নৈতিকতা ও নেতৃত্ব
যে সৎ গুণ মানুষকে অন্যায় থেকে বিরত রাখে এবং ন্যায় কাজে নিয়োজিত হতে উদ্বুদ্ধ করে, তাকে নৈতিকতা বলে। নৈতিকতার উদ্ভব হয় মানব মনে। তাই নৈতিকতা মানুষের অভ্যন্তরীণ আচরণ তথা মনোজগত নিয়ন্ত্রণ করে।
মানুষের আত্মিক শক্তির সবচেয়ে বড় উৎস নৈতিকতা। যে মানুষ নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান, সে চারিত্রিক ও মানসিক দিক থেকেও সক্ষম। অর্থ-সম্পদ, বিত্ত-প্রতিপত্তি সাময়িক বিষয়, নৈতিকতা হলো অবিনশ্বর, যদি কেউ সেটা ধরে রাখতে পারে।
বিজ্ঞাপন
বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় পরিতাপ বিষয় হলো, আমাদের শিক্ষার্থীদের নৈতিক শক্তি ম্রিয়মাণ। তারা আজ অর্থ-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জনে বিভোর। অথচ, শিক্ষা জীবনে শিক্ষার্থীর একমাত্র কাজ তারা জ্ঞান অর্জন করা, নিত্যনতুন উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দেওয়া।
আরও পড়ুন : এই লজ্জা রাখব কোথায়?
তারা সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে নেতৃত্ব দেবে। তারা একেকজন হয়ে ওঠবে 'সোশ্যাল চেইঞ্জ-মেকার' তথা সমাজ পরিবর্তনের অনুঘটক। মানবিক কাজে তারা হবে অগ্রগামী। মানুষ তাদের অর্জন স্বাগত জানাতে ও বরণ করতে রাস্তার পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে। তাদের গর্বে নিজেদের গর্বিত মনে করবে। আত্মতৃপ্তি অনুভব করবে।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, মানুষ আজ শিক্ষার্থীদের কথা শুনলেই নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। কেন শিক্ষার্থীদের নিয়ে লজ্জিত হয়? কেন তাদের কথা শুনলে ক্ষেত্রবিশেষে ভীতসন্ত্রস্ত হতে হয়?
মানুষের আত্মিক শক্তির সবচেয়ে বড় উৎস নৈতিকতা। যে মানুষ নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান, সে চারিত্রিক ও মানসিক দিক থেকেও সক্ষম।
আমি মনে করি, মূল কারণ তাদের নৈতিক মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। তারা এখন নিজের নেতৃত্বের গুণে নেতৃত্ব দিতে আগ্রহী নয়, তারা পেশিশক্তি আর ভয়ভীতি প্রদর্শন করে নেতৃত্ব দিতে চায়। নেতৃত্ব নিতে চায়।
অথচ মনুষ্যত্ব বোধসম্পন্ন মানুষের নৈতিকতা ও নেতৃত্ব এমন হওয়ার কথা নয়। নেতৃত্ব হওয়ার কথা জ্ঞান ও নৈতিকতাভিত্তিক। অর্থাৎ, যার ভেতরে জ্ঞান ও নৈতিকতা বেশি থাকবে, সেই নেতৃত্ব দেবে।
মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব, তাই তারা সংঘবদ্ধ বসবাস করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এবং সেটা পছন্দ করে। কেউ যদি সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করতে পছন্দ নাও করেন, তারপরও উন্নয়ন কিংবা মানবিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য তাকে সংঘবদ্ধ হতে হয় কিংবা সংঘবদ্ধ কোনো কমিউনিটির সাথে চলতে হয়। আর সেটা হতে পারে পরিবার, সমাজ, স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আরও পড়ুন : সরকারি চাকরি কেন সবার প্রথম লক্ষ্য?
পরিবারে যিনি নেতৃত্ব প্রদান করেন, তিনি পরিবারের লিডার। যিনি সমাজের নেতৃত্ব প্রদান করেন, তিনি সমাজের লিডার। যিনি রাষ্ট্রের নেতৃত্ব প্রদান করেন, তিনি রাষ্ট্রের লিডার। ঠিক একইভাবে যিনি স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতৃত্ব প্রদান করেন, তিনি সেই প্রতিষ্ঠানের লিডার।
তবে 'লিডার' ও 'ম্যানেজার'-এর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ, 'লিডারশিপ' ও 'ম্যানেজমেন্ট' একই বিষয় নয়। 'ম্যানেজমেন্ট' হলো লিডারশিপের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অর্থাৎ, যে যত বড় ও কার্যকরী ম্যানেজার সে তত বড় ও কার্যকরী লিডার।
তবে, ম্যানেজমেন্ট ক্ষমতা থাকলেই কাউকে ভালো লিডার বলার সুযোগ নেই। ভালো লিডার হতে গেলে ম্যানেজমেন্ট দক্ষতার পাশাপাশি আরও কিছু গুণ থাকতে হবে। যেমন—
সবসময় নতুন কিছু জানা ও শেখার প্রতি স্পৃহা। নিজেকে প্রতি মুহূর্তে এগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা। কোনো কাজ সবার আগে শুরু করা। তবে কোনো কাজ সবার আগে শুরু করার অর্থ এই নয় যে, তিনিই সকলের সব কাজ করবেন। বরং, তিনি সবার আগে কাজটি শুরু করে দেখিয়ে দিবেন, কাজটি কীভাবে করতে হয়। যেন অন্যরা সুচারুরূপে কাজটি সম্পাদন করতে পারেন।
পরিবারে যিনি নেতৃত্ব প্রদান করেন, তিনি পরিবারের লিডার। যিনি সমাজের নেতৃত্ব প্রদান করেন, তিনি সমাজের লিডার। যিনি রাষ্ট্রের নেতৃত্ব প্রদান করেন, তিনি রাষ্ট্রের লিডার....
এছাড়াও লিডারশিপে সমস্যা সমাধানে পরিপক্বতা, টিমের সাথে কাজ করার ও টিমের কাজকে নেতৃত্ব প্রদানের সক্ষমতা, টিম মেম্বার ও অন্যদের সাথে যোগাযোগের দক্ষতা, যে কাজগুলো সম্পাদন করতে হবে, সেই কাজগুলো যথাসময়ে সম্পাদন করা, নেগোসিয়েশনের দক্ষতা, অন্যের মতামত ও পরামর্শকে সম্মান জানানোর ক্ষমতা থাকতে হয়।
তবে, এই গুণগুলোর বাইরে আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ গুণ হলো চারিত্রিক অনুকরণীয় গুণাবলি। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমাদের ছাত্র নেতৃত্বের মাঝে এই গুণ অনেকটাই অনুপস্থিত।
আরও পড়ুন : আমার সন্তান হত্যাকারী কেন?
কোনো নেতার মধ্যে চারিত্রিক অনুকরণীয় গুণাবলি না থাকলে তার টিমের অন্য সদস্যরা মন থেকে তাদের আদেশ-নির্দেশ পালন করতে চাইবে না। অর্থাৎ, তারা ভেতরে ভেতরে তাদের নেতাকে বা নেতৃত্বকে ঘৃণাই করবে এবং সুযোগ পেলে সেই নেতা ও নেতৃত্বকে অপমান-অপদস্থ করতে পিছ পা হবে না।
তাই নেতৃত্ব এবং নেতার মাঝে সততা ও চারিত্রিক অনুকরণীয় গুণাবলি না থাকলে তাদের হাতে কোনো ক্ষমতা থাকে না, তখন তাদের আর কেউ মনেও রাখে না, সম্মানও করে না।
তবে, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, নেতৃত্ব অর্জনের প্রকৃত সময় হলো ছাত্রজীবন। যে জীবনে শিক্ষার অনেক বড় সুযোগ রয়েছে, চারিত্রিক অনুকরণীয় গুণাবলি অর্জন এবং তা মেলে ধরার সুযোগ রয়েছে। আমাদের প্রকৃত লিডারশিপ হোক জ্ঞানভিত্তিক ও চারিত্রিক অনুকরণীয় গুণাবলিভিত্তিক।
গাজী মিজানুর রহমান ।। ৩৫তম বিসিএস ক্যাডার; লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার