থাকতাম।
আরও পড়ুন : এই দুঃখ কোথায় রাখি?
আমাদের পাশের বাড়ির কাকিমা প্রতিমা বিসর্জনের এই সময়টায় খুব কাঁদতেন। তার কান্নায় আমাদের মন আরও ভারী হয়ে উঠত। মনে হতো সত্যি সত্যিই কোনো মেয়ে বাবার বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে চিরকালের জন্য। কে জানে, কাকিমা হয়তো নিজের ছেড়ে আসা বাড়ির কথা ভেবেই কাঁদতেন।
শহরের মাঝখানে বড় একটা দিঘি ছিল। তার চারদিকে একে একে জড়ো হতো প্রতিমা। অসংখ্য ঢাক ও কাঁসরের শব্দের ভেতর জোড়ায় জোড়ায় মিশে থাকত আনন্দ ও বিষণ্ণতা। সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্তে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হতো প্রতিমাগুলো। তারপর যে যার মতো ফিরে যাওয়ার পালা।
সুনশান নীরবতা নেমে আসত আমাদের পাড়ায়। ঢাকের শব্দ নেই, ধূপ-ধুনোর গন্ধ নেই, মানুষের পায়ের শব্দ নেই। বিজন নিস্তব্ধতায় ডেকে উঠত দু-একটা কুকুর। তাদের কণ্ঠও যেন করুণ আর্তিতে ঢাকা। এইভাবে ফুরিয়ে যেত আমাদের উৎসব। মহররমের শোক, পূজার উচ্ছ্বাসকে পাশাপাশি মিশিয়ে কোনো একদিন বেঁচেবর্তে ছিলাম আমরা।
কিন্তু আজ? যেন অনেক যুগান্ত ঘটে গেছে। কয়েক বছর আগে দুর্গাপূজা নিয়ে আমি ছোট্ট একটা লেখা লিখেছিলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। স্মৃতিকাতর সেই লেখাটি পড়ে আমার এক সহৃদয় অগ্রজ প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক ভাষায় জানালেন, আমি কেন ওয়াজ নিয়ে লিখি না, আমি কি শৈশবের ওয়াজের স্মৃতি নিয়ে লিখতে পারি না? নিশ্চয়ই পারি। কিন্তু আমাকেই পারতে হবে কেন!
আরও পড়ুন : ধর্ম যার যার থাকুক, উৎসব হোক সবার
কাউকে কোনো কিছু ‘করাতে’ কিংবা ‘পারাতে’ চাওয়াটাই নিঃসংশয়ভাবে মতামত চাপিয়ে দেওয়া। আমি তাই সচেতনভাবে তর্ক এড়িয়ে গিয়েছিলাম। আমার এই অগ্রজের প্রিয় কবি ছিল সুকান্ত ভট্টাচার্য। বিশ্বাস ও কৃত্যের ভিন্নতা নিয়ে তাকে কখনো আক্রমণাত্মক হতে দেখিনি। সেই তিনিই আঘাত করলেন অসহিষ্ণু ভাষায়।
এই বছর পাঁচেক আগের কিংবা তারও আগের কথা; আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে হোলি উৎসব চলছিল। মূলত শিক্ষার্থীরাই ছিল এর উদ্যোক্তা। একটা টিভি চ্যানেলের প্রতিবেদক—যিনি তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীও, ছেলেমেয়েদের সমবেত অংশগ্রহণের সমালোচনায় তিনি লিখলেন, ‘বিয়ে যার যার, বউ সবার।’ আসলে এটি ছিল ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’—এই বিবৃতির ব্যঙ্গ রূপ।
সারা বছর আমরা এই উৎসবের জন্য অপেক্ষা করতাম। আমাদের শিশুমনে ধর্ম কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। হিন্দু-মুসলমান বন্ধুরা মিলে প্রতিমা দেখতে বের হতাম। আমাদের সেই শহরের গলির পর গলিতে ছিল মায়াময় প্রতিমার মুখ।
তার এবং তার সমমনা কয়েকজনের বক্তব্য ছিল, ‘আমাদের ধর্মে এসব নিষিদ্ধ। আমরা কেন এভাবে এসব পালন করব।’ আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই ‘আমরা’টা কারা? ছেলেটি জবাব দিয়েছিল, আমরা মুসলমান। আমাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম।
পাল্টা প্রশ্ন তুলেছিলাম, তুমি নিশ্চিত হোলিখেলায় সব মুসলমান ছিল? রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বলে অন্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের জনগণ তাদের উৎসব পালন করবে না? আরও বললাম, তুমি কোনটিকে সমস্যা হিসেবে দেখছ? ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে অংশগ্রহণ করাকে নাকি ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’—এই বিবৃতিকে?
ছেলেটি বেশ কিছুক্ষণ এলোমেলো জবাব দেওয়ার চেষ্টা করল এবং ক্রমশ বেরিয়ে এলো তার অবচেতনে থাকা সাম্প্রদায়িক ঘৃণা, লৈঙ্গিক আধিপত্য। বোঝা গেল, বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে সে কল্পনা করছে মুসলমান ও পুরুষের ইচ্ছাধীন রাষ্ট্র হিসেবে। আমি আর কথা বাড়াইনি।
আরও পড়ুন : মিলেছি প্রাণের উৎসবে
এই সেদিন আমার এক শিক্ষার্থী উৎসব বিষয়ে একটি অ্যাসাইনমেন্ট লেখার প্রস্তাব পেশ করল। আমি ওকে ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’—এই ধারণা ব্যাখ্যা করার কাজ দিলাম।
শুরুতে সে ইতস্তত করলেও সম্মত হলো। যদিও তখন বুঝতে পারিনি ইতস্ততার কারণ। উপস্থাপনার দিন সে খুব অগোছালো ভঙ্গিতে কথা বলছিল। আমাদের উৎসব বলতে সে বোঝাচ্ছিল পহেলা বৈশাখ আর দুটি ঈদ ইত্যাদি।
আমি বললাম, আর কোনো উৎসব নেই? সে বলল, কিন্তু সেগুলো তো আমাদের উৎসব নয়। আমি বললাম, ‘আমরা’ কারা? বলল, আমরা মুসলমান। বললাম, বাংলাদেশ রাষ্ট্রে কেবল মুসলমানরা বাস করে? বলল, না। বললাম, তাহলে? সে বলল, আমি ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’—এই মত বিশ্বাস করি না। আমরা যদি তাদের উৎসবে যাই, তাহলে আমাদের ইমান নষ্ট হয়ে যাবে। ওরা তো কোরবানির ঈদে আমাদের অনুষ্ঠানে আসে না, আমরা কেন যাব তাদের অনুষ্ঠানে।
আমি বললাম, তোমাকে পাঠা বলি বা পূজা করতে আহ্বান জানিয়েছে কেউ? যেতে বাধ্য করেছে কেউ? বলল, না। বললাম, তুমি কি চাও কোরবানি দেওয়ার সময় কোনো হিন্দু, খ্রিস্টান কিংবা বৌদ্ধ বন্ধু উপস্থিত থাকুক? আমার শিক্ষার্থী চুপ থাকলেন।
আমি বললাম, আমরা কি জানি না, প্রত্যেকটি উৎসবের কিছু সীমা আছে? কখন কোথায় কোন পর্বে কাকে নিমন্ত্রণ করা যাবে বা যাবে না, তা সম্পর্কে আমরা কি অবহিত নই? বললাম, তুমি ইমান নষ্ট হওয়ার কথা বললে, সে অর্থে একসঙ্গে এই শ্রেণিকক্ষে ছেলেমেয়েরা বসে পড়ছ, এতে কি ইমান নষ্ট হচ্ছে? কিংবা ক্যান্টিনে খাচ্ছ একসঙ্গে বসে, ট্যুরে যাচ্ছ পাশাপাশি বসে, এতে কি ইমান রক্ষিত হচ্ছে?
শিক্ষার্থী দিশেহারা হয়ে পড়ল। আমি বললাম, একটু চিন্তা করে দেখ তো... ধর্ম, সংস্কৃতি, ধর্মীয় আচার আলাদা হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্র কি আমাদের একটি ঐক্যে আঁকড়ে রাখতে চায় না? তা যদি নাও হয়, নাগরিক হিসেবে তোমার কি মনে হয় না, একটা রাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে সবার...
আরও পড়ুন : রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!
আমার আরেকজন শিক্ষার্থীর উপস্থাপনার বিষয় ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন চ্যানেলে প্রদর্শিত তুর্কি সিরিজ। শিক্ষার্থীর বক্তব্য হলো এসব সিরিজ দেখে মুসলিম জাতি হিসেবে সে নিজের ইতিহাস খুঁজে পায়। তার বক্তব্য আমাদের পূর্বপুরুষেরা মুসলমান জাতি।
উপস্থাপনা শেষে আমি বললাম, আমাদের দেশের বাংলাভাষী বিরাট সংখ্যক মানুষ তো বাঙালি। সে বলল, আমি আগে মুসলমান, তারপর বাঙালি। বললাম, কেন? সে বলল, আমি আগে মুসলমান হয়ে জন্মগ্রহণ করেছি; তারপর বাঙালি হয়েছি। বললাম, তোমার জন্ম কোথায়? বলল, বাংলাদেশে। সে বলল, আমাদের পূর্বপুরুষ তুর্কি। বললাম, তোমার পূর্বপ্রজন্ম কি তুর্কি? ‘আমাদের’ বলতে কী বোঝাচ্ছ? বলল, এই দেশের মুসলমান। বললাম, তুর্কিরা কি স্বীকার করে বাংলাদেশের মুসলমানরা তাদের উত্তরপুরুষ?
সময়ের সাথে সাথে কণ্ঠস্বর বদলে গেছে। ‘আমাদের’ ধর্ম, সংস্কৃতি, জাতীয় পরিচয় বিভ্রান্তির কানাগলিতে ঢুকে পড়েছে। বাঙালি বনাম বাংলাদেশির তর্ক এক সময় জোরালো হয়ে উঠেছিল। সেই তর্ক এখন গিয়ে ঠেকেছে ধর্ম ও জাতি পরিচয়ের খোপে।
ইরান-আরব-আফগান অঞ্চলের মুসলমানদের সঙ্গে বাংলাদেশের মুসলমানদের কী সম্পর্ক তাহলে? তারা কি এদেশের মুসলমানদের খাঁটি মুসলমান হিসেবে স্বীকার করে? ও কিছু বলার আগেই, বাকি শিক্ষার্থীরা বলল, না, আরবরা আমাদের দেশের মুসলমানদের ‘মিসকিন’ বলে। আরবরা আবার শিয়াদের সহ্য করতে পারে না।
আমি বললাম, আরবরা কি আগে আরব, নাকি মুসলমান? বলল, মুসলমান। বললাম, ইসলাম কায়েমের আগে ‘আরব’রা কী হিসেবে জন্ম গ্রহণ করেছিল? শিক্ষার্থী দ্বিধায় পড়ে গেল। আমি নিজেও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লাম, ক্লাসে এইসব আলোচনার অনুমোদন আছে কি, নেই; নাকি জেলে যেতে হবে। সমকালীন ফেসবুকীয় শৌখিন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা আপত্তি করেন যদি!
আমি ভাবলাম, সময়ের সাথে সাথে কণ্ঠস্বর বদলে গেছে। ‘আমাদের’ ধর্ম, সংস্কৃতি, জাতীয় পরিচয় বিভ্রান্তির কানাগলিতে ঢুকে পড়েছে। বাঙালি বনাম বাংলাদেশির তর্ক এক সময় জোরালো হয়ে উঠেছিল। সেই তর্ক এখন গিয়ে ঠেকেছে ধর্ম ও জাতি পরিচয়ের খোপে।
আরও পড়ুন : ফিরে আসুক সম্প্রীতি
সম্প্রতি কেউ কেউ আবার তুলে এনেছেন সাবেকী প্রস্তাবনা, বাঙালি মুসলমান একটি স্বতন্ত্র জাতি। ১৯৪৭ সালের আগে যেমন বলা হতো ভারতবর্ষীয় মুসলমান একটি স্বতন্ত্র জাতি। অনেক অনেক বছর পর আবারও সংস্কৃতির বিভিন্ন অংশ থেকে উঠে আসছে একই রকম আওয়াজ। এই আওয়াজ উৎসবের নানা রঙের আলোকে নিভিয়ে দিতে চায়।
উৎসব মানে তো কেবল ঈদ বা পহেলা বৈশাখ নয়; উৎসব মানে দুর্গাপূজা, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, বড়দিন, ওয়ানগালা, বিজু, সাংগ্রাই। উৎসব মানে তো এই নয় যে, আপনি আমার ধর্মীয় কৃত্যেও অংশ নিন; এই আহ্বান কেউ করে না নিশ্চয়ই মুসলমান / হিন্দু / বৌদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও আপনি বড়দিনের প্রার্থনায় অংশ নিন।
মুসলমান / খ্রিস্টান / বৌদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও আপনি অংশ নিন পূজার মন্ত্রে। অন্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের স্বজন / পরিজন / পড়শিরা আপনাকে আহ্বান জানায় এই বলে যে, নিমন্ত্রণ রইল, বেড়াতে আসবেন। কিন্তু আপনি যখন উৎসবের বিশ্বাস নির্ভর ধর্মীয় আচার বা কৃত্যের সঙ্গে সামাজিকতার অংশটুকু গুলিয়ে ফেলেন এবং ভাবতে থাকেন ওরা ‘অন্য ধর্ম’র অতএব প্রত্যাখ্যান যোগ্য, তখন আপনি নিজেকে তার থেকে দূরে সরিয়ে নেন, তাকে আপনার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেন। তার অর্থ হলো, উৎসবের আনন্দের শক্তি আপনি উপলব্ধি করতে পারছেন না।
আরও পড়ুন : অর্থনীতি যখন উৎসবের অংশ
আমার কাছে উৎসব হলো সম্পর্ক, সমন্বয় ও সম্মিলন; আমরা যে অঞ্চল ও রাষ্ট্রখণ্ডে বসবাস করছি তার ধর্ম, সম্প্রদায় ও সংস্কৃতির ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য মেনে নিতে হবে। ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের মালা গাঁথতে হবে সহাবস্থান ও সহৃদয়তার সুতো দিয়ে। মনে রাখতে হবে, মানুষের পরিচয় স্থান, কাল ও পরিস্থিতি ভেদে ভিন্ন। অনন্ত সম্ভাবনাময় এক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ক্রম নির্মিত হয় মানুষের পরিচয়।
বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা যখন রাষ্ট্রীয় পরিচয় নিয়ে নিজেকে প্রকাশ করি, সমাজের সদস্য হিসেবে যখন আমরা নিজেকে পরিচিত করি তখন অবশ্যই রাষ্ট্র / সমাজের বহুজন জাতি, সংস্কৃতি নিজের পরিচয়েরই অংশ মনে করা যৌক্তিক; পরিচয়ের একটি অংশ, অন্য একটি অংশকে দুর্বল করে দেয় না। শারদীয় দুর্গোৎসবে আমার প্রত্যাশা উৎসব হোক শক্তি, সাহস ও সম্মিলনের আনন্দে ভরপুর এক আয়োজন।
সুমন সাজ্জাদ ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়