স্বর্ণলতার ভিড়ে নির্বাক প্রকৃত নেতারা
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন আর কর্মী থেকে নেতার সৃষ্টি হয় না। একটা দলের নীতি আদর্শ আর ইতিহাস জেনে রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠা সময়সাপেক্ষ বিষয়। তবে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে সহজ কাজ হলো রাজনৈতিক নেতা কর্মী হওয়া। আর রাজনীতি করতে পারলে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে সহজে।
কাজের দুটি পন্থা। এক, এলাকার রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের সান্নিধ্য এবং দ্বিতীয় হলো নিজের অর্থ বা পেশিশক্তি দিয়ে রাজনৈতিক লেবাস পরা। এই দুই কাজ করতে হবে অবশ্যই সরকারি দলের সাথে। কারণ আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় আছে এবং আগামীতেও ক্ষমতায় আসবে।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন দল একটাই—আওয়ামী লীগ। এমন চিন্তাধারা দল কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা বুঝতে পারে দলের প্রকৃত নেতা কর্মীরা। কিন্তু তারা নিরুপায়। কারণ তাদের কথা শোনার কেউ নেই।
আরও পড়ুন : উন্নয়ন প্রচারের চেয়ে দুর্নীতি রোধ জরুরি
সাধারণ মানুষ নীরবে সবকিছু হয়তো সহ্য করছে। তবে এই সহ্যশক্তি কতদিন ধরে রাখতে পারবে তা ভাবতে হবে দলকে। এলাকাভিত্তিক রাজনীতি বলতে গেলে এখন নিয়ন্ত্রণহীন।
উঠতি যুব সমাজের দাপট দেখে দলের পুরোনো ত্যাগী নেতা, কর্মীরাও হতবাক হয়। এমনকি সরকারের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার উপর তাদের এতটাই প্রভাব যা দেখে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত।
মিথ্যা আওয়ামী লেবাসে এসব ব্যক্তির নিজেকে জাহির করার প্রবণতা ব্যক্তি নয় দলকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে জনগণের কাছে। একসময় বলা হতো দল হাইব্রিডদের দখল। আর এখন বলা যায় হাইব্রিডদের পাশাপাশি দল আগাছাদেরও কবলে।
সরকার আসে সরকার যায়। কিন্তু দল টিকে থাকে তার আদর্শ আর ত্যাগী নেতা কর্মীদের সংগ্রাম ও সাধারণ মানুষের ভালোবাসা নিয়ে...
এই আগাছারা কোনোদিন দলের দুঃসময়ের বন্ধু হবে না। এরা কেবল সরকারের উন্নয়নের পথ কঠিন করছে। যদি দেশে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় তবে তার প্রমাণ মিলবে আগামী নির্বাচনে।
যেখানে সরকার প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের জীবনযাত্রার উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন; সেখানে একটা মুজিব কোট পরিধান করেই রাতারাতি আওয়ামী লীগ বনে যাওয়া ব্যক্তিদের বিশ্বাস করা ভুল। কারণ এরা তাদের কার্যকলাপে বারবার প্রমাণ করে 'বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়।' তা না হলে দেশে দুর্নীতি শব্দটা এতদিনে হারিয়ে যেত, যদি প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের নীতি অনুসরণ করত।
এই অবস্থায় দেশ—রাজনীতি হয়ে গেছে বিশেষ শ্রেণির কিছু মানুষের আলোচ্য বিষয়। আর সেই শ্রেণিতে রাজনৈতিক আদর্শের চেয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধ করার লোক সংখ্যাই বেশি।
আরও পড়ুন : জনপ্রতিনিধি নাকি জনপ্রিয় প্রতিনিধি?
তবে এই দশার জন্য দায়ী হলো, শুদ্ধ রাজনৈতিক চর্চার অভাব। বিশেষভাবে সরকার সমর্থিত আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থক এখন সারাদেশে এত বেশি যে, তা দেখে মনে হয় দেশে আর কোনো দল নাই। এর কারণ একটাই, দীর্ঘমেয়াদি আওয়ামী সরকার। চিন্তাচেতনা ও মননে আওয়ামী লীগার না হয়েও প্রকাশ্যে আওয়ামী প্রেমীর ভান ধরে পদ-পদবি ধারণ করে ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহার করা এখন সহজলভ্য।
পদ পেতে আজকাল আর দলের আদর্শ বা ত্যাগী নেতা হতে হয় না। বরং স্বর্ণলতার মতো পরগাছা হয়েই সুযোগ সুবিধা বেশি পাওয়া সম্ভব। তাই আওয়ামী রাজনীতিতে আগাছাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আর এই আগাছারই সরকার, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার জন্য ক্রমশ বিপদজনক হয়ে উঠছে।
প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাসহ অন্যান্য সেক্টরে যে ধরনের অন্যায়, দুর্নীতি বিদ্যমান তার অন্তরালে কারা, কীভাবে কাজ করছে তা খতিয়ে দেখা খুবই জরুরি দলের স্বার্থে।
এখানে মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এতকিছু নিয়ে চিন্তার প্রয়োজন নেই। নিজেকে সমস্যা মুক্ত রাখতে আওয়ামী লীগ করাই শ্রেয়...
সরকার আসে সরকার যায়। কিন্তু দল টিকে থাকে তার আদর্শ আর ত্যাগী নেতা কর্মীদের সংগ্রাম ও সাধারণ মানুষের ভালোবাসা নিয়ে। দেশের সব মানুষ সরাসরি রাজনীতি করে না। কিন্তু তারা নিজেদের বিশ্বাস, ভালোবাসা, দেশপ্রেম, দলের আদর্শ ও নেতা কর্মীদের কর্ম দিয়ে দলের সমর্থক হয়। নির্বাচনে ভোট দিয়ে দলকে জয়ী করে দলে জনগণের জন্য কাজ করবে এই চিন্তা করে।
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বর্তমানে দেশের মানুষ মনে করে, 'সরকারি দলে আছি'—এ কথাটা কোনোভাবেই প্রকাশ করতে পারলে একটু ভালো থাকতে পারব।
এখানে মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এতকিছু নিয়ে চিন্তার প্রয়োজন নেই। নিজেকে সমস্যা মুক্ত রাখতে আওয়ামী লীগ করাই শ্রেয়। কারণ সারাদেশ কে প্রকৃত আওয়ামী লীগ আর কে লেবাসধারী আওয়ামী লীগ তা কেউ দেখার নেই।
আরও পড়ুন : সহমতের রাজনীতি
অন্যদিকে যারা সরকার দলের লেবাস নিয়ে অনিয়ম দুর্নীতির সাথে হাত মিলিয়ে বিত্তশালী হয়ে উঠেছে তারা রাজনৈতিক অঙ্ক কষে আগামী নির্বাচন নিয়ে চিন্তা করে না। তাদের ভাবনা হলো আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় না আসলে তাদের ধস নামবে। কারণ এরা ত্যাগী নেতা কর্মী কিংবা হাইব্রিড নয়, এরা হলো দলের আগাছা।
এদের কাছে শেখ হাসিনা আর আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দর্শন নয়। বরং আওয়ামী সরকার হলো তাদের মিথ্যা লেবাসে ক্ষমতা পাওয়ার সিঁড়ি। আর এই সিঁড়ি যেকোনভাবে নির্বাচন করে আবার ক্ষমতা এলে তাদের জীবনের ভোগবিলাস বাড়বে বৈ কমবে না।
তাই এরা জনগণের ভোটাধিকার বিঘ্ন ঘটাতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। যার প্রমাণ দেখা যায় জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে। সুতরাং কালক্ষেপণ না করে দলের নাম আর মুজিব কোটধারী এসব আগাছা উপড়ে ফেলার দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত সরকার ও দলের সত্যিকারের নেতা কর্মীদের।
হাসিনা আকতার নিগার ।। কলাম লেখক